Quantcast
Channel: QuranerAlo.com –কুরআনের আলো ইসলামিক ওয়েবসাইট
Viewing all 995 articles
Browse latest View live

কেন এত ভূমিকম্প হয়? এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়

$
0
0

লিখেছেনঃ আবদ্ আল-আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বাজ (রহিমাহুল্লাহ)
(সাবেক প্রধান মুফতি, সৌদি আরব)

কয়েকদিন পরপরই মৃদু কম্পনে সারা দেশ কম্পিত হয়ে উঠছে, এগুলো বড় একটা কম্পন আসার আগে সতর্ককারী কম্পন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের সতর্ক করেন যাতে করে তারা অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে। 

কেন এত ভূমিকম্প সংগঠিত হয়? এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় :

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, এবং শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের, তাঁর পরিবারের উপর, তাঁর সাহাবাদের উপর এবং তাদের উপর যারা তাদের অনুসরণ করেন।

মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, তাঁর ইচ্ছা এবং তিনি যা কিছু প্রেরণ করবেন সে সকল বিষয়ে তিনিই সবকিছু জানেন এবং তিনি সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সর্বাধিক অবহিত তাঁর আইন কানুন ও আদেশ সম্পর্কে। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহদেরকে সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের নিদর্শন সৃষ্টি করেন এবং বান্দাহর উপর প্রেরণ করেন যাতে করে তারা মহান আল্লাহ কর্তৃক তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও ভীত হয়। বান্দাহরা মহান আল্লাহর সাথে যা শিরক করে (অর্থাৎ, ইবাদত করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব করে) এবং তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি এই নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করেন যাতে করে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে, তাদের বোধদয় হয় এবং তাদের রবের দিকেই একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করে।

মহান আল্লাহ বলেন:


(আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আযাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই( সূরা ইসরা ১৭:৫৯)

 


অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দিবো), যতোক্ষণ পর্যন্ত তাদের উপর এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, এই (কুরআনই মূলত) সত্য; একথা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার মালিক সবকিছু সম্পর্কে অবহিত? (সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৫৩)

 


বল: আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।(সূরা আল আনআম : ৬৫)

আল-বুখারী তার সহীহ বর্ণনায় জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণনা করেন,

তিনি বলেন: যখন “তোমদের উপর থেকে (আসমান থেকে) ” নাযিল হলো তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “আমি তোমার সম্মূখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”, অথবা যখন, “ অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম” নাযিল হলো, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবললেন: “আমি তোমার সম্মূখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”। (সহীহ আল বুখারী, ৫/১৯৩)

(আবূল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন,

“বল: আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) ” যার ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম”, যার ব্যাখ্যা হলো, ভুমিকম্প এবং ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া।)

নিঃসন্দেহে বর্তমানে যেসকল ভূমিকম্পগুলো ঘটছে তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাহদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। এই ভূমিকম্প এবং অন্যান্য সকল দূর্যোগগুলো সংগঠিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে; এই দূর্যোগগুলো আসার কারণ হচ্ছে, শিরকী কার্যকলাপ(ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে মহান আল্লাহর অংশীদার বানানো) এবং মানুষের পাপ (মহান আল্লাহ যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন সে কাজগুলো করার কারণে)।

এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ বলেন:


(হে মানুষ) যে বিপদ আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) ক্ষমা করে দেন।” (সূরা আশ শূরা : ৩০)

 

যে কল্যাণই তুমি লাভ কর (না কেন, মনে রেখো), তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর যেটুকু অকল্যাণ তোমার উপর আসে তা আসে তোমার নিজের থেকে”। (সূরা আন নিসা : ৭৯)

 

মহান আল্লাহ অতীত জাতীর উপর প্রেরিত আযাব সম্পর্কে বলেন:

অতপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুণাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচন্ড ঝড় পাঠিয়েছি (প্রচন্ড পাথরের বৃষ্টি) {যেভাবে লূত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল}, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘান হেনেছে {যেভাবে শুআইব (আ) এর জাতীর উপর আঘাত হেনেছিল}, কাউকে আমি যমীনের নীচে গেড়ে দিয়েছি {যেভাবে কারুন জাতীদের উপর এসেছিল}, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি {নূহ জাতী ও ফেরাউন ও তার লোকদের কে যেভাবে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল}, (মূলত) আল্লাহ তাআলা এমন ছিলেন না যে তিনি এদের উপর যুলুম করেছেন, যুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে”। ( সূরা আল আনকাবূত : ৪০)

 

এখন মুসলামানদের এবং অন্যান্যদের খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর নিকট তওবা করা উচিত, আল্লাহর কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তাআলা যেসব শিরকী কার্যকলাপ ও পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন (যেমন: নামায পরিত্যাগ না করা, যাকাত আদায় করা থেকে বিরত না হওয়া, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদ পান না করা, ব্যাভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজ সমূহ ভঙ্গ না করা প্রভৃতি) তা থেকে বিরত থাকা। এটা হতে আসা করা যায়, তারা এই দুনিয়া ও পরবর্তীতে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি পাবে এবং আল্লাহ তাদের আযাব থেকে নিরাপদে রাখবেন এবং তাদের উপর রহমত বর্ষন করবেন।

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:


“অথচ যদি সেই জনপদের মানুষগুলো (আল্লাহ তাআর উপর) ঈমান আনতো এবং (আল্লাহ তাআলাকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের উপর আসমান-যমীনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু (তা না করে) তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, সুতরাং তাদের কর্মকান্ডের জন্য আমি তাদের ভীষণভাবে পাকড়াও করলাম”। (সূরা আল আ’রাফ : ৯৬)

 


এবং আল্লাহ আহলে কিতাবধারীদের সম্পর্কে বলেন:
“যদি তারা তাওরাত ও ইনজিল (তথা তার বিধান) প্রতিষ্ঠা করতো, আর যা তাদের উপর তাদের মালিকের কাছ থেকে এখন নাযিল করা হচ্ছে (কুরআন) তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো, তাহলে তারা অবশ্যই রিযিক পেতো তাদের মাথার উপরের (আসমান) থেকে ও তাদের পায়ের নীচের (যমীন) থেকে”। (সূরা আল মায়িদা : ৬৬)

 

এবং আল্লাহ আরো বলেন:

(এ) লোকালয়ের মানুষগুলো কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে (তারা মনে করে নিয়েছে), আমার আযাব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে! অথবা জনপদের মানুষগুলো কি নির্ভয় হয়ে ধরে নিয়েছে যে, আমার আযাব তাদের উপর মধ্য দিনে এসে পড়বে না- তখন তারা খেল-তামাশায় মত্ত থাকবে। কিংবা তারা কি আল্লাহ তাআলার কলা-কৌশল থেকেও নির্ভয় হয়ে গেছে, অথচ আল্লাহ তাআলার কলা-কৌশল থেকে ক্ষতিগ্রস্থ জাতি ছাড়া অন্য কেউই নিশ্চিত হতে পারে না।” (সূরা আল আ’রাফ :৯৭-৯৯)

আল-আল্লামা ইবনে আল-কাইউম (রহ) বলেন: “মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে উঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয়; এইটা মানুষগুলোকে ভীত করে, তারা মহান আল্লাহর নিকট তওবা করে, পাপ কর্ম করা ছেড়ে দেয়, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়”। আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলতেন: “মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সতর্ক করছেন”। মদীনায় যখন একবার ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তার জনগনকে ভাষণে বললেন: “যদি আরো একবার ভূমিকম্প সংগঠিত হয় তাহলে আমি এখানে তোমাদের সাথে থাকবো না।”

সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকদের কাছে এরকম আরো অনেক ঘটনার বিবরণ রয়েছে।


যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা যেভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূর্য গ্রহণ দেখলে বলতেন: “যদি তুমি এরকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ কর, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।” (আল-বুখারী ২/৩০ এবং মুসলিম ২/৬২৮)

 

দরিদ্র ও মিসকিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং তাদের দান করা উচিত, কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
দয়া প্রদর্শন কর, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে”। ( ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত, ২/১৬৫)


যারা দয়া প্রদর্শন করে মহান দয়াশীল আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া দেখাবেন। পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর, এবং স্বর্গে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন।” ( আবু দাউদ কতৃক বর্ণিত ১৩/২৮৫, আত-তিরমিযী ৬/৪৩)

 

“যারা দয়া প্রদর্শন করবে না তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে না”। (আল-বুখারী ৫/৭৫, মুসলিম ৪/১৮০৯ কর্তৃক বর্ণিত)

বর্ণিত আছে যে, যখন কোন ভূমিকম্প সংগঠিত হতো, উমর ইবনে আব্দুল আযিয (রহ) তার গভর্ণরদের দান করার কথা লিখে চিঠি লিখতেন।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা মানুষকে বিপর্যয়(আযাব) থেকে নিরাপদে রাখবে তাহলো, যারা ক্ষমতায় আছে (অর্থাৎ যারা দেশ পরিচালনা করছে) তাদের উচিত দ্রুততার সাথে সমাজে প্রচলিত অন্যায় থামিয়ে দেওয়া, তাদের শরিয়া আইন মেনে চলতে বাধ্য করা এবং সে অনুযায়ী চলা, ভাল কাজের আদেশ দেওয়া এবং খারাপ কাজ নিষেধ করা।

মহান আল্লাহ বলেন:

মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা হচ্ছে একে অপরের বন্ধু। এরা (মানুষদের) ন্যায় কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, তারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, (জীবনের সব কাজে) আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলে (বিধানের) অনুসরণ করে, এরাই হচ্ছে সে সব মানুষ; যাদের উপর আল্লাহ তাআলা অচিরেই দয়া করবেন; অবশ্যই আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী, কুশলী।” (সূরা আত তওবা : ৭১)

 


আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন যে আল্লাহ তাআলার (দ্বীনে) সাহায্য করে, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা শক্তিমান ও পরাক্রমশালী। আমি যদি এ (মুসলমান) -দের (আমার) যমীনে (রাজনৈতিক) প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহলে তারা (প্রথমে) নামায প্রতিষ্ঠা করবে, (দ্বিতীয়ত) যাকাত আদায় (এর ব্যবস্থা) করবে, আর (নাগরিকদের) তারা সৎকাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে, তবে সক কাজেরই চূড়ান্ত পরিণতি একান্তভাবে আল্লাহ তাআলারই এখতিয়ারভূক্ত।” (সূরা আল হজ্জ : ৪০-৪১)


যে ব্যক্তি আল্লাত তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে (সংকট থেকে বের হয়ে আসার) একটা পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন রিযিক দান করেন যার (উৎস) সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই; যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।” (সূরা আত তালাক্ব : ২-৩)

 

এই বিষয়ে এরকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে দিবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন।” (আল-বুখারী ৩/৯৮, মুসলিম ৪/১৯৯৬)

 

এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

যে ব্যক্তি, এই পৃথিবীতে একজন বিশ্বাসীর দুশ্চিন্তা দূর করে দিবে, মহান আল্লাহ তাকে পুনরুত্থান দিবসের দূশ্চিন্তা থেকে নিরাপদে রাখবেন। যে ব্যক্তি, কারো কাজকে সহজ করে দিবে(যে কঠিন কাজে নিয়োজিত), মহান আল্লাহ তার দুনিয়া ও পরকালের কাজকে সহজ করে দিবেন। যে ব্যক্তি, একজন মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে মহান আল্লাহ দুনিয়া ও পরকালে তার দোষ গোপন রাখবেন। মহান আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত একজনকে সাহায্য করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে।” (মুসলিম ৪/২০৭৪);

 

এই বিষয়ের উপর এরকম আরো অনেক হাদীস রয়েছে।

মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন সকল মুসলিমদের খারাপ অবস্থা থেকে ভাল অবস্থার দিকে উন্নীত করেন এবং তাদেরকে হিদায়াত করেন যেন তারা ইসলামকে ভালভাবে বুঝতে পারে ও দৃঢ়তার সাথে একে আকড়ে ধরে রাখে এবং তিনি যেন তাদের সকল পাপকে ক্ষমা করে দেন। আমরা মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন যারা মুসলামানদের ক্ষমতায় আছে(সরকার) তাদের সংগঠিত করেন, এবং তাদের মাধ্যমে সত্যকে সাপোর্ট আর মিথ্যাকে দূরীভূত করে দেন, এবং শরীয়া আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করার জন্য যেন তিনি তাদের সাহায্য করেন, এবং শয়তান যেন তাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত, প্ররোচিত ও প্রতারিত করতে না পারে তাথেকে মহান আল্লাহ তাদের রক্ষা করেন, কারণ মহান আল্লাহই একমাত্র সবকিছূ করার ক্ষমতা রাখেন।

মহান আল্লাহর রহমত এবং শান্তি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর পরিবারের এবং সাহাবাদের এবং কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তাদেরকে যারা অনুসরণ করবে তাদের উপর আপতিত হোক।

 

অনুবাদ : ব্লগার উমর


ভূমিকম্পের করণীয় –সবাইকে জানতে সাহায্য করুন

$
0
0

237

বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ ওয়াস সালাতু ওয়াস সালাম আলা রাসূলিল্লাহ ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি আজমাইন আম্মাবাদ ।

সকল  প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এবং আমরা শুধুমাত্র তারই কাছে সাহায্য কামনা করি এবং দরুদ অ সালাম নাজিল হোক প্রিয় নবী প্রিয় ইমাম মুহাম্মাদ (صلى الله عليه وسلم) এর উপর তার পরিবারবর্গের উপর, সাহাবাকেরামদের উপর, তাবেঈগনের উপর,তাবে তাবেঈ গনের উপর এবং কিয়ামাত পর্যন্ত  যারা তার অনুশরন করবে তাদের উপর।  আল্লাহর সতকীকরণ ধরন-ধারণে, আকার-প্রকৃতিতে, বিভিন্ন সময় বিভিন্নরূপে আপতিত হয়। কখনো ব্যাপক বিধংসী ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতিতে, কখনো নির্বাধ-দুর্দমনীয় বন্যার আকারে, কখনো বা যুদ্ধের আকারে, কখনো প্রচণ্ড ভূমিকম্পের আকারে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করে থাকেন। কারণ তিনি চান না যে মানুষ অবাধ্য  হয়ে, তার বিধি-বিধানের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, প্রবৃত্তি চালিত হয়ে জীবনযাপন করুক, যার ভয়াবহ পরিণতি হবে পরকালের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক জীবন, জাহান্নাম।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঘটনা একের পর এক ঘটে গেলেও তা আমাদের তেমন একটা সচেতন করতে পারেনি। যে দূর্যোগের কোন পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব নয় তার থেকে বাচতে হলে প্রয়োজন সতর্কতা। চলুন আমরা আমাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন নিয়ে হেলাফেলা না করে নিজেরা সতর্ক হই করার এবং সবাইকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রস্তুত করে তুলি।

প্রতিরোধ (ভূমিকম্পের আগে করণীয়)

 ঘরেরপ্রস্তুতি – আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি যে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির মূল কারণ বিল্ডিং ধসে পড়া নয়। বরং আসবাব, ভঙ্গুর কাঠামো অথবা তৈজসপত্রের কারণেই বেশিরভাগ ক্ষতি হয়ে থাকে। জোরাল ভূমিকম্পের সময় মেঝের আগে-পিছে ঝাকুনি সেকেন্ডে কয়েক ফুট পর্যন্ত হতে পারে যার কারণে ঘর থেকে বের হওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে এবং ঘরেরমাঝে ছুটন্ত বস্তুর আঘাতেই আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা প্রবল থাকে। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে –

  •   শেলফ ও আলমারিতে বড় ও ভারি মালপত্র নিচের দিকে রাখুন।
  • ভঙ্গুর তৈজসপত্র যেমন বোতল, গ্লাস, কাপ, প্লেট ইত্যাদি বন্ধ ক্যাবিনেটে রাখুন।
  •  দেয়ালে ঝোলানো ভারি শো-পিস যেমন ছবির ফ্রেম, আয়না ইত্যাদি বিছানা, সোফা অথবা অন্য কোন বসার স্থান থেকে দূরে রাখুন।
  •  ত্রুটিযুক্ত বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং এবং গ্যাসের লাইন মেরামত করে নিন। এসব স্থান থেকে সহজে আগুন ধরতে পারে।
  •  দেয়ালে বা সিলিং এ ফাটল থাকলে মেরামত করে নিন; এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়ার দরকার হতে পারে।
  •  যেসব বিল্ডিং এখনো তৈরি হয়নি সেগুলো যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করুন।

 

ঘরে-বাইরে ভূমিকম্প হতে নিরাপদ স্থানসমূহ চিহ্নিত করুন

  •  ভারি টেবিল বা মজবুত চৌকি বা খাটের নিচে।
  •  ভিতরের দিকের দেয়ালের পাশে (সীমানার দিকের দেয়াল ও জানালার কাছে থাকা বিপজ্জনক)।
  •  জানালা, ছবির ফ্রেম বা আয়না জাতীয় ভঙ্গুর কাঠামো এবং ঝাকুনিতে পড়ে যেতে পারে এমন ভারি আসবাব থেকে দূরে।
  •  ঘরের বাইরে খোলা এলাকা – যা কোন বিল্ডিং এবং বৈদ্যুতিক লাইন থেকে দূরে।

 

নিজে ও পরিবারের সবাই সচেতন হোন

  •  ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্পের সময় ও এর পরে কি করণীয় সে বিষয়ে সচেতনতা।
  • ভূমিকম্প হতে নিরাপদ স্থানগুলো চিহ্নিত করার যোগ্যতা যাচাই।
  • ভূমিকম্পের সময় কি করতে হবে তার মহড়া।

 

শুধু নিজে নয়, অপরকেও এসব জানতে সাহায্য করুন

  •   পোস্টার, বিলবোর্ডের মাধ্যমে।
  •  ফেসবুক ও অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এই প্রবন্ধটি শেয়ার করার মাধ্যমে।
  •  স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ঘরে ঘরে অথবা স্কুল-কলেজে প্রচারের মাধ্যমে।

 

মোকাবেলা (ভূমিকম্পের সময় করণীয়)

 

ভূমিকম্পের সময় চলাফেরা কঠিন ও বিপজ্জনক। তাই যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়া প্রয়োজন। দৌড়ে বের হওয়া তখনই উচিত হবে যখন আপনি বাড়ির গেট এর কাছে থাকবেন এবং বাইরে বিল্ডিং ও বৈদ্যুতিক লাইন থেকে দূরে যাওয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব। কাজেই, বাইরে বের হওয়া সম্ভব না হলে ঘরের নিরাপদ আশ্রয় ব্যবহার করা প্রয়োজন।

 

হামাগুড়ি – আশ্রয় ও ধরে রাখার পদ্ধতি।

ভেতরের দিকের দেয়ালের কাছে আশ্রয় নেয়া।

 

বাড়ির ভিতরে থাকলে  

  •  মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ুন, ভারি টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নিন এবং খাট বা টেবিলের পায়া ধরে রাখুন যাতে করে ঝাকুনিতে তা সরতে না পারে।
  •  নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পারলে হাত দিয়ে মাথা ঢেকে ভেতরের দিকের কোন দেয়াল বা কোনায় বা কলামের গোড়ায় হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ুন।
  •  পতনশীল ভারি আসবাব, ছবির ফ্রেম, আয়না, জানালা থেকে দূরে থাকুন।
  •  বিছানায় শোওয়া অবস্থায় থাকলে বিছানা থেকে বেশি দূরে যাবার চেষ্টা করবেননা। খাটের নিচে বা নিকটতম নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
  •  লিফট বা এলিভেটর ব্যবহার করবেননা।
  •  মনে রাখবেন, বিদ্যুত সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে যা কিনা আপনার চলাফেরাকেও ব্যাহত করতে পারে।

 

বাড়ির বাইরে বা গাড়িতে থাকলে 

  •  বিল্ডিং, বৈদ্যুতিক লাইন, ল্যাম্পপোস্ট থেকে দূরে থাকুন।
  • বড় ভূমিকম্পের পরেও কয়েক দফা মৃদু কম্পন হতে পারে। কাজেই ঝাকুনি শেষ হওয়ার পরেও কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করুন।

 

ভেঙ্গে পড়া বাড়িতে আটকা পড়লে  

  •  আগুন জ্বালাবেননা। গ্যাস লাইন লিক করে থাকলে তা আগ্নিকান্ডের সূত্রপাত করতে পারে।
  •  ধীরে নড়াচড়া করুন।
  •  কাপড় বা রুমাল দিয়ে নাকমুখ ডেকে নিন ও উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকুন।

 

 

প্রতিকার (ভূমিকম্পের পরে করণীয়)

  •   বড় ভূমিকম্পের পরবর্তী মৃদু কম্পনের জন্য প্রস্তুত থাকুন। এ ধরণের কম্পন মূল কম্পনের এক ঘন্টা থেকে এক মাসের মধ্যে যেকোন সময় হতে পারে।
  •  শেলফ, আলমারি খোলার সময় সাবধান থাকুন। মালপত্র সহজেই পড়ে যেতে পারে।
  •  ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান থেকে দূরে থাকুন যদি না আপনার সাহায্য একান্ত প্রয়োজনীয় হয়।
  •  সমুদ্র এলাকার লোকজন সুনামি বা উচু জোয়ারের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
  •  আটকা পড়া বা আঘাতপ্রাপ্ত মানুষকে সাহায্য করুন।
  •  গ্যাসের গন্ধ বা নির্গমণের শব্দ পেলে জানালা খুলে দিন ও দ্রুত বের হয়ে যান। যথাশীঘ্র তা মেরামত করার ব্যবস্থা নিন।
  •  বিদ্যুতের স্পার্ক দেখলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন, যাওয়ার পথে পানি থাকলে নিজে মেরামত না করে ইলেক্ট্রিশিয়ানের পরামর্শ নিন।

 

শেষ করার আগে বলতে চাই, এই তথ্য সবাইকে জানিয়ে দিন। যেকোন স্থানে শেয়ার করুন। আপনার সামান্য তথ্য শেয়ার হতে পারে অনেক মানুষের জীবন রক্ষার কারণ! ধন্যবাদ।ভালো থাকুন।

 

[এই তথ্য মূলত http://www.fema.gov/hazard/earthquake/index.shtm থেকে অনূদিত। এছাড়াও  সাইটের সাহায্য নেয়াহয়েছে – http://www.earthquakecountry.info/dropcoverholdon/]

Related Article:

কেন এত ভূমিকম্প হয়? এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়

ভুমিকম্পের সময় আমাদের করণীয় [বাচতে হলে জানতে হবে] 

সতর্কতা ভূমিকম্পে করণীয় 

 

ভূমিকম্প : কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?

$
0
0

লেখকঃ আবিদ রহমান

সকল  প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এবং আমরা শুধুমাত্র তারই কাছে সাহায্য কামনা করি এবং দরুদ অ সালাম নাজিল হোক প্রিয় নবী প্রিয় ইমাম মুহাম্মাদ (صلى الله عليه وسلم) এর উপর তার পরিবারবর্গের উপর, সাহাবাকেরামদের উপর, তাবেঈগনের উপর,তাবে তাবেঈ গনের উপর এবং কিয়ামাত পর্যন্ত  যারা তার অনুশরন করবে তাদের উপর।  আল্লাহর সতকীকরণ ধরন-ধারণে, আকার-প্রকৃতিতে, বিভিন্ন সময় বিভিন্নরূপে আপতিত হয়। কখনো ব্যাপক বিধংসী ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতিতে, কখনো নির্বাধ-দুর্দমনীয় বন্যার আকারে, কখনো বা যুদ্ধের আকারে, কখনো প্রচণ্ড ভূমিকম্পের আকারে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করে থাকেন। কারণ তিনি চান না যে মানুষ অবাধ্য  হয়ে, তার বিধি-বিধানের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, প্রবৃত্তি চালিত হয়ে জীবনযাপন করুক, যার ভয়াবহ পরিণতি হবে পরকালের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক জীবন, জাহান্নাম।

দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনার জন্যে  কতটুকু প্রস্তুত? বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ভেসে গেলে, হাজারো মানুষের প্রাণহানি ও সর্বস্ব হারিয়ে গেলে সরকার কিছুদিন মাতামাতিতে মাতে। সংবাদপত্রগুলো হিউম্যান স্টোরি ‘বেচে’ খায়! কিন্তু পরে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার প্রস্তুতি লক্ষ করা যায় না।ইদানীংকালে বাংলাদেশে প্রায় ভূমিকম্পের ‘উপদ্রব’ দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সচরাচর এসব ভূমিকম্পের উৎস না-হলেও প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন উৎসে উৎসারিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় (আফটার শক) বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভয়ে-বিস্মরণে বারবার কেঁপে উঠছে। দুলছে বহুতল দালান। ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে জনপথে। বস্তি বা কাঁচা ঘরবাড়ি কিংবা ভূমিধসের মাত্রাহীন আশঙ্কার কথা পাশে তুলে রাখি।নগরায়নের হুজুগে বাংলাদেশ জুড়ে গড়ে উঠেছে পাকা, সেমি-পাকা আর বহুতল অপরিকল্পিত (বহুলাংশে অননুমোদিতও) বাড়ি-ঘর। ২০০০ সালের আগে সিমেন্টে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। বাংলাদেশের নির্মাণশিল্প নির্ভরশীল ছিল আমদানিকৃত চীনা সিমেন্টের ওপর। অধিক মুনাফার লোভে চীনের রাস্তা আর নর্দমা বানানোর উপযোগী ৪২৫ মানের সিমেন্টে গড়ে উঠেছে ঢাকা-চাটগাঁসহ বিভিন্ন শহরাঞ্চল। আমাদের আন্তঃনগর ও আন্তঃজেলার সংযোগ সড়কগুলো কেবলমাত্র তৃতীয় শ্রেণীর মানের নয় বরং একমাত্র যাতায়াত ও যোগাযোগ মাধ্যম। রাজধানীর সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার জন্যে চাই সামান্য কোনও অঘটন।

বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর চাটগাঁর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগের পথ মাত্র একটি। বিকল্প একটি রাস্তা আছে প্রায় সিলেট স্পর্শ করে ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে। আরেকটি বন্দর মংলার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও বেশ নাজুক।রেল যোগাযোগ এমনিতেই বিভিন্ন কারিগরি ও সিগন্যাল সমস্যায় ভোগে। দুই জেলার মাঝখানে কোথাও কোনও রেললাইন বিচ্ছিন্ন কিংবা নষ্ট হলে তাৎক্ষণিক সারানোর মতো কারিগরি সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। নদী পথগুলো এখনো নির্ভরযোগ্য চলাচল মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। বিমানবন্দরগুলো তো আদি-যুগের।৭ মাত্রার একটা ভূ-কম্পনে বিপুল পরিমাণ দালান ধূলিস্মাৎ হবে। কাঁচা বাড়ি-ঘর মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। বাসের চাকা সুষ্ঠুভাবে চলাচলের অনুপযোগী রাস্তার কী দুর্দশা হবে সেটা ভাবতেও ভয় লাগে! অকাতরে প্রাণহানি ঘটবে এই সর্বনাশী আশঙ্কা থাকবেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, আহত ও দুর্গতদের উদ্ধারের কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সেই প্রস্তুতি বা সামর্থ্য কি বাংলাদেশের আছে? বড় ধরনের ভূ-কম্পনে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসসহ সকল ইউটিলিটি ব্যবস্থা ভেঙে পড়া স্বাভাবিকএকসঙ্গে ১০ হাজার আহত মানুষকে সামান্য প্রাথমিক সাধারণ চিকিৎসা দেওয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচারের বিষয়ে কি কোনও সরকারি কার্যকর পরিকল্পনা আছে? ধ্বংসস্তূপের ভেতর বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে উদ্ধারের সরঞ্জামাদির কোনও ব্যবস্থা বা আয়োজন কি বিবেচনায় আছে? দুর্গত মানুষগুলো খোলা আকাশের নিচে পানি-খাদ্য-কম্বলের অভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে পারে আশঙ্কার বিপরীতে সরকারি ভাবনাটা কী?

কয়েক বছর আগে হাইতিতে ভূ-কম্পে নিহত মানুষের সংখ্যার চেয়ে ভূ-কম্প পরবর্তী মৃতের সংখ্যাই বেশি দেখা গেছে অব্যবস্থাপনায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক শক্তি-সামর্থ্যে সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁবু-পানি-শিশু ও মৌলিক খাদ্য সরবরাহ নিয়ে। কিন্তু বিদেশি সাহায্য নিয়ে সুবিশাল হারকিউলিস বিমানগুলো নামার এবং রিলিফ সামগ্রী বিলি বণ্টনের মতো ‘রিসোর্স’ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ছিল না হাইতির। বাংলাদেশে একসঙ্গে কয়টা হারকিউলিস বিমান নামতে পারবে বিদেশি সাহায্য নিয়ে? আর সেই সাহায্য সরঞ্জামাদি স্টোরেজের অবকাঠমো ও ব্যবস্থা কী আছে? যদি রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আক্রান্ত অঞ্চল থেকে তাহলে সেই জেলায় আকাশযোগে রিলিফ পৌঁছানো কি যাবে? ভূমিকম্পের মতো জাতীয় দুর্যোগে একসঙ্গে অনেকগুলো অ্যাম্বুলেন্স আর হাসপাতাল শয্যার অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন দেখা দেয়। আমাদের সার্বিক চালচিত্র কী? একসঙ্গে দু’তিনটি জেলা আক্রান্ত হলে কী হবে বাংলাদেশের? দেশি-বিদেশি সাহায্য-সহায়তা কি সময়মতো পৌঁছনো সম্ভব হবে? ল্যান্ড লাইন বিকল হলে আর মোবাইল ফোনের টাওয়ারগুলো ভেঙে পড়লে বিকল্প কোনো মাধ্যম বা ব্যবস্থা কী আছে অব্যাহত যোগাযোগের? ব্যবস্থা কী আছে বিদেশি ডাক্তার ও সাহায্যকর্মীদের অস্থায়ী আবাসনের?

সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার। বাংলাদেশের কোনও ইনফরমেশনের ব্যাকআপ নেই। ব্যাংকগুলোর লেনদেনের তথ্যগুলোর কী কোনও ব্যাকআপ থাকে আঞ্চলিক কিংবা হেড অফিসে? কার একাউন্টে কত ছিল কিংবা ঋণখেলাপিদের তালিকাটা ভূমিকম্প-উত্তর বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে? ভেঙে পড়া কারাগারের কয়েদিদের তালিকাটা কি ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার সম্ভব হবে? চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তালিকাটা? ফ্ল্যাটগুলোর দলিল, জমির মালিকানার রেকর্ডের কোনো ব্যাকআপের ব্যবস্থা কী আছে? উল্লেখ্য, ’৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কসবা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছিল। তখনও এক জেলার সম্পত্তি অন্য জেলায় রেজিস্ট্রির নিয়ম ছিল। এখনও জমির দালালেরা পুড়ে যাওয়া কসবা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি দেখিয়ে নিরীহ মানুষের সম্পদ লুটে। ভূমিকম্প-উত্তর বাংলাদেশে অকাতরে প্রাণ ও সম্পদের হানি ঘটবে নিঃসন্দেহে কিন্তু তথ্যের অভাবে একজনের ব্যাংক হিসাব অন্যের নামে, সাধুকে সন্ত্রাসী আর খুনি বেকসুর খালাস এবং একজনের জমি অন্যের নামে দেখানোর ব্যবসাটা বেশ জমে উঠবে।ভাগ্য সহায়তা করলে দুর্গত মানুষগুলোকে উদ্ধার ও বাঁচানো যাবে হয়ত। বিধ্বস্ত নগরীগুলো গড়ে তোলা যাবে ধীর লয়ে হলেও। সভ্যতার অগ্রযাত্রা কখনও থেমে থাকে না। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া তথ্যগুলো?

কোনও কোনও মানুষ ভূমিকম্পের আগাম ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ের মুনাফার অংকটা ভেবে নিশ্চয় গোঁফে তেল মাখছেন। অবশ্য কেউ কেউ আছেন কুম্ভকর্ণ নিদ্রায়।

আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে এই দুর্যোগের থেকে হেফাজাত করুক। আমিন

মূল প্রবন্ধঃ সংগৃহীত 

কেন এত ভূমিকম্প হয়? এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়

 

বৈধ অবৈধের মানদণ্ডে পবিত্র মক্কার বিভিন্ন স্থানসমূহের সম্মাননা

$
0
0

454372646

লেখক: শাইখ সা‘দ ইবন আলী আশ-শাহরানী | সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ভূমিকা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর বিশ্বস্ত নবীর প্রতি, তাঁর পরিবারের প্রতি এবং তাঁর সাহাবাগণের প্রতি।

অতঃপর, আল্লাহ্ তা‘আলা যা ইচ্ছা তা তিনি সৃষ্টি করেন এবং বাছাই করেন। আর তিনি যা বাছাই করেছেন তাতে রয়েছে তাঁর পরিপূর্ণ হিকমতের পরিচয়। মক্কা মোকাররামাকে তিনি তাঁর মহিমান্বিত শহরে পরিণত করেছেন এবং তাঁর আদি গৃহের অবস্থান স্থল হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, এই শহরকে সম্মানিত করেছেন বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ফযিলত ও বিধি-বিধান দ্বারা, যার মাধ্যমে এই শহর পৃথিবীর অনান্য শহরের চেয়ে অদ্বিতীয় হয়ে আছে, এটি বরকতময় নগরী, ওহী অবতীর্ণের স্থল, রিসালাতের ভূমি, এই শহরের ফযিলত জ্ঞাত, আর এ ব্যাপারে দলীল প্রমাণ প্রসিদ্ধ এবং অসংখ্য। নিশ্চয়ই আল্লাহ মক্কা মোকাররামাকে কিছু ফযিলতপূর্ণ স্থানের এবং পবিত্র ও স্পষ্ট নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে বৈশিষ্ট্যময় করেছেন আর আমাদের জন্য সেখানে কিছু ইবাদতকে বিধিসম্মত করেছেন, যার মাধ্যমে আমরা তাঁর নৈকট্য লাভ করব। আমি এই প্রবন্ধে এই সম্মানিত স্থানসমূহের ফযিলত নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী হয়েছি, আল্লাহর এই মহিমান্বিত শহরে হাজী, ওমরাকারী ও যিয়ারতকারীগণকে আহ্বান করার জন্য যে, তারা যেন আরো অধিক প্রচেষ্টা চালায় আল্লাহর ইবাদত এবং নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে; যাতে করে অসংখ্য ছাওয়াব হাসিল করতে পারে। পক্ষান্তরে অন্যান্য স্থানে যে সমস্ত বিদ‘আত ও শির্ক করা হয়, যার ফযিলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো সহীহ হাদীস প্রমাণিত নয়, তা থেকে সতর্ক করা যায়।

নিঃসন্দেহে নিষিদ্ধ স্থানসমূহকে সম্মান করা থেকে বৈধ স্থানসমূহকে সম্মান করাই মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে। যে ব্যক্তি নিজেকে বৈধ ইবাদতে ব্যস্ত রাখল তা তাকে সমস্ত বিদ‘আতী তরীকা থেকে যথেষ্ট করবে; বরং সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যে সমস্ত স্থানকে সম্মানিত করেছেন সেখানে এমন স্বাদ, স্বাভাবিকতা এবং বরকত হাসিল করবে যা অন্যত্র পাবে না। অতএব সুন্নাতের মাঝে নিজেকে অটল রাখা বিদ‘আতে কঠোর সাধনা করা থেকে উত্তম।

আমি আমার হজ্জ এবং ওমরাকারী সে সব মুসলিম ভাই যারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই মহিমান্বিত শহরে এসেছেন, যাদের অন্তরসমূহ এই আদি গৃহের প্রতি আগ্রহী হয়ে আছে, তাদেরকে আহ্বান জানাই তারা যেন তাদের সময়কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণের মাধ্যমে কাজে লাগান এবং তারা যেন নিজেদেরকে এমন কষ্ট না দেয় যা আল্লাহ্ তাদের উপর চাপিয়ে দেন নি এবং তারা যেন সতর্ক থাকে বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়া থেকে। আর তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করবে ঐ বিধান মোতাবেক যা আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। বস্তুত হেদায়েত ও সাহায্য করার জন্য তোমার রবই যথেষ্ট।

মক্কা মোকাররামার ফযিলত এবং তার অধিবাসী ও সেখানে আগন্তুকদের প্রতি করণীয় জরুরী বিষয়সমূহের বর্ণনা:

আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর মধ্যে মক্কা মুকাররামাকে বাছাই করেছেন তাঁর মহিমান্বিত ঘরের জন্য, পৃথিবীর সবদিক থেকে মানুষ এখানে আগমন করে। আর এই হারামের রয়েছে মহান আল্লাহর নিকট বিশেষ গুরুত্ব। কুরআনে কারীমে আল্লাহ্ এই নগরীকে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করেছেন। আর তা হলো: মক্কা, বাক্কা, উম্মুল কোরা, নিরাপদ শহর, বালাদ (শহর), বালদা (লোকালয়), মসজিদ হারাম, মা‘আদ (প্রত্যাবর্তন স্থল)। এই একাধিক নাম মূলত আল্লাহর নিকট এ শহরের মর্যাদা ও সম্মানের কথা প্রমাণ করে, অবশ্য আলেমগণ মাক্কা মুকাররামার আরো অনেক নাম উল্লেখ করেছেন।

এই হারাম নগরীর অনেক ফযিলত রয়েছে, যার বর্ণনা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বহু স্থানে উল্লেখ করেছেন। অনুরূপ তার ফযিলতে তাঁর নবীর সুন্নাতও সুশোভিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নিম্নরূপ:

১. আল্লাহ এই শহরকে সম্মানিত করেছেন:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ إِنَّمَآ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ رَبَّ هَٰذِهِ ٱلۡبَلۡدَةِ ٱلَّذِي حَرَّمَهَا وَلَهُۥ كُلُّ شَيۡءٖۖ وَأُمِرۡتُ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ  [النمل: ٩١

“আমি তো আদিষ্ট হয়েছি এই নগরীর (মক্কার) প্রভুর ইবাদত করতে, যিনি একে করেছেন সম্মানিত, সবকিছু তাঁরই, আমি আরো আদিষ্ট হয়েছি, যেন আমি মুসলিম (আত্মসমর্পনকারী)-দের অন্তর্ভুক্ত হই।” [সূরা আন-নামল: ৯১]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত,

«فَإِنَّ هَذَا بَلَدٌ حَرَّمَ اللَّهُ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، وَهُوَ حَرَامٌ بِحُرْمَةِ اللَّهِ إِلَى يَوْمِ القِيَامَة»

“আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টি করার দিন আল্লাহ এই নগরীকে সম্মানিত তথা মহিমান্বিত করেছেন, অতএব কিয়ামত পর্যন্ত তা আল্লাহর সম্মানদানের কারণে মহিমান্বিত থাকবে।”(বুখারী: ১৮৩৪)

২. আল্লাহ তা‘আলা এই নগরীর নামে কসম করেছেন:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[وَهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٱلۡأَمِينِ  [التين: ٣

“এবং শপথ এই নিরাপদ শহরের”। [সূরা আত-ত্বীন-৩]

[ لَآ أُقۡسِمُ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ١ وَأَنتَ حِلُّۢ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ  [البلد: ١، ٢

“শপথ করছি এই মক্কা নগরীর, আর তুমি এই নগরের বৈধ অধিকারী হবে”। [সূরা আল-বালাদ: ১-২]

৩. এই শহরের জন্য ইবরাহীম খলীল আলাইহিসসালাম এর দো‘আ:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا ٱلۡبَلَدَ ءَامِنٗا وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ ٣٥ رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضۡلَلۡنَ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلنَّاسِۖ فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُۥ مِنِّيۖ وَمَنۡ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣٦ رَّبَّنَآ إِنِّيٓ أَسۡكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيۡرِ ذِي زَرۡعٍ عِندَ بَيۡتِكَ ٱلۡمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ فَٱجۡعَلۡ أَفۡ‍ِٔدَةٗ مِّنَ ٱلنَّاسِ تَهۡوِيٓ إِلَيۡهِمۡ وَٱرۡزُقۡهُم مِّنَ ٱلثَّمَرَٰتِ لَعَلَّهُمۡ يَشۡكُرُونَ[ابراهيم: ٣٥، ٣٧

‘‘আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলেছিলেন: হে আমার প্রতিপালক! এই শহরকে (মক্কাকে) নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে প্রতিমা পূজা হতে দূরে রাখুন। হে আমার প্রতিপালক! এসব প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে আপনিতো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে নিয়ে বসবাস করালাম এই অনুর্বর উপত্যকায় আপনার পবিত্র গৃহের নিকট। হে আমাদের প্রতিপালক! এই জন্যে যে, তরা যেন সালাত কায়েম করে। সুতরাং আপনি কিছু লোকের অন্তর ওদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফলাদি দ্বারা তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।” [সূরা ইবরাহীম ৩৫-৩৭]

৪. আল্লাহ এই নগরকে তাঁর নিজের নিকট এবং তাঁর রাসূলের নিকট প্রিয় করেছেন:

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِمَكَّةَ: «مَا أَطْيَبَكِ مِنْ بَلَدٍ، وَأَحَبَّكِ إِلَيَّ، وَلَوْلَا أَنَّ قَوْمِي أَخْرَجُونِي مِنْكِ مَا سَكَنْتُ غَيْرَكِ»

“ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: মক্কাকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমার চেয়ে অধিক পবিত্র এবং আমার নিকট অধিক প্রিয় আর কোনো নগর নেই, যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত তাহলে তোমাকে ব্যতীত অন্য কোথাও আমি বসবাস করতাম না”। (তিরমিযী: ৩৯২৬)

«وَاللَّهِ إِنَّكِ لَخَيْرُ أَرْضِ اللَّهِ، وَأَحَبُّ أَرْضِ اللَّهِ إِلَى اللَّهِ، وَلَوْلَا أَنِّي أُخْرِجْتُ مِنْكِ مَا خَرَجْتُ»

“আব্দুল্লাহ্ ইবন আদী ইবন আল-হামরা আযযুহরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি তিনি হাযওয়ারা নামক স্থানে তাঁর সাওয়ারীর উপর আরোহণ অবস্থায় বলেছেন: “নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহুর পৃথিবীতে সর্বোত্তম নগরী, এবং আল্লাহর নিকট আল্লাহর পৃথিবীর অধিক প্রিয় ভূমি, যদি আমি তোমার কাছ থেকে বহিষ্কৃত না হতাম তাহলে আমি বের হতাম না”। (তিরমিযী: ৩৯২৫)

৫. নিশ্চয়ই আল্লাহ এই নগরীকে ঈমানের প্রত্যাবর্তন স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন:

«إِنَّ الْإِسْلَامَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا كَمَا بَدَأَ، وَهُوَ يَأْرِزُ بَيْنَ الْمَسْجِدَيْنِ، كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ فِي جُحْرِهَا»

“ইবনে ওমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেছেন: স্বল্প সংখ্যক ও অপরিচিত অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছিল, অচিরেই তা আবার সূচনালগ্নের ন্যায় গরিবী অবস্থায় ফিরে আসবে তা উভয় মসজিদের (মক্কা ও মদীনার) মধ্যবর্তী এলাকায় গুটিয়ে আসবে যেমন সাপ তার গর্তের দিকে গুটিয়ে আসে”। (মুসলিম: ১৪৬)

৬. এই নগরীকে আল্লাহ দাজ্জালের জন্য হারাম করেছেন:

«لَيْسَ مِنْ بَلَدٍ إِلَّا سَيَطَؤُهُ الدَّجَّالُ، إِلَّا مَكَّةَ، وَالمَدِينَةَ، لَيْسَ لَهُ مِنْ نِقَابِهَا نَقْبٌ، إِلَّا عَلَيْهِ المَلاَئِكَةُ صَافِّينَ يَحْرُسُونَهَا، ثُمَّ تَرْجُفُ المَدِينَةُ بِأَهْلِهَا ثَلاَثَ رَجَفَاتٍ، فَيُخْرِجُ اللَّهُ كُلَّ كَافِرٍ وَمُنَافِقٍ»

“আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন: মক্কা এবং মদীনা ব্যতীত এমন কোনো শহর নেই যা দাজ্জাল পদদলিত করবে না, মক্কা ও মদীনার প্রতিটি প্রবেশ পথেই ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে পাহারারত থাকবে। এরপর মদীনা তার অধিবাসীসহ তিন বার প্রকম্পিত হবে আর এভাবে আল্লাহ ওখান থেকে সমস্ত কাফের ও মুনাফেকদেরকে বের করে দিবেন”। (বুখারী: ১৮৮১)

৭. হারামে কোনো অন্যায় বা অপরাধে লিপ্ত হওয়া নিষেধ:

إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ ٱلَّذِي جَعَلۡنَٰهُ لِلنَّاسِ سَوَآءً ٱلۡعَٰكِفُ فِيهِ وَٱلۡبَادِۚ وَمَن يُرِدۡ فِيهِ بِإِلۡحَادِۢ بِظُلۡمٖ نُّذِقۡهُ مِنۡ عَذَابٍ أَلِيمٖ  [الحج: ٢٥

“নিশ্চয় যারা কুফরী করে ও আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং সেই মসজিদে হারাম থেকে বাধা দেয়, যাকে আমি প্রস্তুত করেছি স্থানীয় ও বহিরাগত সকল মানুষের জন্য সমভাবে এবং যে মসজিদে হারামে অন্যায়ভাবে কোনো দীনবিরোধী কাজ করার ইচ্ছা করে, আমি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাব”। [সূরা আল-হাজ্ব-২৫]

«أَبْغَضُ النَّاسِ إِلَى اللَّهِ ثَلاَثَةٌ: مُلْحِدٌ فِي الحَرَمِ، وَمُبْتَغٍ فِي الإِسْلاَمِ سُنَّةَ الجَاهِلِيَّةِ، وَمُطَّلِبُ دَمِ امْرِئٍ بِغَيْرِ حَقٍّ لِيُهَرِيقَ دَمَهُ»

“ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি তিন জন, যে ব্যক্তি হারামের মধ্যে অন্যায় কাজ করে, যে ব্যক্তি মুসলিম হওয়া সত্বেও জাহেলি যুগের রীতি নীতি তালাশ করে এবং যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো রক্তপাত কামনা করে।” (বুখারী: ৬৮৮২)

হারামের মধ্যে অন্যায় কাজ করার অর্থ হল: সর্বপ্রকার অন্যায় চাই তা আল্লাহর অধিকারের ক্ষেত্রে হোক আর মানুষের অধিকারের ক্ষেত্রে।

৮. মাক্কায় হারাম (নিষিদ্ধতাকে) হালাল করতে চাওয়া নিষেধ অনুরূপ সেখানে লড়াই করা, শিকার করা, বৃক্ষ কর্তন করা, হারানো জিনিস উঠিয়ে নেওয়া নিষেধ:

لَمَّا فَتَحَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَكَّةَ قَامَ فِي النَّاسِ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ، ثُمَّ قَالَ: «إِنَّ اللَّهَ حَبَسَ عَنْ مَكَّةَ الفِيلَ، وَسَلَّطَ عَلَيْهَا رَسُولَهُ وَالمُؤْمِنِينَ، فَإِنَّهَا لاَ تَحِلُّ لِأَحَدٍ كَانَ قَبْلِي، وَإِنَّهَا أُحِلَّتْ لِي سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ، وَإِنَّهَا لاَ تَحِلُّ لِأَحَدٍ بَعْدِي، فَلاَ يُنَفَّرُ صَيْدُهَا، وَلاَ يُخْتَلَى شَوْكُهَا، وَلاَ تَحِلُّ سَاقِطَتُهَا إِلَّا لِمُنْشِدٍ، وَمَنْ قُتِلَ لَهُ قَتِيلٌ فَهُوَ بِخَيْرِ النَّظَرَيْنِ، إِمَّا أَنْ يُفْدَى وَإِمَّا أَنْ يُقِيدَ»

“আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন আল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে মক্কা বিজয় করলেন, তখন তিনি মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তাঁর গুণগান করলেন, অতঃপর বললেন: আল্লাহ মক্কা থেকে হস্তিবাহিনীকে প্রতিহত করেছেন, আর সেখানে তাঁর রাসূল এবং মোমেনদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা আমার পূর্বে কারো জন্য হালাল করা হয় নাই, আর তা আমার জন্য দিনের কিছু সময়ের জন্য হালাল করা হয়েছিল, আর তা আমার পরেও অন্য কারো জন্য হালাল করা হবে না। অতএব ওখানকার শিকারসমূহকে তাড়ানো যাবে না, বৃক্ষের কাটা ভাঙ্গা যাবে না, তার হারানো জিনিস উঠানো যাবে না, তবে ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যে তা ঘোষণা করে তার হক দারের নিকট পৌঁছাবে। আর যার কোনো আত্মীয়কে ওখনে হত্যা করা হবে সে দু’টি বিষয়ের মধ্যে কোনো একটি ইখতিয়ার করতে পারবে, হয় রক্তপণ আর না হয় হত্যার বদলে হত্যা। (বুখারী: ২৪৩৪)

উল্লেখিত ফযিলতসমূহ তাঁর অধিবাসী এবং হজ্জ ও উমরার জন্য সেখানে আগমনকারীদের জন্য আবশ্যক করে এই নগরীকে সম্মান করা এবং সর্বপ্রকার অন্যায় ও অপরাধ থেকে সতর্ক থাকা।

প্রথম অধ্যায় : মক্কার সম্মানযোগ্য স্থানসমূহ

মক্কা নগরীকে আল্লাহ তা‘আলা সম্মানিত স্থানসমূহ, বরকতময় অবস্থান, পবিত্র ইবাদত, স্পষ্ট নিদর্শনসমূহের মাধ্যমে বৈশিষ্ট্যময় করেছেন। যা তার মর্যাদা, সম্মান ও ইজ্জতকে বৃদ্ধি করেছে,, কুরআন ও হাদীসে এই বরকতময় স্থানের ফযিলত এবং বিধি-বিধান সম্বলিত ইসলামী দলীলসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং এই স্থানসমূহকে সম্মান করার এবং ওখানে আল্লাহর ইবাদত করার বিধিবদ্ধ নিয়ম ও পদ্ধতিসমূহ স্পষ্ট করা হয়েছে।” এখানে ঐ স্থানসমূহ তার ফযিলতসহ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হল:

১. মসজিদ হারাম :

আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

سَأَلْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ أَوَّلِ مَسْجِدٍ وُضِعَ فِي الْأَرْضِ؟ قَالَ «الْمَسْجِدُ الْحَرَامُ» قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: «الْمَسْجِدُ الْأَقْصَى» قُلْتُ: كَمْ بَيْنَهُمَا؟ قَالَ: «أَرْبَعُونَ عَامًا، ثُمَّ الْأَرْضُ لَكَ مَسْجِدٌ، فَحَيْثُمَا أَدْرَكَتْكَ الصَّلَاةُ فَصَلِّه، فإن الفضل فيه»

“আমি জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূলুল্লাহ্, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে? তিনি বললেন: মসজিদ হারাম, আমি জিজ্ঞেস করলাম এর পর কোনটি? তিনি বললেন: মসজিদ আকসা, আমি জিজ্ঞেস করলাম এই উভয় মসজিদ নির্মাণের মাঝে সময়ের ব্যবধান কি ছিল? তিনি বললেন: চল্লিশ বছর। অতঃপর সালাতের সময়ে তুমি যেখানেই উপস্থিত হবে সেখানেই সালাত আদায় করবে।” (মুসলিম: ৫২০)

অন্য হাদীসে জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلَّا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ وَصَلَاةٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيمَا سِوَاهُ»

“আমার এই মসজিদে সালাত আদায় করা মসজিদ হারাম ব্যতীত অন্য যে কোনো মসজিদে এক হাজার রাকাত সালাত আদায় করার চেয়ে উত্তম, আর মসজিদ হারামে এক রাকা‘আত সালাত আদায় করা (মসজিদ নববী ব্যতীত) অন্য যেকোন মসজিদে এক লক্ষ্য রাকাত সালাত আদায় করার চেয়ে উত্তম। (সুনান ইবন মাজাহ: ১৪০৬)

অধিকাংশ আলেমগণের মতে অতিরিক্ত সাওয়াব শুধু কা‘বা ঘরের চারপাশের মসজিদেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং হারামের সম্পূর্ণ এরিয়াকে তা অন্তর্ভুক্ত করে।

২. কা‘বা:

  • এটা হল আল্লাহর সম্মাণিত ঘর, মুসলিমদের কেবলা, আল্লাহ তাঁর খলীল ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে তা নির্মাণ ও উঁচু করার নির্দেশ দিয়েছেন, আর তিনি এই ঘরকে বিরাট বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যময় করেছেন।
  • আর এই ঘরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন ইসলামের দু’টি রুকনকে; তাহলো সালাত ও হজ্ব। তাই এই ঘরের দিকে মুখ করে না দাঁড়ালে সালাত শুদ্ধ হবে না। এমনিভাবে এই ঘরের ত্বাওয়াফ না করা পর্যন্ত হজ্বকারীর হজ্ব কবুল হবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ وَحَيۡثُ مَا كُنتُمۡ فَوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ شَطۡرَهُۥۗ﴾ [البقرة: ١٤٤]

“অতএব তুমি পবিত্রতম মসজিদের দিকে তোমার মুখমণ্ডল ফিরিয়ে নাও এবং তোমরা যেখানে আছ তোমাদের মুখ সেদিকেই প্রত্যাবর্তিত কর”। [সূরা আল-বাক্বারা: ১৪৪]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ﴾ [ال عمران: ٩٧]

“এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্ব করা সেসব মানুষের অবশ্য কর্তব্য যারা শারিরীক ও আর্থিকভবে ঐ পথ অতিক্রমে সমর্থবান”। [সূরা আলে ইমরান-৯৭]

  • আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে কা‘বা ঘর ব্যতীত অন্য কোনো ঘরের ত্বাওয়াফের নির্দেশ দেন নি, আর তা প্রত্যেক হাজী এবং উমরাকারীর জন্য রুকন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। কা‘বা ঘরের চতুর্পার্শ্বে ত্বাওয়াফ করা ব্যতীত হজ্ব এবং উমরা শুদ্ধ হবে না।
  • আবার হজ্ব ওমরা ছাড়াও শরীয়ত এই ঘরের ত্বাওয়াফের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে এবং এতে বিরাট ফযিলত নির্ধারণ করেছে।

«مَنْ طَافَ سَبْعًا، فَهُوَ كَعِدْلِ رَقَبَةٍ»

“আব্দুল্লাহ্ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি (কাবা ঘর) সাতবার ত্বাওয়াফ করল সে যেন একটি ক্রীতদাস আযাদ করল”। (নাসাঈ: ২৯১৯)

  • এমনিভাবে শরীয়ত প্রত্যেক হাজ্বী সাহেবের জন্য যখন তিনি মক্কা ছেড়ে চলে যেতে চাইবেন তখন তার জন্য কা‘বা ঘরের ত্বাওয়াফকে ওয়াজিব করেছে।
  • অনুরূপভাবে কা‘বা ঘরের চতুর্পার্শ্বে ত্বাওয়াফকারীগণ যখনই চাইবে তখনই ত্বাওয়াফ করার অধিকার রাখে, তাদেরকে ত্বাওয়াফ করা থেকে বাধা দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
  • কা‘বা ঘরের সম্মান ও তাঁর মর্যাদার কথা সুদৃঢ় করতে গিয়ে পায়খানা পেসাবের সময় তা সামনে বা পেছনে রাখা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।

«إِذَا أَتَى أَحَدُكُمُ الغَائِطَ، فَلاَ يَسْتَقْبِلِ القِبْلَةَ وَلاَ يُوَلِّهَا ظَهْرَهُ، شَرِّقُوا أَوْ غَرِّبُوا»

“আবু আইউব আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যখন তোমরা পায়খানা পেসাব খানায় যাবে তখন কেবলাকে সামনে বা পেছনে রাখবে না। বরং পূর্ব বা পশ্চিম দিকে হয়ে বসবে[1]।

  • এমনিভাবে কোনো কোনো হাদীসে কেবলার মর্যাদাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সেদিকে থুতু ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে।

বস্তুত কা‘বা ঘরের সম্মান করতে হবে আল্লাহর দেওয়া বিধানাবলীর অনুসরণের মাধ্যমে যেমন: সেদিকে মুখ করে সালাত আদায় করা, ত্বাওয়াফ করা, তার যে অংশ স্পর্শ করা বিধিসম্মত করা হয়েছে তা স্পর্শ করা, অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ, রুকনুল ইয়ামানী, মুলতাযাম (দরজার) নিকট দো‘আ করা, যার বর্ণনা পরে আসছে।

এতদ্ব্যতীত যা কিছু করা হয় যেমন: কা‘বা ঘরের গিলাফ ধরে থাকা, তা স্পর্শ করা, গিলাফকে বরকতময় মনে করা, এগুলো সবই নিষিদ্ধ সম্মান এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরীকা বিরোধী কাজ।

৩. হাজরে আসওয়াদ :

  • এটি মসজিদ হারামে একটি স্পষ্ট নিদর্শন, একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা প্রমাণ করে যে এটি জান্নাত থেকে আনিত একটি পাথর এবং তা দুধের চেয়েও সাদা ছিল, কিন্তু আদম সন্তানের পাপ এটিকে কালো করে দিয়েছে, তন্মধ্যে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহ আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীস:

«نَزَلَ الحَجَرُ الأَسْوَدُ مِنَ الجَنَّةِ، وَهُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ فَسَوَّدَتْهُ خَطَايَا بَنِي آدَمَ»

“হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, তা দুধের চেয়েও সাদা ছিল কিন্ত আদম সন্তানের পাপ এটিকে কালো করে দিয়েছে”। (তিরমিযী: ৮৭৭)

  • নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজরে আসওয়াদ স্পর্শকারীর সোয়াবের কথা বর্ণনা করেছেন:

يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ، إِنَّكَ تُزَاحِمُ عَلَى الرُّكْنَيْنِ زِحَامًا مَا رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُزَاحِمُ عَلَيْهِ، فَقَالَ: إِنْ أَفْعَلْ، فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ مَسْحَهُمَا كَفَّارَةٌ لِلْخَطَايَا»

ইবনে ওমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল: হে আবু আব্দুর রহমান কি হয়েছে? আপনাকে শুধু এই দু’টি রুকন স্পর্শ করতে দেখি, তিনি বললেন, এ দু’টির স্পর্শে পাপসমূহ ঝরে যায়।”

  • এমনিভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন যে, নিশ্চয়ই হাজরে আসওয়াদ তার স্পর্শকারীর ব্যাপারে সত্য সাক্ষী হবে।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«لَيَأْتِيَنَّ هَذَا الْحَجَرُ، يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَهُ عَيْنَانِ يُبْصِرُ بِهِمَا، وَلِسَانٌ يَنْطِقُ بِهِ، يَشْهَدُ عَلَى مَنْ يَسْتَلِمُهُ بِحَقٍّ»

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: অবশ্যই কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ এই রুকন (হাজরে আসওয়াদ) কে উত্থিত করবেন, তখন তার দু’টি চোখ থাকবে যা দিয়ে সে দেখতে পাবে এবং তার একটি জিহ্বা থাকবে যা দিয়ে সে কথা বলবে, এবং যে ব্যক্তি তা স্পর্শ করেছে তার ব্যাপারে সত্য সাক্ষী দিবে।” [ইবন মাজাহ, ২৯৪৪; মুসনাদে আহমাদ, ২২১৪]

ত্বাওয়াফকারীর জন্য সুন্নাত হল, প্রত্যেক ত্বাওয়াফের সময় শুরুতে হাজরে আসওয়াদ অতিক্রম করার সময় আল্লাহু আকবার বলা, এমনিভাবে তা চুম্বন করাও সুন্নাত যদি তা সম্ভব হয়, অন্যথায় তা হাতদিয়ে ধরে তার উপর হাত ঘুরাবে, অতঃপর স্বীয় হাতে চুম্বন করবে। অথবা তার কিছু অংশ ধরবে এবং যখন তার নিকট পৌঁছবে তখন চুম্বন করবে, আর যদি ধরা বা চুম্বন করা সম্ভব না হয় বা অন্যদেরকে কষ্ট দেওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে সেদিকে ইশারা করবে এবং এই সবগুলোর ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহু আকবার বলবে।

আর তা করবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের অনুসরণের উদ্দেশ্যে এবং এই বিশ্বাস নিয়ে যে এই পাথরটি উপকার বা অপকার করার কোনো ক্ষমতা রাখে না, তাই ওমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু পাথর চুম্বন করার সময় বলেছিলেন:

«إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ، لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ»

“নিশ্চয়ই আমি অবগত আছি যে তুমি অপকারও করতে পার না আবার উপকারও করতে পার না, যদি আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে না দেখতাম যে তিনি তোমাকে চুম্বন করছেন, তাহলে আমিও তোমাকে চুম্বন করতাম না।” (বুখারী, ১৫৯৭; মুসলিম, ১২৭০)

৪. রুকনে ইয়ামানী:

সম্মানিত মক্কার যে সব সম্মানিত স্থান রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘রুকনে ইয়ামানী’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে তা স্পর্শ করতেন এবং তা মাসেহ করতেন। যেমনটি হাদীসে গত হয়েছে যে, ‘‘নিশ্চয়ই রুকনে ইয়ামানী এবং রুকনে আসওয়াদ স্পর্শ করলে পাপসমূহ ঝরে যায়”।

আলেমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন রুকনে ইয়ামানীকে উভয় হাতে কব্জি দিয়ে বা ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করা মুস্তাহাব। আর তা হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের অনুসরণে, তবে চুম্বন করার ব্যপারে অধিকাংশ আলেমগণ তা চুম্বন করা থেকে নিষেধ করেছেন।

হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানীর ফযিলত সম্পর্কে ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন: পৃথিবীতে এক মাত্র হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানী ব্যতীত এমন কোনো স্থান নেই যা স্পর্শ করা এবং চুম্বন করা শরীয়তসম্মত এবং এর মাধ্যমে পাপ পঙ্কিলতা দূর হবে।

৫. হিজর:

আরবী ‘হ’ অক্ষরে যের দিয়ে কা‘বা ঘরের উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত বৃত্তাকার দেয়ালকে বলা হয়, তা রুকনুশ্শামী এবং পশ্চিম পার্শ্বের মাঝে অবস্থিত, তা কা‘বা ঘরেরই একটি অংশ, কুরাইশদের অর্থনৈতিক অনটনের কারণে তারা তা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভিত্তির উপর পরিপূর্ণভাবে ভিত্তিস্থাপন করতে পারে নি। তবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভিত্তিকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। তাই তাকে হিজর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হিজরের পরিমাণের কথাও স্পষ্ট করেছেন,

«إِنَّ قَوْمَكِ اسْتَقْصَرُوا مِنْ بُنْيَانِ الْبَيْتِ، وَلَوْلَا حَدَاثَةُ عَهْدِهِمْ بِالشِّرْكِ، أَعَدْتُ مَا تَرَكُوا مِنْهُ، فَإِنْ بَدَا لِقَوْمِكِ مِنْ بَعْدِي أَنْ يَبْنُوهُ فَهَلُمِّي لِأُرِيَكِ مَا تَرَكُوا مِنْهُ»، فَأَرَاهَا قَرِيبًا مِنْ سَبْعَةِ أَذْرُعٍ

“আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নিশ্চয়ই তোমার বংশধর কা‘বা ঘরের ভিত্তিস্থাপন করতে গিয়ে তা ছোট করে ফেলেছে, তারা যদি এই মাত্র কুফরী পরিত্যাগকারী না করত (নতুন মুসলিম না হতো) তাহলে তারা যা ছেড়েছে তা আমি পুনঃস্থাপন করতাম, যদি আমার পরে তোমার বংশধররা তা পুনঃনির্মাণ করতে চায় তাহলে আস আমি তোমাকে দেখাই যে তারা কতটুকু অংশ বাদ দিয়েছিল, তখন তিনি তাকে সাত গজ জায়গা দেখালেন”। (মুসলিম: ১৩৩৩)

এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, যে ব্যক্তি হিজর (হাতীমে) সালাত আদায় করল সে যেন কা‘বা ঘরের ভিতরে সালাত আদায় করল।

 ৬. মুলতাযাম:

আরবী মীম অক্ষরে পেশ এবং যা অক্ষরে যবর দিয়ে, আর তা হলো হাজারে আসওয়াদ এবং কা‘বা ঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থান, এভাবেই স্থান নির্ধারণ করেছেন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা। তিনি বলেছেন:

«مَا بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْبَابِ الْمُلْتَزَمُ»

“মুলতাযাম হল রুকন (হাজরে আসওয়াদ) এবং দরজার মধ্যবর্তী স্থান।” (মুওয়াত্তা মালিক, ২৫১)

তাকে মোদ‘আ এবং মোতা‘আওয়াযও বলা হয়ে থাকে। (যার অর্থ ডাকার স্থান ও আশ্রয়ের স্থান)

ইমাম নববী রহ. বলেন: বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকন (হাজরে আসওয়াদ) এবং দরজার মধ্যবর্তী স্থানে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, তিনি সেখানে তার বুক, উভয় হাত, উভয় কব্জি প্রশস্ত করে দো‘আ করেছেন, এই হাদীসটি দু’টি দুর্বল বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে, তবে যার ব্যাপারে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি তা করেছেন, তিনি হলেন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা।

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাল্লাহ্ বলেন: যদি কেউ পছন্দ করে যে সে মুলতাযামে, যা হাজরে আসওয়াদ এবং দরজার মাঝে অবস্থিত, সেখানে আসবে এবং ওখানে স্বীয় বুক, মুখ, উভয় হাত, উভয় কব্জি রেখে দো‘আ করবে এবং তার প্রয়োজনীয়তার কথা আল্লাহর নিকট পেশ করবে, বিদায় ত্বাওয়াফের পূর্বে সে তা করতে পারে। কেননা এই নিয়ম মেনে চলা বিদায় ত্বাওয়াফ বা অন্য কোনো সময়ে করার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আর সাহাবীগণ মক্কায় প্রবেশের সময় (ত্বাওয়াফ কুদুমে) তা করতেন।

 ৭.মাকামে ইবরাহীম:

এটি হল ঐ পাথর যার উপর আল্লাহর খলীল ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দাঁড়িয়েছিলেন যখন কা‘বা ঘর ণির্মানের কাজ উপরে উঠছিল এবং নিচ থেকে পাথর নেওয়া তাঁর জন্য কষ্টকর হচ্ছিল, তখন তিনি এর উপর দাঁড়িয়ে কা‘বা ঘর নির্মাণ করছিলেন আর ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তাঁকে পাথর এগিয়ে দিচ্ছিল। এটি ঐ পাথর যার উপর দাঁড়িয়ে তিনি আযান এবং হজ্বের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর কুরআনে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহের মধ্যে মাকামে ইবরাহীমের কথাও উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

[فِيهِ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ مَّقَامُ إِبۡرَٰهِيمَۖ وَمَن دَخَلَهُۥ كَانَ ءَامِنٗاۗ [ال عمران: ٩٧

“তার মধ্যে প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান রয়েছে, মাকামে ইবরাহীম উক্ত নিদর্শনসমূহের অন্যতম। আর যে ওর মধ্যে প্রবেশ করে সে নিরাপত্তা লাভ করবে”। [সূরা আলে ইমরান-৯৭]

ইমাম ত্বাবারী রহ. এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন: নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানব মন্ডলীর জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা ঐ ঘর যা মক্কায় অবস্থিত, ওটা বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য পথ-প্রদর্শক। এর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার স্পষ্ট নিদর্শন এবং তাঁর খলীল ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্মৃতি, তন্মধ্যে রয়েছে পাথরের গায়ে তাঁর খলীল ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পদচিহ্ন যার উপর তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের জন্য আমাদের মধ্যে যারা কা‘বা ঘরের ত্বাওয়াফ করে তাদের জন্য মাকামে ইবরাহীমকে মোসাল্লা (সালাতের স্থান) হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ عُمَرُ بْنُ الخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، ” وَافَقْتُ رَبِّي فِي ثَلاَثٍ: فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، لَوِ اتَّخَذْنَا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى، فَنَزَلَتْ: {وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى} [البقرة: 125]

“আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ওমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমি বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা আমাদেরও রবের খলীলের মাকাম (স্থান) আমরা কী এটাকে (মাকামে ইবরাহীমকে) মোসাল্লা (সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ) করবনা? তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন: {এবং তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর। [সূরা আল-বাকারা: ১২৫]}”। (বুখারী: ৪০২)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাকামে ইবরাহীমের পিছনে সালাত আদায় করেছেন, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হজ্বের পদ্ধতি বর্ণনায় জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

«ثُمَّ نَفَذَ إِلَى مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِ السَّلَام، فَقَرَأَ: {وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى} [البقرة: 125] فَجَعَلَ الْمَقَامَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْبَيْتِ»

তারপর তিনি মাকামে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে গেলেন এবং {وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى} [البقرة: 125] ‘আর তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে মুসাল্লা বা সালাতের স্থান বানাও’ [সূরা আল-বাকারাহ: ১২৫] এটা পড়লেন আর বাইতুল্লাহ ও মাকামে ইবরাহীমকে সামনে রেখে সালাত আদায় করলেন”। (মুসলিম: ১২১৮)

তবে মাকামে ইবরাহীমকে চুম্বন বা স্পর্শ করা যাবে না কেননা তা বিদ‘আত।

ইবনে তাইমিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “সুন্নাতের আলোকে আলেমগণ একমত হয়েছেন যে, মাকামে ইবরাহীমকে স্পর্শ করা বা চুম্বন করা বিধিসম্মত নয়।”

ইবনুল কাইয়্যেম যাদুল মা‘আদে বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বা ঘরের ত্বাওয়াফ করতে গিয়ে সাত চক্কর দিলেন, এরমধ্যে তিন চক্করে রমল (দ্রুত হাটলেন) এবং চার চক্করে স্বাভাবিকভাবে হাটলেন, অতঃপর মাকামে ইবরাহীমের পেছনে দুই রাকাত সালাত আদায় করলেন অতঃপর তেলাওয়াত করলেন {وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى} [البقرة: 125] এবং তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর” এই আয়াত তেলওয়াত করার তিনি স্বীয় স্বর উঁচু করলেন মানুষ তা শোনতে পেল।

তাই ত্বাওয়াফের পর মাকামে ইবরাহীমের পেছনে সালাত আদায় করা পছন্দনীয় সুন্নাত, যার পক্ষে তা আদায় করা সম্ভব হয়। অতএব মাকামে ইবরাহীমের বিধি সম্মত সম্মান করা হল তার পেছনে সালাত আদায় করা, যেমন করেছেন সৃষ্টির সরদার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর নিষিদ্ধ এবং বিদ‘আতী সম্মান করা হল তা স্পর্শ করা এবং চুম্বন করা। সালফে সালেহীনগণ তা থেকে নিষেধ করেছেন।

ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একদল লোকের নিকট আসলেন যারা মাকামে ইবরাহীমকে স্পর্শ করত, অতঃপর তিনি বললেন: তোমরা তা স্পর্শ করতে নির্দেশিত হও নি, বরং তোমরা নির্দেশিত হয়েছ তার নিকট সালাত আদায় করতে।

ইবনে জুরাইজ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি ‘আতাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, তুমি কি কাউকে দেখেছ যে, সে মাকামে ইবরাহীমকে চুম্বন করে বা স্পর্শ করে? সে বলল: গ্রহণযোগ্য কাউকে দেখি নি।

কাতাদা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “এবং তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর।” মূলত এই আয়াত দ্বারা তারা নির্দেশিত হয়েছে, মাকামে ইবরাহীমের নিকট সালাত আদায় করার জন্য, তা স্পর্শ করার জন্য নির্দেশিত হয় নি। নিশ্চয়ই এই উম্মত তা করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছে যা করার জন্য পূর্ববর্তী উম্মত দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল।

৮. যমযম:

যমযম প্রসিদ্ধ বরকতময় কুয়া। যা মসজিদে হারামে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরের পূর্বে ও মাকামে ইবরাহীমের দক্ষিণে অবস্থিত। এ পানি বের হওয়ার ঘটনা প্রসিদ্ধ এবং তার ফযিলত সম্পর্কেও মানুষ অবগত। আল্লাহ এ পানির এমন অনেক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন, যা দ্বারা সকল পানির উপর তার গুরুত্ব ও ফজিলত প্রমাণিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো:

(ক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ ইসরা ও মিরাজের ঘটনার পূর্বে এ পানি দ্বারা ধৌত করণ। (সহীহ বুখারী: ২/৪৯২)

(খ) শরীয়ত ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পানি এই যমযম। ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যমীনের উপরি ভাগের সর্বোত্তম পানি হল যমযমের পানি।” (তাবরানী: ১১/৯৮, মুনজেরীর তারগীব ও তারহীব: ২/২০৯)

(গ) খাদ্যের ন্যায় পানকারীকে পরিতৃপ্ত করে। সহীহ মুসলিমে বর্নিত হয়েছেন,

আব্দুল্লাহ ইবন সামেত আবূ যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর বর্ণনা করেন। তাতে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ যরকে বলেন: কখন থেকে এখানে রয়েছ? আবূ যর বলেন: আমি বললাম: ৩০ দিবা-রাত এখানে রয়েছি। তিনি বলেন: তোমার খাবার কি ছিল? আবূ যর বলেন: আমি বললাম: আমার যমযম পানি ব্যতীত আর কিছু ছিল না। পরিশেষে এমন মোটা হয়ে গেলাম যে পেটের চামড়া ভাজ হয়ে গেল। কলিজায় ক্ষুধার লেশমাত্র পেতাম না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: নিশ্চয়ই এ পানি বরকতময় নিশ্চয়ই তা খাদ্যের খাদ্য। (মুসলিম: ৪/১৯১৯)

ইবনুল আসীর বলেন: ‘‘অর্থাৎ: মানুষ যখন এপানি পান করবে তখন সে পরিতৃপ্ত হবে, যেমন খাবার গ্রহণকরে পরিতৃপ্ত হয়। (আন নেহায়া: ৩/১২৫), যাদুল মায়াদে ইমাম ইবনে কায়্যিম (রহিমাহুল্লাহর বাণী দ্র:)।

(ঘ) নিশ্চয়ই আল্লাহর হকুমে যমযম পানি হল রোগের আরোগ্য লাভের উপকরণ। যেমন: ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন: ‘‘যমীনের বুকে সর্বোত্তম পানি হল যমযমের পানি, তার মধ্যে রয়েছে খাদ্যের উপকরণ ও পীড়িতদের জন্য রয়েছে আরোগ্যের উপরকণ।” আল্লাহ তা‘আলা এ বরকতের পানিকে রক্ষা করেছেন। এটি আল্লাহর মহত্বের একটি স্পষ্ট প্রমাণ বা নিদর্শন । সুতরাং তা শতাব্দির পর শতাব্দিতেও বিলুপ্ত হয় নি। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে তা পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাতে তার স্বচ্ছতা-বিশুদ্ধতা ও যাবতীয় দোষ ও মিশ্রণ হতে মুক্ত প্রমাণ হয়। (দেখুন: ইঞ্জিনিয়ার ইয়াহইয়াহ প্রণীত যমযম খাদ্য ও আরোগ্য: ১০৯ পৃষ্টা)

৯. সাফা-মারওয়া: কা‘বার পূর্বে মক্কার দু’টি পাহাড়ের নাম হল সাফা ও মারওয়া। হজ্ব ও উমরার সময় উভয় পাহাড়ের মাঝে সা‘ঈ করা হয়, যা তার রুকনের অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ ۞إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ فَمَنۡ حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ وَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَإِنَّ ٱللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ ١٥٨ ﴾ [البقرة: ١٥٨]

“‘নিশ্চয় ‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্গত, অতএব যে ব্যক্তি এই গৃহের ‘হজ্ব’অথবা ‘উমরা’করে তার জন্যে এতদুভয়ের প্রদক্ষিণ করা দোষনীয় নয়, এবং কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সৎকর্ম করলে আল্লাহ গুণগ্রাহী, সর্বজ্ঞাত”। (সূরা আল-বাকারা: ১৫৮)

ইমাম তাবারী রহ. আল্লাহর বাণী :

﴿ ۞إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ﴾ [البقرة: ١٥٨]

এর তাফসীরে বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হল যে, তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সাফা ও মারওয়াকে এমন একটি নিদর্শন ও ঐতিহ্যের প্রতীক বানিয়েছেন যে, তারা এর নিকট দো‘আ, যিকির বা সেখানে যে আমল তাদের জন্য ফরয করা হয়েছে তা পালনের মাধ্যমে তাঁর ইবাদত পূর্ণ করে থাকে। (তাফসীর তাবারী: ২/৭১০)

তার সম্মান মূলত: আল্লাহ তা‘আলা যে উভয়ের মাঝে সা‘ঈ করার বিধান প্রযোজ্য করেছেন তার মধ্যেই। পক্ষান্তরে উভয় পাহাড়কে স্পর্শ করা শরীয়তসম্মত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকা বিরোধী হওয়ার কারণে।

১০. মিনা, আরাফাত ও মুযদালিফা:

এ তিনটি স্থান হল সম্মানিত স্থান ও পবিত্র নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। হজ্বে যার অভিমুখী হতে হয় ও কতিপয় বিধান সেখানে পালন করতে হয়।

মিনা: শুধু হজের দিনগুলোতে সেখানের সংশ্লিষ্ট আমলগুলি আদায় করা হয়। যেমন: রাত্রি যাপন, পাথর নিক্ষেপ ও পশু যবাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿۞وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖۚ فَمَن تَعَجَّلَ فِي يَوۡمَيۡنِ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِ وَمَن تَأَخَّرَ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِۖ لِمَنِ ٱتَّقَىٰۗ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ إِلَيۡهِ تُحۡشَرُونَ ٢٠٣﴾ [البقرة: ٢٠٣]

‘‘এবং নির্ধারিত (তাশরীকের) দিবসসমূহে আল্লাহর বিশেষ) যিকির কর: অতঃপর কেউ যদি দু’দিনের মধ্যে (মক্কায় ফিরে যেতে) তাড়াতাড়ি করে তবে তার জন্যে কোনো পাপ নেই, পক্ষান্তরে কেউ যদি বিলম্ব করে তবে তার জন্যেও পাপ নেই এমনটি মুত্তাকীর জন্য এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর ও জেনে রেখো যে, অবশ্যই তোমাদের সকলকে তাঁরই নিকট সমবেত করা হবে।” [সূরা আল-বাকারা:২০৩]

       মিনা নামকরণ: এজন্যই মিনা বলা হয় যে, সেখানে রক্ত প্রবাহিত করা হয়।

       সীমানা: আকাবা হতে ওয়াদী মুহাসসার পর্যন্ত বিস্তৃত। (দেখুন: মু‘জামুল বুলদান: ৫/১৯৮-১৯৯ পৃষ্ঠা)

       আরাফাত: দো‘আ ও যিকিরের জন্য যিলহজ্ব মাসের নবম তারিখ আরাফা দিবসেই শুধু সেখানে যেতে হয়। ‘‘ইলাল” (ইলাল নামটি এ পাহাড়ের বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নাম। আর ‘‘জাবালে রহমত” নামকরণটি আসলে ভুল। দেখুন: আল্লামা বকর আবূ যায়েদ প্রণীত: ‘‘তাহকীকাত শরয়িয়্যাহ ওয়া তারীখিয়্যাহ: ১৬-২৯ পৃষ্টা) পাহাড়ের পাথরগুলির পাদদেশে সম্ভব হলে হাজী সাহেবানগণ অবস্থান করবেন, তা না হলে সমস্ত আরাফাই অবস্থান স্থল। যেমনভাবে অনেক হাজী পাহাড়টিতে আরোহণ করে থাকে, তার কোনো বিধিবদ্ধতা নেই। পাহাড় স্পর্শ করা বা তার বরকত গ্রহণ করাও শরীয়তসম্মত নয়। আরাফাতের বর্ণনা আল্লাহ তা‘আলার নিম্নের বাণীতে হয়েছে:

﴿لَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ جُنَاحٌ أَن تَبۡتَغُواْ فَضۡلٗا مِّن رَّبِّكُمۡۚ فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ وَٱذۡكُرُوهُ كَمَا هَدَىٰكُمۡ وَإِن كُنتُم مِّن قَبۡلِهِۦ لَمِنَ ٱلضَّآلِّينَ ١٩٨﴾ [البقرة: ١٩٨]

“তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের অনুগ্রহ লভের চেষ্টা করলে তাতে তোমাদের পক্ষে কোনো অপরাধ নেই; অতঃপর যখন তোমরা আরাফাত হতে প্রত্যাবর্তিত হও তখন পবিত্র (মাশয়ারে হারাম) স্মৃতি-স্থানের নিকট আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যেরূপ নির্দেশ দিয়েছেন তদ্রূপ তাঁকে স্মরণ করো এবং নিশ্চয় তোমরা এর পূর্বে বিভ্রান্তদের অন্তর্গত ছিলে।” [সূরা আল-বাকারা: ১৯৮]

ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ আয়েশারাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: কুরাইশ ও যারা তাদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত ছিল, মুযদালিফায় তারা অবস্থান নিত ও তার নামকরণ করেছিল ‘‘আলহুমুস” এবং সমস্ত আরব ‘আরাফায় অবস্থান করত। অতঃপর যখন ইসলামের আগমন ঘটল, তখন আল্লাহ্ তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুকুম করলেন: ‘আরাফায় এসে অবস্থান নেওয়ার জন্য। এরপর সেখান থেকে প্রস্থান করার জন্য। তার বর্ণনা যেমন: আল্লাহর বাণীতে এসেছে:

﴿ثُمَّ أَفِيضُواْ مِنۡ حَيۡثُ أَفَاضَ ٱلنَّاسُ وَٱسۡتَغۡفِرُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ١٩٩﴾ [البقرة: ١٩٩]

“অতঃপর যেখান থেকে লোক প্রত্যাবর্তন করে, তোমরাও সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন কর এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর; নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।” [সূরা আল-বাকারা: ১৯৯, বুখারী: ৮/১৮৬]

       মুযদালিফা: আরাফা হতে প্রত্যাবর্তন কুরবানীর পূর্বের রাতে সেখানের মাশ‘য়ারে হারামে রাত্রি যাপন এবং আল্লাহর যিকির ও দো‘আর উদ্দেশ্যে আগমন করা হয়। মুযদালিফার মাঝামাঝি এখানে একটি পাহাড় ছিল যা বর্তমান যুগে প্রশস্ততার প্রয়োজনে বিলুপ্ত করে সেখানে মসিজিদ বানান হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿لَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ جُنَاحٌ أَن تَبۡتَغُواْ فَضۡلٗا مِّن رَّبِّكُمۡۚ فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ وَٱذۡكُرُوهُ كَمَا هَدَىٰكُمۡ وَإِن كُنتُم مِّن قَبۡلِهِۦ لَمِنَ ٱلضَّآلِّينَ ١٩٨﴾ [البقرة: ١٩٨]

“তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করলে তাতে তোমাদের পক্ষে কোনো অপরাধ নেই; অতঃপর যখন তোমরা আরাফাত হতে প্রত্যাবর্তিত হও তখন পবিত্র (মাশ‘য়ারে হারাম) স্মৃতি-স্থানের নিকট আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যেরূপ নির্দেশ দিয়েছেন তদ্রূপ তাঁকে স্মরণ করো এবং নিশ্চয় তোমরা এর পূর্বে বিভ্রান্তদের অন্তর্গত ছিলে।” [সূরা আল-বাকারা: ১৯৮]

       সীমানা: মুযদালিফার সীমানা ওয়াদী মুহাসসার হতে শুরু করে মা’যিমা ই আরাফার মাঝামাঝি। অবশ্য এর দু’সীমা মুযদালিফার অন্তর্ভুক্ত নয়; তবে মুযদালিফা সম্পূর্ণটাই হারামের অন্তর্ভুক্ত।” (মু‘জামুল বুলদান: ৫/১৯৮)

উক্ত তিনটি স্থানের বর্ণনা বিভিন্ন সহীহ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী: “আরাফার সম্পূর্ণটিই অবস্থান স্থল, মিনার সম্পূর্ণটাই যবাইর স্থান, সম্পূর্ণ মুযদালিফা অবস্থান স্থল ও মক্কার সম্পূর্ণ রাস্তাই যবাইর স্থান। (আবু দাঊদ: ১৯৩৬, ইবনে মাজাহ: ৩০৪৮)

এই তিনটি স্থানের ফযিলত ও এগুলিকে আল্লাহর শরীয়ত মোতাবেক ইবাদতের জন্য খাস করা শরীয়তের সঠিক দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত। এগুলি দো‘আ কবূলের উপযুক্ত স্থান।

ইমাম শাওকানী (রহ.) এসব দো‘আর ফযিলত সম্পর্কে বলেন: ‘‘এসব বরকতময় স্থানের অতিরিক্ত কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সেই সব স্থানের সম্মান ও বরকত থাকার কারণে। আর তার বরকতে ধন্য হবেন যাঁরা তার মধ্যে যথাবিহিত আমল করবেন। আল্লাহ তায়ালার রয়েছে অফুরন্ত অনুগ্রহ ও মহা অবদান। যেমন একটি হাদীসে এসেছে: তাঁরা এমন জাতি যে, তাঁদের সাথে অবস্থানকারীও বঞ্চিত হয় না। অর্থাৎ ঐ জাতির সাথে অবস্থানকারীদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, অথচ তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বরং সেখানে অবস্থানকারীদের বরকত তাদের দিকে এসে পড়েছে যদিও তারা এদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সুতরাং এটি কোনো দূরের বিষয় নয় যে বরকতের স্থানগুলি এমন হতে পারে: যার ফলে ওখানে আল্লাহকে আহ্বানকারী আল্লাহ প্রদত্ত সেখানের বরকতের অন্তর্ভুক্ত হবে; যে কারণে সে এক্ষেত্রে তার দো‘আ কবূল না হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।” (শাওকানীর তুহফাতুয যাকেরীন: ৪৪ পৃষ্ঠা)

এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয়ে সতর্কতা জরুরী:

       প্রথমত: নিশ্চয়ই যে ফজিলতপূর্ণ স্থানের ব্যাপারে আলোচনা ইতোপূর্বে করা হলো সেখানে স্বয়ং যে মূল ইবাদত শরীয়তে দলীল ভিত্তিক ও যে পদ্ধতির তা ব্যতীত আল্লাহর অন্য কোনো ইবাদত করা উচিত হবে না। যেমন: কাবার পার্শ্বে অবস্থিত মাকামে ইবরাহীমের নিকটে তাওয়াফের পর দুই রাক‘আত সালাত আদায় করা; যার প্রথম রাক‘আতে সূরা ফাতেহা ও সূরা কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা ফাতেহা ও সূরা ইখলাস পড়া।         এখানে ইবাদতের মূল হলো দুই রাক‘আত সালাত আদায়। সুতরাং মাকামে ইবরাহীম স্পর্শ করা, চুম্বন করা ও তা দ্বারা বরকত অর্জন করা যাবে না। তা এ অর্থে যে, সেখানের স্বয়ং যে মূল ইবাদত বর্ণিত হয়েছে তা ব্যতীত সেখানে আল্লাহর জন্য আর কোনো প্রকার ইবাদত করা যাবে না।

ইতোপূর্বে সালাফে সালেহীনের মাকামে ইবরাহীম স্পর্শ ও তা চুম্বন করার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে কতিপয় উক্তি অতিবাহিত হয়েছে। অনুরূপ সেখানে স্বয়ং যে পদ্ধতির ইবাদত পাওয়া যায় তা হলো তাওয়াফের পর দুই রাক‘আত সালাত আদায় করা। যার প্রথম রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও সূরা কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও সূরা ইখলাস পড়া।

অতএব এভাবে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই স্বয়ং আসল ইবাদত ও স্বয়ং সে পদ্ধতিটিই অবলম্বন করা জরুরী।

স্থানগুলির ব্যাপারে সালাফে সালেহীন এমন নীতিই বাস্তবায়ন করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আমল করেছেন তাঁরাও তা করেছেন এবং যে আমল তিনি বর্জন করেছেন, তাঁরাও তা বর্জন করেছেন।

       উক্ত নীতির দৃষ্টান্ত: বর্ণিত আছে ইবনে আব্বাস ও মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এক সাথে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছিলেন। এ সময় মু‘আবিয়া কাবার চার কর্ণারই স্পর্শ করছিলেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বললেন: নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) ও তার পূর্বের কর্ণার রুকণে ইয়ামানী ব্যতীত অন্য কর্ণার স্পর্শ করেন নি। মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: বায়তুল্লাহর কোনো অংশই পরিতাজ্য নয়। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম বললেন: অবশ্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তারপর মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু স্বীয় মত পরিবর্তন করেন। (তিরমিযী: ৩/২১৩, ইমাম তিরমিযী বলেন: হাসান সহীহ)

       দ্বিতীয়ত: নিশ্চয়ই এ ফজিলতপূর্ণ স্থানগুলি বিশেষ কতিপয় ইবাদতের জন্যই নির্ধারিত। অতএব এর উপর কিয়াস-অনুমান করে অন্যান্য ইবাদত করা যায় না।

ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘‘মক্কার নিদর্শনাবলীর (মাশায়েরে হারামে) বিশেষ স্থানগুলি বিশেষ বিশেষ ইবাদতের জন্য নির্ধারিত। তার সাথে অন্যান্য সকল স্থানকে সে সব ইবাদতে যুক্ত করা যাবে না। যেমন: বায়তুল্লাহ তাওয়াফের জন্য নির্ধারিত। সুতরাং সে সব স্থান যার জন্য ও বিধিবদ্ধ সে ক্ষেত্রে একটির কিয়াস অন্যটির উপর চলবে না।” (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম: ২০/৮০৯-৮১০)

অতএব আল্লাহ যা প্রবর্তন করেন নি তা কারো জন্য প্রবর্তন করা জায়েয নয়। যেমন: কেউ যদি বলে আমি কাবার সাত তাওয়াফের মত কোনো পাথরের চারি পার্শ্বে সাত তাওয়াফ মুস্তাহাব মনে করি বা মাকামে ইবরাহীমকে মুসাল্লা বানাতে চাই এবং এ জাতীয় অন্য কিছু, তবে তার জন্যে তা জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যে জিনিস যে কর্ম, যে বিধি-বিধানের সাথে নির্ধারণ করেছেন, তার সাথে অন্যকে কিয়াস করা নাজায়েয। যার সাথে যা কিছু নির্ধারণ করা হয়েছে তা অন্যের মধ্যে বিরাজমান না থাকার কারণে হতে পারে, যা অধিকাংশ আলেমের মত অথবা নিছক তা যেহেতু নির্ধারণ করে দিয়েছে তার জন্যই, যা কতিপয় আলেমের মত। যেমন: কাবা হজ্ব ও তাওয়াফের জন্য খাস, অনুরূপ আরাফা অবস্থানের জন্য, মিনা পাথর নিক্ষেপের জন্য, চার হারামের মাস তার বিশেষ মর্যাদার জন্য, রমজানের মাস রোযা ও তারাবীহর জন্য এবং এছাড়াও অন্যান্য বিষয়। (মাজমু‘ ফাতোয়া: ৪/৪৮২)

দ্বিতীয় অধ্যায়

ঐ সমস্ত স্থান যা সম্মান করার ব্যাপারে শরীয়তে কোনো বিশেষ বৈশিষ্টের কথা প্রমাণিত নয়

কিছু কিছু ঐতিহাসিক এবং লিখকগণ মক্কা মুকাররামার ফযিলত এবং হজ্ব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এমন কিছু কিছু স্থান ও জায়গার কথা উল্লেখ করেছেন, যা হজ্ব আদায়কারী এবং যিয়ারতকারীদের জন্য বরকত লাভের উদ্দেশ্যে যিয়ারত করা এবং সেখানে আল্লাহর ইবাদতের কথা বলেছেন, যা নবী জীবনীর উপর লেখা গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ হয়েছে। সেখানে কোথাও এসেছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুক স্থানে বসেছেন বা সালাত আদায় করেছেন ইত্যাদি। আবার কিছু মক্কার ইতিহাস লিখকগণ তাদের বিশাল ভলিয়মের গ্রন্থাবলীতে তা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ সমস্ত স্থানসমূহকে কোনো ইবাদতের জন্য নির্ধারিত করার ব্যাপারে শরীয়াতের নিষেধকারী দলীলসমূহ উল্লেখ করার আগে দু’টি বিষয়ের মাঝে পার্থক্য উল্লেখ করা জরুরী:

       ১ম: যে কোনো স্থান বা জায়গা যেখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতসমূহের মধ্যে কোনো একটি ইবাদতের উদ্দেশ্যে গমন করেছেন। অবশ্যই (উম্মতের জন্য) ঐ স্থানে যাওয়া এবং তা অন্বেষণ করা বৈধ, আর তা হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ এবং সোয়াব ও প্রতিদানের আশায়। ইতোপূর্বে ঐ সমস্ত বরকতময় স্থান এবং তা সম্মান করার দলীল উল্লেখ করা হয়েছে, এর মধ্যে কোনো মতভেদ নেই।

       ২য়: যে কোনো স্থানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ইবাদত বা অন্য কোনো কিছু করেছেন, কিন্তু ঐ স্থানকে বিশেষভাবে উদ্দেশ্য করে নয় এবং ইচ্ছা করেও নয় (বরং ইবাদত বা কাজের সময় হয়েছে তাই তিনি তা এখানে করেছেন)। এ ধরণের স্থানে কোনো ইবাদত করা বা তা অন্বেষণ করা বিধিসম্মত নয়।

এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত হিসেবে যা কিছু করেছেন তা ইবাদত গণ্য হবে এবং সেক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করা বিধি সম্মত, আর যদি তিনি কোনো স্থান বা সময়কে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করে থাকেন তাহলে সে সময় বা স্থানকে ঐ ইবাদতের জন্য নির্ধারিত করা সুন্নাত।

অতএব সম্মানযোগ্য স্থানসমূহ হলো তা যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের উদ্দেশ্যে গমন করেছেন এবং শরীয়তের দলীলসমূহ সে বিষয়ে স্পষ্ট রয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনো মতবিরোধ নেই। কিন্তু মক্কা মুকাররামার কিছু কিছু স্থানকে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করা যা নির্ধারণ করার কথা প্রমাণিত নয় সেখানে ইবাদতের জন্য যাওয়া বৈধ নয়।

সংক্ষিপ্তভাবে এ সমস্ত স্থানসমূহেকে সম্মান করা নিষিদ্ধকরণের দলীলসমূহ:

১. ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হল নির্দেশমূলক কোনো দলীল না পাওয়া পর্যন্ত ইবাদত করা নিষিদ্ধ। তা এ জন্য যে, দ্বীনের হাকীকত পরিস্ফুটিত হয় দু’টি নীতির মাধ্যমে। তার একটি হল: একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে, অপরটি হল: একমাত্র তাঁর নির্ধারিত বিধান মোতাবেক তাঁর ইবাদত করতে হবে।

অতএব সালাত, দো‘আ, যিকির অনুরূপ নৈকট্য এবং বরকত লাভের উদ্দেশ্যে এই সমস্ত স্থানসমূহে গমন করা ইবাদতের প্রকারসমূহের অন্তর্ভুক্ত। অথচ কুরআন ও হাদীসে এমন কোনো দলীল নেই যা তা জায়েয হওয়ার কথা প্রমাণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ﴾ [الشورى: ٢١]

“তাদের কি এমন কতগুলো দেবতা আছে যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন কিছু বিধান প্রবর্তন করেছে যার অনুমতি আল্লাহ দেন নি”? [সূরা আশ-শুরা-২১]

       ২. সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক এ সমস্ত স্থানসমূহকে ইবাদত বা বরকত লাভের স্থান হিসেবে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা, অথচ তারা ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের ক্ষেত্রে এই উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক আগ্রহী। আর তারাও এই সমস্ত স্থানসমূহ সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি তাদের অধিক ভালোবাসা সুসাব্যস্ত বিষয়।

অতএব ইবাদতসমূহের মধ্যে প্রতিটি ইবাদত যা সালফে সালেহীনগণ পরিত্যাগ করেছেন, (পরবর্তীতে) তা পালন করা বিদ‘আত, অবশ্য তা এই শর্তে যে এই ইবাদতটি করার চাহিদা বিদ্যমান ছিল আর তা করতে কোনো বাধা বিপত্তি ছিল না।

হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

“كل عبادة لم يتعبدها أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم؛ فلا تتعبدها؛ فإن الأول لم يدع للآخر مقال فاتقوا يا معشر القراء! وخذوا بطريق من كان قبلكم”

“যে সমস্ত ইবাদত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবাগণ করেন নি তা তোমরা ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করবে না, কেননা পূর্ববর্তীগণ পরবর্তীদের জন্য ইবাদত হিসেবে কোনো কথা বাদ রেখে যান নাই। সুতরাং হে শিক্ষার্থীরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রাস্তা অবলম্বন কর।” (তারতুসী, হাওয়াদিস ওয়াল বিদা‘, ১৪৯)

৩. এ ধরণের সম্মানকে সালফে সালেহীন তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বলে জানিয়েছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন, তাদের মধে সর্বাগ্রে ছিলেন ফারুক ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। তিনি তাঁর কথার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন:

عَنِ الْمَعْرُورِ بْنِ سُوَيْدٍ , قَالَ: ” خَرَجْنَا حُجَّاجًا مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ , فَعَرَضَ لَنَا فِي بَعْضِ الطَّرِيقِ مَسْجِدٌ , فَابْتَدَرَهُ النَّاسُ يُصَلُّونَ فِيهِ , فَقَالَ عُمَرُ: مَا شَأْنُهُمْ؟ فَقَالُوا: هَذَا مَسْجِدٌ صَلَّى فِيهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , [ص:88] فَقَالَ عُمَرُ: «أَيُّهَا النَّاسُ , إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ باتِّبَاعِهِمْ مِثْلَ هَذَا , حَتَّى أَحْدَثُوهَا بِيَعًا , فَمَنْ عَرَضَتْ لَهُ فِيهِ صَلَاةٌ فَلْيُصَلِّ , وَمَنْ لَمْ تَعْرِضْ لَهُ فِيهِ صَلَاةٌ فَلْيَمْضِ»

“মা‘রুর ইবন সুওয়াইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা আমরা উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে বের হলাম, পথিমধ্যে আমরা একটি মসজিদ পেলাম, মানুষ সেখানে সালাত আদায়ের জন্য দ্রুত ছুটে গেল, ওমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জিজ্ঞেস করলেন তাদের কী হয়েছে? তারা বলল: এই মসজিদটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায় করেছিলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: হে মানবমন্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এধরনের অনুসরণের কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছিল, এমনকি তারা এগুলো নিয়ে উপাসনালয়ও আবিষ্কার করেছিল; বরং যে সালাতের সময়ে এ সমস্ত স্থানে উপস্থিত হবে সে এখানে সালাত আদায় করবে আর যদি সালাতের সময়ে এই সমস্ত স্থানে উপস্থিত না হয় তাহলে রাস্তা অতিক্রম করে চলে যাবে। (ইবন ওয়াদ্দাহ, আল-বিদা‘: ১০১)

কাজের মাধ্যমে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর প্রতিবাদ:

অপর এক ঘটনায় ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে তিনি জানতে পারলেন,

«أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ بِقَطْعِ الشَّجَرَةِ الَّتِي بُويِعَ تَحْتَهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , فَقَطَعَهَا لِأَنَّ النَّاسَ كَانُوا يَذْهَبُونَ فَيُصَلُّونَ تَحْتَهَا , فَخَافَ عَلَيْهِمُ الْفِتْنَةَ»

“যে কিছু মানুষ ঐ বৃক্ষের নিকট আসে যে বৃক্ষের নিচে সাহাবাগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত করেছিল, তখন তিনি নির্দেশ দিলেন যেন এই বৃক্ষ কেটে ফেলা হয় তখন তা কেটে দেয়া হল”। (প্রাগুক্ত)

এ হল উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কথা এবং কাজ যার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ اللَّهَ جَعَلَ الحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ وَقَلْبِهِ»

“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা উমারের যবানে এবং অন্তরে সত্যকে ঢেলে দিয়েছেন”। (তিরমিযী, ৩৬৮২)

ইমাম ইবন ওদ্যাহ আল-কুরতুবী এই দু’টি ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেছেন: মালেক ইবন আনাস এবং মদীনার অন্যান্য আলেম এ সমস্ত মসজিদ এবং মদীনার মসজিদ কোবা এবং উহুদ ব্যতীত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহে আগমন করাকে অপছন্দ করতেন। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯)

৪. নিশ্চয়ই সাহাবীগণ রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বাইয়াতে রিদওয়ান করেছিলেন, যার কথা আল্লাহ্ কুরআনে উল্লেখ করেছেন, তখন তাদের সংখ্যা ছিল ১৪০০, পরের বছর যখন তারা এসেছিলেন তখন তাদের কেউ সেই স্থানটি সম্পর্কে কিছু জানত না, ঐ স্থানটি নির্ধারণে তাদের মধ্যে কোনো দু’জন সাহাবী একমতও হয় নি; বরং ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যার কাজকে কিছু মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহকে বরকতময় বলে মনে করার ক্ষেত্রে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে থাকে, তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে এই বৃক্ষের স্থানটি নির্ধারিত নেই, আর এটি তাদের কাছ থেকে গোপন রাখা আল্লাহর একটি দয়া।

ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:

قَالَ ابْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا: «رَجَعْنَا مِنَ العَامِ المُقْبِلِ فَمَا اجْتَمَعَ مِنَّا اثْنَانِ عَلَى الشَّجَرَةِ الَّتِي بَايَعْنَا تَحْتَهَا، كَانَتْ رَحْمَةً مِنَ اللَّهِ»

“পরের বছর আমরা আসলাম তখন আমাদের মধ্যে কোনো দু’জন ঐ বৃক্ষের নিচে একত্রিত হয় নি যে বৃক্ষের নিচে আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বাইয়াত করেছিলাম। আর তা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া।” (বুখারী, ২৯৫৮)

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেছেন: মাগাযী (যুদ্ধ) অধ্যায়ে আসবে যে, সাঈদের পিতা মুসায়্যিব ইবনে হুযন বৃক্ষের স্থানটি গোপন রাখার বিষয়ে ইবনে উমারকে তার সমর্থনের কথা এবং এর মধ্যে কি হিকমত রয়েছে তার বর্ণনা। আর তাহলো যে ঐ বৃক্ষের নিচে যে কল্যাণকর ঘটনা ঘটেছিল তা নিয়ে যেন কোনো ফেতনা না হয়, যদি বৃক্ষটিকে রেখে দেওয়া হত তাহলে অজ্ঞ লোকদের সম্মান করা থেকে বৃক্ষটি রক্ষা পেত না, এমনকি তারা হয়ত এই বৃক্ষের ব্যাপারে এই বিশ্বাসও পোষণ করত যে তা মানুষের উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখে, যেমন আজ আমরা অন্যান্য স্থানগুলোর অবস্থা প্রত্যক্ষ করছি। ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা তার বক্তব্যে একথার প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন যে, ‘‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ছিল, অর্থাৎ: ঘটনাটি তাদের সামনে সংঘটিত হওয়ার পরও ঐ বৃক্ষের স্থানটি গোপন রাখা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। (ফাতহুল বারী, ৬/১১৮)

এ বিষয়কে সমর্থন করে কাজী ইয়াদ রহ. বলেন: বৃক্ষের বিষয়টি যে পরবর্তী বছর তারা তা ভুলে গিয়েছিল, কেউ বলেছেন যে, এটা মুমেনদের জন্য রহমত এবং তাদেরকে পাপে পতিত হওয়া থেকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কেননা যদি তার স্থানটি নির্দিষ্ট থাকত তাহলে অনারব এবং জাহেলদের মাধ্যমে ঐ স্থানটিকে সম্মান জানানো এবং সেখানে কোনো ইবাদত করার ভয় ছিল।

৫. ঐ সমস্ত স্থানকে সম্মান জানানো যা সম্মান করা বিধি সম্মত নয় তা বিরাট ফেতনা-ফাসাদের কারণ: আর তা বিভিন্নভাবে স্পষ্ট করা সম্ভব:

(ক) এ সমস্ত স্থানকে সম্মান জানানো থেকে নিষেধ করা শির্কের মাধ্যমকে বন্ধ করা। কেননা তা যিয়ারত এবং সেখানে ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা মানুষকে ঐ স্থানকে সম্মান জানানো এবং তাকে পবিত্র বলে মনে করা এবং তা নিয়ে ফিতনায় পতিত হওয়ার দিকে ঠেলে দিবে, এমনকি বিষয়টি হয়ত কখনো এমনও হতে পারে যে কেউ ঐ স্থানটিকে ইবাদতখানায় পরিণত করবে।

(খ) এসমস্ত স্থানকে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করা কবরস্থানে সালাত আদায় করার মত।

অতএব তা হারামে পতিত হওয়ার মাধ্যমের ন্যায়। ফলে কবরের নিকট সালাত আদায় করা তা ইবাদত করার পথ ও মাধ্যম। তাই এসমস্ত স্থানে সালাত আদায় করা, স্থানটিকে সম্মান জানানো এবং তা ঐ স্থানটিকে ও ঐ স্মৃতিকে কোনো সময় মসজিদে পরিণত করার মাধ্যম। আর শরীয়তের দলীলসমূহ অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে যে নবীগণের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করা হারাম।

যেমন ইবনে আব্বাস এবং আয়শা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে তারা বলেছেন:

أَنَّ عَائِشَةَ، وَعَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَبَّاسٍ، قَالاَ: لَمَّا نَزَلَ بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَفِقَ يَطْرَحُ خَمِيصَةً لَهُ عَلَى وَجْهِهِ، فَإِذَا اغْتَمَّ بِهَا كَشَفَهَا عَنْ وَجْهِهِ، فَقَالَ وَهُوَ كَذَلِكَ: «لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى اليَهُودِ وَالنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন তাঁর একটি চাদর দিয়ে তাঁর চেহারাকে ঢেকে দেয়া হচ্ছিল, যখন তিনি আবার হুশ ফিরে পেতেন তখন চাদর সরিয়ে দেয়া হত, তখন তিনি বললেন: ইহুদী নাসারাদের উপর আল্লাহর লা‘নত, কারণ তারা তাদের নবীগণের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছিল, তারা যা করেছিল তাথেকে তিনি তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছিলেন।

এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস রয়েছে।

(গ) নিশ্চয়ই এসস্ত স্থানসমূহকে সম্মান জানানোর মাঝে রয়েছে আহলে কিতাব (ইয়াহূদী নাসারাদের) সাথে তাদের বিদ‘আতী এবং অন্যান্য কর্মকান্ডে সাদৃশ্যতার মাধ্যম। এমনকি তারা তাদের নবীগণের কবরসমূহ এবং স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহকে মাজার এবং দর্শনীয় স্থানে পরিণত করেছিল। আর ইসলাম তাদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করা থেকে সতর্ক করেছে, তাই ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

«أَيُّهَا النَّاسُ , إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ باتِّبَاعِهِمْ مِثْلَ هَذَا , حَتَّى أَحْدَثُوهَا بِيَعًا»

“নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এধরণের অনুসরণের কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছিল, এমনকি তারা এগুলো নিয়ে উপাসনালয়ও আবিষ্কার করেছিল।”

৬. নিশ্চয়ই ইসলাম আমাদের জন্য যে স্থানসমূহকে সম্মান যোগ্য করেছে সে সমস্ত স্থানকে সম্মান করা এবং সেখানে আল্লাহর ইবাদত করা বিধিবদ্ধ, যেমন: কা‘বা ঘরের ত্বাওয়াফ করা, হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ এবং চুম্বন করা। এগুলোতে পার্থিব কোনো বরকত লাভ করা উদ্দেশ্য নয়, তাই হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

«إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ، لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ»

“নিশ্চয়ই আমি অবগত আছি যে তুমি একটি পাথর মাত্র, তুমি অপকারও করতে পার না আবার উপকারও করতে পার না, যদি আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে না দেখতাম যে তিনি তোমাকে চুম্বন করছেন, তাহলে আমিও তোমাকে চুম্বন করতাম না”। (বুখারী: ১৫৯৭)

নিশ্চয়ই উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর এই কথার মাঝে কিছু কিছু জাহেলরা যা করে থাকে তার প্রতিবাদ রয়েছে, তারা মনে করে হাজরে আসওয়াদের বিশেষ কোনো ফযিলত রয়েছে, বা তার কোনো স্বকীয়তা রয়েছে বলে প্রমাণ দিতে চেষ্টা করে।

৭. নিশ্চয়ই এই সমস্ত স্থানসমূহকে সম্মান জানানো এবং পবিত্র মনে করা প্রকারান্তরে এগুলোকে আনন্দ উৎসবের স্থানে পরিণত করা। কেননা ‘ঈদ সময় এবং স্থানকে অন্তর্ভুক্ত করে।

‘ঈদ এমন একটি বিষয়ের নাম মানুষ যা করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বা যেখানে বার বার মানুষ আসে বিশেষ কিছু করার জন্য। বস্তুত: যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিষেধ করেছেন তাঁর কবরকে যেন আমরা ঈদগাহে পরিণত না করি, যখন তিনি বলেছেন:

«وَلَا تَجْعَلُوا قَبْرِي عِيدًا»

“আমার কবরকে তোমরা ঈদগাহে পরিণত কর না”।

অথচ তাঁর কবরটি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্থান, অতএব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত স্থান অতিক্রম করেছেন এবং যে সমস্ত স্থানে সালাত আদায় করেছেন সেগুলোকে আনন্দ উৎসবের স্থানে পরিণত না করা আরো বেশি সমীচীন।

৮-মদীনার যে স্থানটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবসময় সালাত আদায় করতেন, সালফে সালেহীনগণের কেউ ঐ স্থানটিকে স্পর্শ বা চুম্বন করতেন না, এমনিভাবে মক্কা বা অন্যান্য স্থান যেখানে তিনি সালাত আদায় করেছেন সেগুলোকেও তা করা হত না। অতএব যে স্থানটিকে তাঁর পবিত্র কদমদ্বয় স্পর্শ করত এবং সেখানে তিনি সালাত আদায় করতেন, তা স্পর্শ করা এবং চুম্বন করা তাঁর উম্মতের জন্য বিধি সম্মত করা হয় নি, তাহলে তাঁর রেখে যাওয়া যেসব স্মৃতিসমূহের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জানা নেই বা যে বিষয়ে জানা যায় যে এটা মিথ্যা। যেমন, কিছু মানুষ অনেক পাথর সংগ্রহ করে তার উপর পায়েরাগ অংকন করে থাকে আর জাহেলরা মনে করে যে, এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পদচিহ্ন, সেগুলোর ক্ষেত্রে তা কিভাবে হতে পারে? বরং এগুলো পরিত্যাগ করাই উত্তম।

পরিশেষ:

গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, মক্কা মুকাররামার জন্য যে আল্লাহ তা‘আলা সুউচ্চ মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন তিনিই আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তার সম্মান করার জন্য,

﴿ ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢ ﴾ [الحج: ٣٢]

“এবং কেউ আল্লাহ নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটা তো তার হৃদয়ের তাকওয়ার বহি:প্রকাশ”। [সূরা আল-হাজ্ব-৩২]

নিশ্চয়ই এ স্থানসমূহ যার সম্মান করা এবং সেখানে ইবাদত করা আমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করা হয়েছে তা বিরাট ফযিলতপূর্ণ, এতেই রয়েছে আমাদের জন্য যথেষ্টতা এবং অমুখাপেক্ষিতা ঐ সমস্ত স্থান থেকে যা ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করা হয় নি। তাই স্পষ্ট হলো যে, সুন্নাতের উপর অটল থাকা বিদআতী পন্থায় কঠোর সাধনা করা থেকে উত্তম।

আমি আল্লাহর নিকট দো‘আ করি তিনি যেন হাজী, যিয়ারতকারী এবং সমস্ত মুসলিমদেরকে আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করার তাওফিক দান করেন। আর যেন আল্লাহ সালাত, সালাম ও বরকত নাযিল করেন তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবার এবং তাঁর সাথীগণের প্রতি।

সমাপ্ত

[1] নোট: অর্থাৎ যে এলাকা থেকে কেবলা উত্তর বা দক্ষিণ দিকে তারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ করে বসবে আর যে এলাকা থেকে কেবলা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে তারা উত্তর বা দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসবে। (অনুবাদক)

বইঃ জুযউ রফইল ইয়াদাইন ফিস সালাত

$
0
0

JuzulRafailyadainসংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ অনেকের মধ্যে রফ’উল ইয়াদাইন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে যে, এটি ইসলামের পূর্ব যুগে ছিল কিন্তু পরবর্তী যুগে তা রহিত হয়ে যায়, আবার অনেকে বলে ইসলামের প্রাথমিক যুগের সাহাবিরা নাকি মূর্তি বগলে নিয়ে নামাজ আদায় করতেন তাই রসূল (স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাকি রফ’উল ইয়াদাইন করতেন যাতে মূর্তি গুলো পড়ে যায়। (নাউজুবিল্লাহ)

যারা এসব বিভ্রান্তিকর কথা বলেন তারা কি এটা বুঝে বলেন যে ইসলামের প্রথম শ্রেণীর সাহাবীদের সম্পর্কে উনারা কি অপবাদ দিচ্ছে? আবু বকর, খাদিজা (রা) ইত্যাদি তারা মূর্তি নিয়ে নামাজ পরতেন? সূরা কাফিরুনের অর্থ কি তারা জানেন না? এই সূরা এর শানে নুজুল কি তারা জানেন না?

আর সত্যি কথা বলতে তারা এসব কথা বলে তার স্বপক্ষে কোনো একটা হাদিস নাই যে সাহাবীরা মূর্তি নিয়ে নামাজ পড়তেন।

 বিখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম আবু আবদুল্লাহ ঈমাম বুখারী রফ’উল ইয়াদাইন সম্পর্কিত আস্ত একটা বই লিখে গেছেন যেখানে তিনি প্রতি রফ’উল ইয়াদাইনে ১০টি নেকি হয় বলে দাবি করেছেন। আর ‘জুযউ রফ’উল ইয়াদাইন’ বইয়ে রফ’উল ইয়াদাইন যে রসূল (স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) করেছেন তা প্রমাণ করার জন্যে তিনি যথেষ্ট পরিমাণ হাদিস উপস্থাপন করেছেন।

জুযউ রফইল ইয়াদাইন ফিস সালাত – QA Server

জুযউ রফইল ইয়াদাইন ফিস সালাত – Mediafire

শাইখ ফকীহ মোল্লা আলী আল-ক্বারী (রহঃ) এর সংশ্লিষ্ট জীবনী

$
0
0

5RWj0pkDB0I

তাঁর নাম হচ্ছে- আলী বিন সুলতান মুহাম্মদ। উপনাম- আবুল হাসান। উপাধি- নুরুদ্দীন। তিনি একাধারে ফিকাহবিদ, মুহাদ্দিস ও ক্বারী। বাসস্থানের বিবেচনা থেকে তাঁকে হারাবি ও মক্কী বলা হয়। তিনি ‘মোল্লা আলী ক্বারী’ নামে সুপরিচিত।

তাঁকে ক্বারী উপাধি দেয়া হয়েছে; যেহেতু কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন পঠনপদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। খোরাসানের প্রধান শহর ‘হারাত’ এর বাসিন্দা হিসেবে তাঁকে ‘হারাবী’ বলা হয়। খোরাসান বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত।

তাঁকে মক্কী বলা হয় যেহেতু তিনি মক্কায় সফর করেছেন, মক্কার আলেমদের থেকে ইলম অর্জন করেছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেছেন।

তিনি ৯৩০ হিজরি সালের দিকে হেরাত শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন। সেখানেই বড় হয়েছেন এবং জ্ঞান অর্জন করেছেন। কুরআন মুখস্থ করেছেন। তাজবিদ শিখেছেন শাইখ মঈন উদ্দীন বিন হাফেয যাইন উদ্দীন আল-হারাবী এর নিকট। সে সময়কার আলেমদের কাছ থেকে তিনি ইলমে দ্বীন অর্জন করেছেন। এরপর তিনি মক্কায় সফর করেছেন এবং মক্কাতে থেকে সেখানের আলেমদের কাছে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইলমে দ্বীন অর্জন করেছেন। এভাবে ইলম অর্জনের মাধ্যমে তিনি মশহুর আলেমে পরিণত হয়েছে। তিনি হানাফি মাযহাবের আলেম ছিলেন। তার গ্রন্থাবলি ও জীবনী থেকে সেটাই জানা যায়। হানাফি মাযহাবের অনেক মাসয়ালা নিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর পক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।

তিনি দ্বীনদার, তাকওয়াবান ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজ হাতে কাজ করে খেতেন। তিনি ছিলেন দুনিয়ার প্রতি মোহহীন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও অল্পে তুষ্ট।

মানুষের সাথে কম মিশতেন। ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। তিনি সুন্দর হস্তাক্ষরে প্রতি বছর একটি করে কুরআন লিখতেন। লিখিত কুরআন শরিফের পার্শ্বটীকাতে ক্বিরাআত ও তাফসির লিখতেন। সেটি বিক্রি করে যা পেতেন তা দিয়ে তাঁর বছর চলে যেত।

তিনি মনে করতেন শাসকদের নিকটবর্তী হওয়া এবং তাদের উপঢৌকন গ্রহণ করা ইখলাস ও তাকওয়ার পরিপন্থী। তিনি বলতেন: “আল্লাহ আমার পিতার প্রতি রহম করুন। তিনি বলতেন: আমি চাই না যে, তুমি আলেম হও; এই আশংকায় যে, তুমি আমীর-ওমরাদের দরজায় ধরনা দিবে।” [মিরকাতুল মাফাতীহ (১/৩৩১)]

ইলম, আমল ও নেকীর কাজে ভরপুর জীবন কাটিয়ে তিনি ১০১৬ হিজরীতে মতান্তরে ১০১০ হিজরীতে মক্কাতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী তিনি ১০১৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন এবং মুয়াল্লা নামক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন-

–      ইবনে হাজার আল-হাইছামী আল-ফকীহ

–      আলী মুত্তাকি আল-হিন্দি

–      আতিয়্যা বিন আলী আল-সুলামি

–      মুহাম্মদ সাঈদ আল-হানাফি আল-খোরাসানি

–      আব্দুল্লাহ আল-সিন্দি

–      কুতুবুদ্দিন আল-মাক্কী

তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন-

–      আব্দুল কাদের আল-তাবারী

–      আব্দুর রহমান আল-মুরশিদি

–      মুহাম্মদ বিন ফার্‌রুখ আল-মাওরাবী

লোকেরা তাঁর ভূয়শী প্রশংসা করেছেন:

আল-হামাবি ‘খুলাসাতুল আছার’ গ্রন্থ (৩/১৮৫) এ বলেন:

“তিনি ইলমের কর্ণধার, যুগের অনন্য, মতামত বিচার-বিশ্লেষণে অতুলনীয়, তাঁর প্রসিদ্ধি তাঁর গুণ বর্ণনার জন্য যথেষ্ট।”

আল-ইসামি ‘সামতুন নুজুম’ গ্রন্থ (৪/৪০২) এ বলেন:

“আকলি ও নকলি (বর্ণনানির্ভর ও যুক্তিনির্ভর) উভয় জ্ঞানের ভান্ডার। হাদিসে রাসূলের পূর্ণ সুধা পানকারী। মুখস্থ শক্তি ও বোধশক্তির জন্য প্রসিদ্ধ ও নামকরা একজন ব্যক্তিত্ব।”

লাখনাবি তাঁর ‘আত-তালিক আল-মুমাজ্জাদ’ গ্রন্থে বলেন:

“অত্যুজ্জ্বল ইলম ও স্বনামধন্য মর্যাদার অধিকারী”

এরপর তিনি তাঁর লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থ উল্লেখ করে বলেন:

এগুলো ছাড়াও তাঁর লিখিত আরও অগণিত পুস্তিকা রয়েছে; সবগুলো মূল্যবান।

নোমানী তার ‘আল-বিজাতুল মুযজাত’ নামক গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-৩০) বলেন:

“তিনি ছিলেন সমকালীন আলেমদের মধ্যে সেরা। প্রসিদ্ধ ইমাম, আল্লামা। আকলি ও নকলি অনেক জ্ঞানের আধার ছিলেন তিনি। হাদিস, তাফসির, ক্বিরাআত, উসুলে ফিকহ, আরবী ভাষা, ভাষাবিজ্ঞান ও বালাগাত ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন।”

ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) ও ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) কে তিনি যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। তাঁদের দুজনের উপর আরোপিত অভিযোগগুলো তিনি খণ্ডন করতেন এবং তাঁদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন। তাঁর গ্রন্থাবলির অনেক স্থানে তিনি সলফে সালেহিনের আকিদা সাব্যস্ত করেছেন। যদিও তাঁর গ্রন্থাবলির কিছু কিছু স্থানে সলফে সালেহিনের ‘মানহাজ’ (নীতি) এর পরিপন্থী বিষয় পাওয়া যায়। সেসব ক্ষেত্রে তিনি হানাফি-মাতুরিদি আলেমগণের মাযহাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আল্লাহর গুণাবলি সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে তিনি সলফে সালেহিনদের পরবর্তী আলেমদের নীতি গ্রহণ করেছেন অথবা আল্লাহর গুণাবলিকে ভিন্নার্থে ব্যাখ্যার নীতিতে চলেছেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু জিনিস গ্রহণীয় ও কিছু জিনিস বর্জনীয়।

দেখুন: আস-শামস আল-আফগানি লিখিত ‘আল-মাতুরিদিয়্যা’ (১/৩৫০), (১/৫৩৭-৩৪০)।

তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হচ্ছে-

–      তাফসিরুল কুরআন

–      মিরকাতুল মাফাতিহ

–      শারহু নুখবাতুল ফিকার

–      আল-ফুসুল আল-মুহিম্মাহ

–      শারহু মুশকিলাতুল মুয়াত্তা

–      বিদাআতুস সালিক

–      শারহুল হিসনিল হাসিন

–      শারহুল আরবায়িন নাবাবিয়্যা

–      জাওউল মাআলি

–      শাম্মুল আওয়ারিদ ফি যাম্মির রাওয়াফেয

–      ফাইযুল মুয়িন

–      রিসালা ফির্‌ রাদ্দ আলা ইবনে আরাবি ফি কিতাবিহি আল-ফুসুস ওয়া আলাল কায়িলিনা বিল হুলুল ওয়াল ইত্তিহাদ

এছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ।

আরও জানতে দেখুন:

–      যিরিকলি এর ‘আল-আলাম’ (৫/১২-১৩)

–      কান্দালাবি এর ‘আত-তালিক আস-সাবিহ আল মিশকাতিল মাসাবিহ’ (পৃষ্ঠা-৬)

–      লাখনাবি এর ‘আত-তালিকাত আস-সানিয়্যাহ’ (পৃষ্ঠা ৮-৯)

–      মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আল-শামা এর ‘আল-মোল্লা আলী আল-ক্বারি ফিহরিস মুআল্লাফাতিহি ওয়ামা কুতিবা আনহু

আল্লাহই ভাল জানেন।

বইঃ ফাযায়েলে আমাল

$
0
0

Fazayele amalসংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রবণতা রয়েছে ফাযীলাত বিষয়ক আমল গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়ার। কিন্তু বেশী ফাযীলাত পাওয়ার নেশায় পড়ে আমাদের মাঝে অনেকেই যইফ ও জাল হাদীসের উপর আমাল করে আমল বিনষ্ট করছি। এমনকি ফাযায়িল সম্পর্কিত বই গুলোতে শুধু জাল যইফ হাদীস নয় বরং শিরক ও বিদআতের যেমন আলোচনা এসেছে যা আমাদেরকে শিরক  ও বিদআতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফাযীলাত সম্পর্কিত হাদীস গুলোর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ হাদীসগুলোই সমালোচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের আমল এই এক চতুর্থাংশ হাদীসগুলো নিয়ে কিন্তু বাকী তিন-চতুর্থাংশহাদীস নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আবার কুরআনেও যে ফাযীলাত সম্পর্কিত আয়াতগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। এই বইটিতে প্রথমেই কুরআনের আলোকে ফযীলাত সম্পর্কিত আয়াত গুলো আলোচিত হয়েছে। আবার আমলের ফাযীলাত সম্পর্কে আমরা অবগত হলেও আক্বীদার গুরুত্ব ও এর ফাযীলাত সম্পর্কিত যে কুরআনের আয়াত ও হাদীস গুলো এসেছে তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। অথচ সব আমল কবূলের পূর্বশর্তই হলো আক্বীদা সঠিক হওয়া।

বইটিতে কয়েকটি অংশ রয়েছে যা না উল্লেখ করা হলে আমরা বইটি নিয়ে বেশী উপকৃত হতে ব্যর্থ হবো।

বইটির বৈশিষ্ট্য হলো :

  • বইটিতে প্রথমেই কুরআনের আয়াত হতে ফাযায়িল বর্ণিত হয়েছ।
  • এরপর বইটিতে সহীহ হাদীসের আলোকে ফাযায়িল বর্ণিত হয়েছে।
  • বইটিতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ছোট ছোট গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। যেমনতাওহীদ,শিরক, বিদআত,সালাত সম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। যা অত্যন্ত আমাদের জন্যসহায়ক
  • বইটিতে হাদীসগুলো উল্লেখ করার পাশাপাশি হাদীসের ইবারত বর্ণনা করা হয়েছে।
  • শুধুমাত্র হাদীসগুলো উল্লেখ করা হয়নি সাথে সাথে হাদীসটির তাহক্বীক বর্ণনা করা হয়েছে।
  • শুধুমাত্র একজন মুহাদ্দিসের তাহক্বীক নয়, একাধিক মুহাদ্দিসের তাহক্কীক বর্ণনা করা হয়েছে।
  • একই বিষয়ের একাধিক হাদীসগুলো পাশাপাশি আনা হয়েছে।
  • ফাযায়িল সম্পর্কিত বানোয়াট বর্ণনার প্রতিবাদ করা হয়েছে।
  • বইটিতে “যা জানা জরুরী” সম্পর্কে একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। যা সবার প্রয়োজনীয় । হাদীসের বিভিন্ন পরিভাষা আলোচনা করা হয়েছে।
  • এরপর এরপর ফাযীলাত সম্পর্কিত যইফ ও মাওযু ( জাল ) হাদীসগুলো তাহক্বীকসহ বর্ণনা করা হয়েছে।
  • বইটির হাদীসগুলোর ক্রমিক নম্বর মিলানোর জন্য চতুর্থ প্রকাশের কথা নামকপরিচ্ছেদ পড়ার অনুরোধ করছি। নতুবা ক্রমিক নম্বর হাদীসগুলো পেতে সমস্যা হবে।

বিঃদ্রঃ এই বইটি তাবলীগ জামাতের ফাযায়েলে আমল নয়। এই বইটিতে সকল হাদিস সহীহ। এবং সকল হাদিস শেইখ আলবানী (রহঃ) কতৃক তাহকীককৃত

ফাযায়েলে আমাল – QA Server
ফাযায়েলে আমাল – Mediafire

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -১

$
0
0

Adab in Muslim Life QA

লেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আদব-কায়দা’র পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১. আদব-কায়দা’র পরিচয়:

আদব শব্দটি আরবি  ” أدب “শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো: বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার।[1] আবার  ” أدب “শব্দের অর্থ: নিয়মনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি।  আর আদব-কায়দা মানে— ভদ্র সমাজের রীতি-পদ্ধতি; ভদ্র ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যায়: আদব-কায়দা মানে কাঙ্খিত শিক্ষা, সভ্যতা ও মার্জিত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মগঠনের অনুশীলন করা।[2]

ইবনু হাজার ‘আসকালানী রহ. বলেন:

« الأدب: استعمال ما يحمد قولاً وفعلاً » .

“কথায় ও কাজে প্রশংসনীয় ব্যবহারকে আদব বলে।”[3]

আবার কেউ বলেন:

« الأخذ بمكارم الأخلاق » .

“উত্তম চরিত্র লালন করাকে আদব বলে।”[4]

আবার কেউ কেউ বলেন:

« هو تعظيم من فوقك والرفق بمن دونك » .

“আদব হলো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে সম্মান করা এবং অধস্তনকে স্নেহ করা।”[5]

কেউ কেউ বলেন:

« الأدب هو حسن الأخلاق وفعل المكارم » .

“আদব মানে উত্তম চরিত্র এবং ভালো কাজ।”[6]

আর ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন:

« الأدب اجتماع خصال الخير في العبد » .

“বান্দার মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটানোকে আদব বলে।”[7]

আবার কেউ কেউ বলেন:

« والأدب هو الخصال الحميدة » .

“প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহকেই আদব বলে।”[8]

আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুয়াদ্দাব’ (শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত) বলে। আর এসব গুণাবলী যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’ (অশালীন, অভদ্র, অসভ্য) বলে।

২. আদব-কায়দা’র গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

মানবজীবন তথা মুসলিম ব্যক্তির জীবনে আদব-কায়দার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহুল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِنَّ الْهَدْىَ الصَّالِحَ ، وَالسَّمْتَ الصَّالِحَ ، وَالاِقْتِصَادَ جُزْءٌ مِنْ خَمْسَةٍ وَعِشْرِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ » . (رواه أبو داود).

“নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়্যাতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ সমতুল্য।”[9]

আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:

« اُطْلُبْ الْأَدَبَ فَإِنَّهُ زِيَادَةٌ فِي الْعَقْلِ ، وَدَلِيلٌ عَلَى الْمُرُوءَةِ ، مُؤْنِسٌ فِي الْوَحْدَةِ ، وَصَاحِبٌ فِي الْغُرْبَةِ ، وَمَالٌ عِنْدَ الْقِلَّةِ » . (ذَكَرَهُ الْحَاكِمُ فِي تَارِيخِهِ).

“তুমি আদব অন্বেষণ কর; কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপুরক, ব্যক্তিত্বের দলীল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।”[10]

আর আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা ব্যক্তির জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি হয়; আর এ আদব হলো দীন ইসলামের সারবস্তু; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির জন্য জরুরি হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এবং সাধরণ মানুষসহ সকল সৃষ্টির সাথে আদব রক্ষা করে চলা; আর এ আদবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম জানতে পারবে তার খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় তার অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ; কিভাবে তার সালাম প্রদান, অনুমতি গ্রহণ, বসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ করা, হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার মত বিবিধ কাজ সম্পন্ন হবে; আর কেমন ব্যবহার হবে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এক কথায় এ আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কাঙ্খিত মানের ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে; ফলে দীন ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও দুনিয়ার দিক দিগন্তে। তাইতো কেউ কেউ শিক্ষার চেয়ে আদব বা শিষ্টাচারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« تَأَدَّبُوا ثُمَّ تَعَلَّمُوا » .

“তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর।”[11]

আল-কারাফী তাঁর ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে বলেন:

«وَاعْلَمْ أَنَّ قَلِيلَ الْأَدَبِ خَيْرٌ مِنْ كَثِيرٍ مِنْ الْعَمَلِ » .

“আর জেনে রাখবে, অনেক বেশি কাজের চেয়ে অল্প আদব অনেক বেশি উত্তম।”[12]

আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন:

« لَا يَنْبُلُ الرَّجُلُ بِنَوْعٍ مِنْ الْعِلْمِ مَا لَمْ يُزَيِّنْ عِلْمَهُ بِالْأَدَبِ » .

“ব্যক্তি কোনো প্রকার জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।”[13]

তিনি আরও বলেন:

« نَحْنُ إلَى قَلِيلٍ مِنْ الْأَدَبِ أَحْوَجُ مِنَّا إلَى كَثِيرٍ مِنْ الْعِلْمِ » .

“আমরা অনেক বেশি জ্ঞানের চেয়ে কম আদবকে অনেক বেশি জরুরি বা প্রয়োজন মনে করতাম।”[14]

কোনো কোনো দার্শনিক বলেন:

« لَا أَدَبَ إلَّا بِعَقْلٍ ، وَلَا عَقْلَ إلَّا بِأَدَبٍ » .

“আকল (বুদ্ধি) ছাড়া আদব হয় না; আবার আদব ছাড়া আকলও হয় না।”[15]

অর্থাৎ একটি আরেকটির পূরিপূরক। আর জনৈক সৎব্যক্তি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন:

« اجْعَلْ عَمَلَك مِلْحًا وَأَدَبَك دَقِيقًا » .

“তুমি তোমার আমলকে মনে করবে লবণ, আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা।”[16]

অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদবকে এত বেশি গুরুত্ব দিবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কম বেশি হয়।

[1] ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, আল মুনীর আরবী-বাংলা অভিধান, দারুল হিকমা বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: জুলাই ২০১০ খ্রি., পৃ. ১৫; বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত সংষ্করণ: ডিসেম্বর ২০০০, পৃ. ১০৩
[2] আল-মু‘জাম আল-অসীত, দ্র: ” أدب ”
[3] ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[4] প্রাগুক্ত।
[5] প্রাগুক্ত।
[6] প্রাগুক্ত।
[7] প্রাগুক্ত।
[8] প্রাগুক্ত।
[9] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৪৭৭৮; আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[10] হাকেম রহ. তাঁর ‘আত-তারীখ’ গ্রন্থে বর্ণনটি উল্লেখ করেছেন।
[11] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[12] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[13] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[14] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[15] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[16] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। “

বইঃ রাসুল (সাঃ) জান্নাত জাহান্নামের বর্ণনা দিলেন যেভাবে

$
0
0

10475524_347834408707921_5213780398826837752_nসংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ চিরন্তন সত্য মৃত্যুর পর আখিরাতে সকল মানুষের শেষ ঠিকানা হয় জান্নাত না হয় জাহান্নাম। যারা ঈমান এনেছে এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করেছেন তাদের আখিরাতে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দিয়ে পুরষ্কৃত ও সম্মানিত করবেন। তারা সেখানে সুখ-শান্তিতে জীবন যাপন করবেন। আবার যারা ঈমান গ্রহণ করেনি এবং পাপের কাজ করেছেন আখিরাতে আল্লাহ তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন এবং নানা রকম আযাব প্রদান করবেন। তারা খুবই বেদনাদায়ক জীবন যাপন করবে।   এই জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে আমাদের কৌতুহলের শেষ নেই। আবার আমাদের তেমন সুষ্পষ্ট ধারণা নেই। কুরআন ও সুন্নাহতে জান্নাত জাহান্নাম সম্পর্কে বর্ণনা নিয়ে সংকলিত এই বই। রাসূল (সা) মিরাজের রজনীতে জান্নাত ও জাহান্নাম যেভাবে দেখেছেন এবং কুরআন হাদীস হতে এ সম্পর্কিত সঠিক বর্ণনাগুলো এই বইটিতে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

বইটির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কিয়দংশ :

  • জান্নাত-জাহান্নামের অস্তিত্ত্ব ও যুক্তির পূজা।
  • জান্নাতের সীমারেখা
  • জান্নাতে প্রবেশকারী মানুষ।
  • আল্লাহর সাক্ষাত
  • জান্নাত থেকে বঞ্চিত মানুষ
  • জান্নাতের অস্তিত্ত্বের প্রমাণ
  • আল-কুরআনের আলোকে জান্নাত।
  • জান্নাতীদের বৈশিষ্ট্য ও জান্নাতে তাদের অবস্থা
  • জান্নাতে মাহাত্ম্য
  • জান্নাতের প্রশস্ততা
  • জান্নাতের দরজা
  • জান্নাতের স্তর সমূহ
  • জান্নাতের দালানসমূহ।
  • জান্নাতের তাবুসমূহ, বাজার, বৃক্ষসমূহ, ফলসমূহ, নদীসমূহ, ঝর্ণাসমূহ, কাওসার নদী, হাউজে কাউসার,
  • জান্নাতীদের খাবার ও পানীয়, পোশাক ও অলংকার, বৈঠক ও আসনসমূহ, সেবক, হুর
  • জান্নাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি
  • জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা
  • জান্নাতের অধিবাসীদের গুনাবলী ও আমলসমুহ
  • জান্নাত লাভের দুআ
  • জাহান্নামের আগুন ও শাস্তি
  • জাহান্নামের দরজা,স্তর, দালান, গভীরতা
  • জাহান্নামের আযাবের ভয়াবহতা
  • জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা, জাহান্নামের হালকা শাস্তি
  • জাহান্নামীদের অবস্থা, খাবার ও পানীয়, পোশাক, বিছানা, আচ্ছাদন ও বেষ্টনী
  • জাহান্নামের লাঞ্জনাময় শাস্তি
  • কুরআনের আলোকে জাহান্নামীরা
  • জাহান্নাম ও ইবলিস
  • জাহান্নামের দু:সংবাদপ্রাপ্তরা ।
  • চিরস্থায়ী জাহান্নামীগণ
  • জাহান্নামে নারীদের আধিক্য
  • জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় ও দুআ প্রভৃতি
জান্নাত জাহান্নামের বর্ণনা – QA Server
জান্নাত জাহান্নামের বর্ণনা – Mediafire

আশারায়ে মুবাশশারাহ- জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবী

$
0
0

10_mub-600x375

মূল: কাযী আবুল ফযল হাবীবুর রহমান | অনুবাদ : শাইখ ফাইযুর রহমান

মুসলিমরা তাদের ধর্ম, ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও বড়বড় মুসলিম নেতাদের পূর্ব ঐতিহ্যের ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কারণে আজ অপমাণিত পদদলিত মথিত হচ্ছে। কারণ যে জাতি নিজের ইতিহাসকে ভুলে যায়, সে জাতির বীরত্ব, কৃতিত্ব ও মান মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে না- যা জাতিকে স্বাধীনতা ও বীর্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত করবে। ফলে সে জাতির নাম ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায় যেমন পারস্যের কবি শেখ সাদী বলেন,

তোমরা অতীতের লোকের সুনামকে নষ্ট করো না, তাহলে তোমারও সুনাম বিদ্যমান থাকবে।

মুসলিম জাতির নবী রাসুলগণের পর যাদের অবদান সবচেয়ে বেশী এবং যাদের পথ সবচেয়ে অনুসরণীয় তারা হলেন আল্লাহর রাসূল (সা)-এর সাহাবীগণ (রা)।

আল্লাহ তা’আলা ঐ সমস্ত সাহাবীগণকে রাসুল (সা)-এর পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টা নিধারণ করে তাঁদের সম্মান আরও বর্ধিত করেছেন ।

আল্লাহ তাআলা তাঁদের সচ্চরিত্র সম্পর্কে তাঁর বাণী অবতীর্ণ করে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন :

مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِي ٱلۡإِنجِيلِ كَزَرۡعٍ أَخۡرَجَ شَطۡ‍َٔهُۥ فَ‍َٔازَرَهُۥ فَٱسۡتَغۡلَظَ فَٱسۡتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِۦ يُعۡجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلۡكُفَّارَۗ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا  [الفتح: ٢٩

‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়, তুমি তাদেরকে রুকূকারী, সিজদাকারী অবস্থায় দেখতে পাবে। তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে। তাদের আলামত হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার চি‎হ্ন থাকে। এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইনজীলে তাদের দৃষ্টান্ত হলো একটি চারাগাছের মত, যে তার কচিপাতা উদগত করেছে ও শক্ত করেছে, অতঃপর তা পুষ্ট হয়েছে ও স্বীয় কাণ্ডের ওপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়েছে, যা চাষীকে আনন্দ দেয়। যাতে তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদেরকে ক্রোধান্বিত করতে পারেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের ওয়াদা করেছেন।’ [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত : ২৯]

আল্লাহ তাআলা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন।

আল্লাহ বলেন :

[ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ [التوبة: ١٠٠

‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে অগ্রবর্তী সাহাবীগণ এবং কল্যাণকর্মের মাধ্যমে তাঁদের অনুসারীগণের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন’ [আত-তাওবাহ ১০০]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

لِلۡفُقَرَآءِ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأَمۡوَٰلِهِمۡ يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ٨ وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلۡإِيمَٰنَ مِن قَبۡلِهِمۡ يُحِبُّونَ مَنۡ هَاجَرَ إِلَيۡهِمۡ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُواْ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ  [الحشر: ٨، ٩

‘এই সম্পদ নিঃস্ব মুহাজিরগণের জন্য ও যাদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। অথচ এরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অন্বেষণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেন। এরাই তো সত্যবাদী। আর মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা মদীনাকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং ঈমান এনেছিল (তাদের জন্যও এ সম্পদে অংশ রয়েছে), আর যারা তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে তাদেরকে ভালোবাসে। আর মুহাজরিদেরকে যা প্রদান করা হয়েছে তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা অনুভব করে না। এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যাদের মনের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ [সূরা আল-হাশর, আয়াত : ০৮-০৯]

সাহাবীদের প্রশংসায় রাসুল (সা) বলেছেন,

আমার উম্মতের মধ্যে তারাই সব চাইতে নেক লোক যাদের মাঝে আমি প্রেরিত হয়েছি।

অন্য বর্ণনায়, রাসুল (সা) বলেছেন:

সবচাইতে সেরা মানব আমার সাহাবাগণ।

অন্য স্থানে বলেছেন :

সমস্ত গোত্রের মধ্যে আমার (বনু হাশেম) গোত্র সর্বশ্রেষ্ঠ। এ বর্ণনায় শেষের দিকে সাহাবাগণের প্রতি ভালোবাসাকে ঈমানের চিহ্ন হিসেবে অভিহিত করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,

لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابَ مُحَمَّدٍ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ ، فَلَمُقَامُ أَحَدِهِمْ سَاعَةً ، خَيْرٌ مِنْ عَمَلِ أَحَدِكُمْ عُمُرَهُ.

‘তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবীদের গালাগাল করো না। কেননা তাদের এক মুহূর্তের (ইবাদতের) মর্যাদা তোমাদের প্রত্যেকের জীবনের আমলের চেয়ে বেশি।’ [ইবন মাজা : ১৬২; আহমাদ বিন হাম্বল, ফাযাইলুস ছাহাবা : ১৫]

রাসুল (সা) তাদেরকে গালমন্দ করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন।

আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ سَبَّ أَصْحَابِي فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لاَ يَقْبَلُ اللَّهُ مِنْهُ صَرْفًا وَلا عَدْلا».

‘যে ব্যক্তি আমার ছাহাবীকে গাল দেবে তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা সকল মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তার নফল বা ফরয কিছুই কবুল করবেন না।’ [তাবারানী : ২১০৮]

রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন,

« لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ ».

‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালমন্দ করো না। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ। যদি তোমাদের কেউ উহুদ পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তবে তা তাদের এক মুদ বা তার অর্ধেকরও সমকক্ষ হতে পারবে না।’ [বুখারী : ৩৬৭৩; মুসলিম : ৬৬৫১]

প্রকাশ থাকে যে, হাদীসে উল্লেখিত এক মুদ সমান তিনপোয়া।

সামগ্রিক বিচারে সাহাবরা সকলে অন্য সকল উম্মত অপেক্ষা উত্তম। তবে সাহাবারা নিজেরা কিন্তু সকলে একই স্তরের নন। বরং কেউ কেউ মর্যাদায় অন্যদের চেয়ে উত্তম। তাদের নিজেদের মদ্যে মধ্যে মর্যাদার দিক তেকে বিভিন্ন শ্রেণী-বিন্যাস ও স্তর রয়েছে। নিম্নে তাদের ক্রমধারা প্রদত্ত হলো :

সাহাবাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন চার খলিফা।

  • আবূ বকর (রা)
  • উমার (রা)
  • উসমান (রা)
  • আলী (রা)

এদের পরবর্তী স্তরে আছেন অবশিষ্ট আশারায়ে মুবাশশারাগণ। যারা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবী বলে পরিচিত। তাদের সম্পূর্ণ তালিকা হলো :

  • আবূ বাকর সিদ্দীক (রা)
  • উমার বিন খাত্তাব (রা)
  • উসমান বিন আফফান (রা)
  • আলী বিন আবী তালীব (রা)
  • আবূ উবাইদাহ বিন জাররাহ (রা)
  • সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা)
  • আবদুর রহমান বিন আওফ (রা)
  • যুবাইর বিন আওম (রা)
  • তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা)
  • সাঈদ বিন যায়দ (রা)

এমনিভাবে মুহাজির সাহাবীবৃন্দ আনসারদের চেয়ে উত্তম। বদর যুদ্ধে ও বাইআতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারীরা অন্যদের চেয়ে উত্তম। অনুরুপভাবে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সাহাবরে চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ . (الحديد:10

অর্থ: তোমাদের কি হল ? তোমরা আল্লাহর পথে কেনো ব্যয় করো না ? অথচ আকাশমন্ডলি ও পৃথিবীর মালিকানা তো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যার মক্কা বিয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে, তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়। এরা মর্যাদায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যারা পরে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণেল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। [সুরা আল-হাদীদ, আয়াত নং-১০]

সাহাবাদের সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়ালা জামায়াতের আক্বীদা হচ্ছে : তাদের ব্যাপারে উম্মতের অন্তর এবং জিহবা (বাকশক্তি) সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও নিরাপদ থাকবে।

আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে তাদের মানষিকতা সম্পর্কে বলেন :

وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ . (حشر:10)

অনুবাদ : ‘এবং যারা তাদের পরে এসেছে, তারা বলে: হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভ্রাতাবৃন্দকে ক্ষমা কর। এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে প্রতিপালক! আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়। [সূরা আল-হাশর, আয়াত নং-১০]

রাসূল (সা) এর এই দশজন সাহাবীগণ সম্পর্কে হাদীসে সহীহ ও দুর্বল উভয় প্রকার সনদে অনেক হাদীস এসেছে। তাদের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন,

আবু বাকর জান্নাতী, উমার জান্নাতী, উসমান জান্নাতী, আলী জান্নাতী,তালহা জান্নাতী, যুবাইর জান্নাতী, আব্দুর রহমান জান্নাতী,সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস জান্নাতী, সাঈদ ইবনে যায়েদ জান্নতী এবং আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা)। (তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৩৫)।

উমার (রা) বলেন,

কেউই ঐ ব্যক্তিদের ছাড়া খিলাফাতের হকদার নয়, যাদের প্রতি রাসূল (সা) তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। অত:পর ‘উমার (রা) তাদের নাম উচ্চারণ করতে লাগলেন, ‘উসমান,’আলী, তালহা, যুবাইর, সা’দ এবং আবদুর রহমান সবাই জান্নাতী। ( বুখারী, মিশকাত সোলেমানীয়া প্রকাশনী হা/৫৭২৬)।

মোল্লা আলী কারী তার প্রসিদ্ধ ভাষ্যগ্রন্থ মিরকাতে এই হাদীসে আবূ উবাইদাহ (রাযি) ও সাঈদ বিন যায়দের নাম উল্লেখ না করার কারণ সম্পর্কে বলেন যে, আবূ উবাইদাহ (রা) পূর্বেই ইন্তিকাল করেছিলেন। সাঈদ বিন যায়দ সম্পর্কে বলেন যে, তিনি তার ভগ্নিপতি হওয়ার কারণে তার নাম উল্লেখ করেন নি।

আনাস (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বড় রহমওয়ালা আবূ বাকর (রা), আল্লাহর হুকুম পালনে উমার (রা) অদ্বিতীয়, সবচেয়ে লজ্জাশীল উসমান, ফর বিষয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ যায়দ বিন সাবিত, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কারী উবাই বিন কা’ব, হালাল হারাম বিষয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ মু’য়ায বিন জাবাল, প্রত্যেক উম্মাতের জন্য একজন করে আমানতদার থাকে, আমার উম্মাতের আমানতদার আবূ উবায়দাহ (রা)।

মা’মার কাতাদাহ হতে বর্ণনা করেন, সবচেয়ে বড় বিচারক ‘আলী (রা)। ( আহমাদ,তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৩৬)।

আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা) বলেন, আমাদের তিনজন কুরাইশীর চেহারা অতি উজ্জল, তাদের চরিত্রও খুব ভাল, হক প্রতিষ্ঠায় তাদের অন্তর অত্যন্ত মজবুত। তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় তারা মিথ্যা বলে না এবং তারাও তোমাকে মিথ্যুক মনে করে না। তারা হলেন আবূ বাকর সিদ্দীক (রা), আবূ উবায়দাহ (রা) এবং ‘উসমান (রা)।

যুবাইন বিন বাক্কার (রহ) বলেন, আমি কিছু সংখ্যক জ্ঞানী লোকের নিকট শুনেছি সাহাবাগণের মধ্যে বড় বক্তা আবূ বকর ও আলী (রা)।

সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস ছিলেন আল্লাহর পথে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী। তিনি বলেন, আমিই আরবদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যে আল্লাহর পথে তীর নিক্ষেপ করেছি। (মুত্তাফাকুন আলাইহি, মিশকাত হা/৫৭৩০)।

তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা) সম্পর্কে হাদীস:

যুবাইর (রা) বলেন, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলে কারীম (রা)-এর গায়ে লৌহ বর্ম ছিল। শত্রু সৈন্যদের অবস্থা দেখার জন্য তিনি একখানা পাথরের ওপর ওঠতে চাইলেন, কিন্তু বর্মের ভারি ওজনের দরুন উঠতে পারছিলেন না। তখন তালহা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নীচে বসে গেলেন। এমনকি রাসূল (সা) তাঁর উপরে ভর করে পাথরটির ওপর ওঠলেন ।বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, তালহা নিজের জন্যে জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে। (তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৩৭)। অন্য হাদীসে তালহাকে জীবন্ত শহীদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৩৮)

সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস ছিলেন রাসুল (সা)-এর দূর সম্পর্কের মামা। জাবির (রা) বলেন, একদা সা’দ রাসূল (সা)-এর সামনে উপস্থিত হলেন। তখন রাসুল (সা) তার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ইনি হলেন, আমার মামা, অতএব কারও যদি এমন মামা থেকে থাকেন, তবে সে আমাকে দেখাক। (তিরমিযী,মিশকাত হা/৫৭৪৩)

ইমাম তিরমিযী বলেছেন, সা’দ ছিলেন যোহরা খান্দানের লোক আর রাসুল (সা)-এর মাতাও ছিলেন বনী যোহরার কন্যা। এ হিসেবে তিনি সাদকে বলেছেন, ইনি আমার মামা।

উম্মে সালামা (রা) বলেন, আমি রাসুল (সা)-কে তাঁর স্ত্রীদেরকে বলতে শুনেছি, আমার ইন্তেকালের পর যে ব্যক্তি তোমাদেরকে অঞ্জলি ভরে দান করবে, সে ঈমানদার এবং নেককার। হে আল্লাহ! তুমি আব্দুর রহমান বিন আওফকে জান্নাতের সালাসাবিল থেকে পান করাও । (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত হা/৫৭৪৭)।

জাবির (রা) বলেন, রাসুল (সা) আহযাবের যুদ্ধের সময় বললেন, এমন কে আছে যে শত্রুদলের তথ্য এনে আমাকে দিতে পারে ? তখন হযরত যুবাইর (রা) বললেন, আমি। অত:পর রাসূল (সা) বললেন, প্রত্যেক নবীর হাওয়ারি থাকে। নিশ্চয়ই যুবাইর আমার হাওয়ারী। ( মুত্তাফাকুন আলাইহি, হা/৫৭২৭)।

ইমাম সুয়ুতী হতে বর্ণিত,

আয়িশা সিদ্দীকাকে একজন জিজ্ঞেস করলেন রাসূল (সা) প্রতিনিধি নিয়োগ করলে কাকে করতেন ? মু’মিন জননী বললেন, আবূ বাকরকে, তারপর জিজ্ঞেস করলেন আবূ বাকরের পর কাকে ? বললেন ‘উমারকে; পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো তারপর কাকে প্রতিনিধি নির্বাচন করতেন ? বললেন, আবূ উবায়দাহ বিন জাররাহ (রা)। ( মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৩২)।

সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব বলেন, আবূ বকর, উমার, আলী, তালহা, যুবাইর, সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস, আব্দুর রহমান বিন আওফ এবং সাঈদ বিন যায়েদ লড়াইয়ের ময়দানে রাসূল (সা)-এর সামনে প্রথম সারিতে থাকতেন এব্ং সালাতের মধ্যে রাসূলের পিছনেই থাকতেন।

আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদের অনুসৃত পথ অনুসরণ করার তাওফিক দিন।

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -২

$
0
0

Adab in Muslim Life QAলেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

নিয়তের আদবসমূহ

মুসলিম ব্যক্তি নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাবের প্রতি বিশ্বাস করে এবং আরও বিশ্বাস করে তার ধর্মীয় ও জাগতিক জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়তের গুরুত্বকে। কারণ, নিয়তের দ্বারাই সকল কাজের অস্তিত্ব লাভ করে এবং নিয়ত অনুযায়ীই তার রূপ-প্রকৃতি তৈরি হয়; ফলে সে অনুসারে তা শক্তিশালী হয়, দুর্বল হয়, শুদ্ধ হয় এবং নষ্ট হয়; আর মুসলিম ব্যক্তি প্রত্যেক কাজে নিয়তের প্রয়োজনীয়তা ও তা বিশুদ্ধকরণের আবশ্যকতার বিষয়টিকেও বিশ্বাস করে। এ ব্যাপারে সে প্রথমত আল্লাহর বাণী থেকে দলীল গ্রহণ করে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ [البينة: ٥

“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।”[1]

আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:

[قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ  [الزمر: ١١

“বলুন, ‘আমি তো আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি, আল্লাহ‌র আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ‘ইবাদাত করতে।”[2]

আর দ্বিতীয়ত দলীল গ্রহণ করে মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে, তিনি বলেন:

( إنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى  . (متفق عليه

“প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত; আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।”[3]

তিনি আরও বলেন:

إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ   (رواه مسلم

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে লক্ষ্য করেন।”[4]

আর অন্তরের দিকে লক্ষ্য করা মানে নিয়তের দিকে লক্ষ্য করা; কেননা, নিয়ত হলো কাজের উদ্দেশ্য ও প্রতিরক্ষক। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

( مَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَةٌ  (رواه مسلم

“যে ব্যক্তি ভালোকাজের পরিকল্পনা করল, কিন্তু বাস্তবে সে কাজ করতে পারল না, সে ব্যক্তির জন্য সাওয়াব লেখা হবে।”[5]

সুতরাং শুধু ভালোকাজের পরিকল্পনা করার দ্বারাই কাজটি ভালোকাজ হিসেবে গণ্য হয়ে যায়, প্রতিদান সাব্যস্ত হয়, সাওয়াব অর্জন হয়; আর এটা শুধু ভালো নিয়তের ফযীলতের করণেই সম্ভব হয়। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 مَثَلُ هَذِهِ الْأُمَّةِ كَمَثَلِ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ : رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا ، فَهُوَ يَعْمَلُ بِعِلْمِهِ فِي مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِي حَقِّهِ ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يُؤْتِهِ مَالًا ، فَهُوَ يَقُولُ : لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذِي يَعْمَلُ ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : فَهُمَا فِي الْأَجْرِ سَوَاءٌ . وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمْ يُؤْتِهِ عِلْمًا ، فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِي غَيْرِ حَقِّهِ ، وَرَجُلٌ لَمْ يُؤْتِهِ اللَّهُ عِلْمًا وَلَا مَالًا ، فَهُوَ يَقُولُ : لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذِي يَعْمَلُ ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى  اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : فَهُمَا فِي الْوِزْرِ سَوَاءٌ  (رواه ابن ماجه

“এ উম্মতের দৃষ্টান্ত চার ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত: ১. এক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ ও ‘ইলম (জ্ঞান) দান করেছেন, অতঃপর সে তার জ্ঞান দ্বারা আমল করে তার সম্পদকে হক পথে খরচ করে; ২. আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে ‘ইলম দান করেছেন, কিন্তু তাকে সম্পদ দেননি, অতঃপর সে বলে: আমার যদি এ ব্যক্তির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমি সে ক্ষেত্রে সে ব্যক্তির মতই কাজ করতাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সাওয়াবের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান। ৩. অপর আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু তাকে ‘ইলম দেননি, অতঃপর সে তার সম্পদের ক্ষেত্রে এলোমেলোভাবে কাজ করে তা অন্যায় পথে খরচ করে; ৪. অপর আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ ও ‘ইলম কোনটিই দান করেননি, অতঃপর সে বলে: আমার যদি এ ব্যক্তির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমি সে ক্ষেত্রে সে ব্যক্তির মতই কাজ করতাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: গুনাহের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান।”[6]

সুতরাং ভালো নিয়তকারী ব্যক্তিকে ভালোকাজের সাওয়াব দেওয়া হয়; আর মন্দ নিয়তকারী ব্যক্তিকে মন্দকাজের মন্দ প্রতিদান দেওয়া হয়; আর এর একমাত্র কারণ হল নিয়ত।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক যুদ্ধের সময় তাবুকে অবস্থান কালে বলেন:

 لَقَدْ تَرَكْتُمْ بِالْمَدِينَةِ أَقْوَامًا مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا ، وَلاَ أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ ، وَلاَ قَطَعْتُمْ مِنْ وَادٍ إِلاَّ وَهُمْ مَعَكُمْ فِيهِ ». قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ وَكَيْفَ يَكُونُونَ مَعَنَا وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ ؟ فَقَالَ : حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ  فَشَرَكُوا بِحُسْنِ النيةِ – رواه أبو داود و البخاري

“তোমরা মদীনাতে এমন সম্প্রদায়কে রেখে এসেছ, যারা কোনো দূরপথ ভ্রমণ করেনি, কোনো অর্থ-সম্পদ খরচ করেনি এবং কোনো উপত্যকাও অতিক্রম করেনি, তবুও তারা তোমাদের সাথে (সাওয়াবে) শরীক রয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রা. নিবেদন করলেন: তারা কিভাবে আমাদের সাথে সাওয়াবের অংশীদার হবে, অথচ তারা মদীনাতেই ছিল? তখন তিনি বললেন: ‘ওযর’ তাদেরকে আটকিয়ে রেখেছিল। (তারা ভালো নিয়তের মাধ্যেমে আমাদের সাথে শরীক হয়েছে)।”[7]

সুতরাং ভালো নিয়তের কারণে গাযী না হয়েও গাযীর মত সাওয়াবে অংশীদার হবে, আর মুজাহিদ না হয়েও মুজাহিদের মত সাওয়াব পাবে। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 إِذَا التَقَى الْمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا فَالْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِى النَّارِ فَقِيلَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ! هَذَا الْقَاتِلُ ، فَمَا بَالُ الْمَقْتُولِ ؟ فَقَالَ :  إِنَّهُ قَدْ أَرَادَ قَتْلَ صَاحِبِهِ  (متفق عليه

“যখন দু’জন মুসলিম তাদের তরবারি নিয়ে মুখোমুখি হবে, তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ে জাহান্নামে যাবে। প্রশ্ন করা হল: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এ হত্যাকারী (তো অপরাধী), কিন্তু নিহত ব্যক্তির কী অপরাধ? তখন তিনি বললেন: কারণ, সে তার সঙ্গীকে হত্যা করার ইচ্ছা (নিয়ত) করেছিল।”[8]

সুতরাং হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মাঝে জাহান্নাম আবশ্যক হওয়ার বিষয়টিকে সমান করে দিল তাদের উভয়ের মন্দ নিয়ত ও খারাপ উদ্দেশ্য। তার নিয়ত যদি খারাপ না হত, তাহলে সে জান্নাতের অধিবাসী হত। অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

( من تَزوَّج بصدَاقٍ لا يَنْوِي أداءَهُ فهو زَانٍ , و من أدَانَ دَيْناً و هو لا يَنْوِي قَضَاءَهُ فهو سارقٌ  (رواه أحمد و ابن ماجه

“যে ব্যক্তি এমন পরিমাণ মোহরের বিনিময়ে বিয়ে করেছে, যা সে পরিশোধ করার নিয়ত নেই, সে ব্যক্তি ব্যভিচারী; আর যে ব্যক্তি এমন ঋণ গ্রহণ করেছে, যা তার পরিশোধ করার ইচ্ছা নেই, সে ব্যক্তি চোর।”[9]

সুতরাং মন্দ নিয়ত বৈধ জিনিসকে হারামে রূপান্তরিত করল এবং জায়েয বিষয়কে নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত করল; আর যা সমস্যামুক্ত ছিল, তা সমস্যাযুক্ত হয়ে গেল।

এ সব কিছুই মুসলিম ব্যক্তি যে নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাব এবং তার বড় ধরনের গুরুত্বের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও নিবিড় আস্থা পোষণ করে, সে বিষয়টিকে আরও মজবুত করে; ফলে সে বিশুদ্ধ নিয়তের উপর তার সকল কর্মকাণ্ডের ভিত রচনা করে; ঠিক অনুরূপভাবে সে সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করে যাতে তার একটি কাজও নিয়ত ছাড়া বা বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া সংঘটিত না হয়; কারণ, নিয়ত হলো কর্মের প্রাণ ও ভিত্তি; সুতরাং নিয়ত সঠিক তো কাজও সঠিক, আর নিয়ত শুদ্ধ নয় তো কাজও শুদ্ধ নয়; আর কর্তার বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কাজ হলো মোনাফেকী, কৃত্রিম, নিন্দিত ও ঘৃণিত।

আর অনুরূপভাবে মুসলিম ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, আমলসমূহ বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম রুকন ও শর্ত হলো নিয়ত; তারপর সে মনে করে যে, নিয়ত শুধু মুখে (হে আল্লাহ! আমি এরূপ নিয়ত করেছি) উচ্চারণ করার নাম নয়, আবার নিয়ত বলতে শুধু মনের ভাবকেই বুঝায় না, বরং নিয়ত হলো সঠিক উদ্দেশ্যে— উপকার হাসিল বা ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথাযথ কাজের প্রতি মনের ঝোঁক বা জাগরণ এবং অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অথবা তাঁর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া।

আর মুসলিম ব্যক্তি যখন বিশ্বাস করে যে, ভালো নিয়তের কারণে বৈধ কাজ প্রতিদান ও সাওয়াবের উপযুক্ত আনুগত্যে পরিণত হয় এবং বিশুদ্ধ নিয়তের অভাবে সাওয়াবের কাজও গুনাহ্ ও শাস্তির উপযুক্ত অন্যায় ও অবাধ্যতায় পরিণত হয়, তখন সে মনে করে না যে, অন্যায় ও অবাধ্যতার ক্ষেত্রে ভালো নিয়তের ফলে তা সাওয়াবের কাজে পরিণত হয়; সুতরাং যিনি কোনো ব্যক্তির গিবত করবেন অপর কোনো ব্যক্তির মন ভালো করার জন্য, তিনি এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবেন, তার তথা কথিত ভালো নিয়ত এখানে তার কোনো উপকারে আসবে না; আর যে ব্যক্তি হারাম অর্থ দ্বারা মাসজিদ নির্মাণ করবে, তাকে এ কাজের জন্য সাওয়াব দেয়া হবে না; আর যে ব্যক্তি নাচ-গান ও রঙ্গ-তামাশার অনুষ্ঠানে হাজির হয় জিহাদ ও অনুরূপ কোনো কাজে উৎসাহ পাওয়ার জন্য অথবা লটারীর টিকেট ক্রয় করে কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহিত করার নিয়তে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে এবং সাওয়াব পাওয়ার পরিবর্তে গুনাহগার হবে; আর যে ব্যক্তি সৎ ব্যক্তিগণের প্রতি ভালোবাসার নিয়তে তাদের কবরের উপর গম্বুজ তৈরি করবে অথবা তাদের উদ্দেশ্যে পশু যবাই করবে অথবা তাদের জন্য মানত করবে, সে ব্যক্তিও তার এ কাজের জন্য আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে, যদিও তার ধারণা মতে তার নিয়তটি ভালো হয়ে থাকে; কারণ, অনুমোদিত ‘মুবাহ’ (বৈধ) কাজের ক্ষেত্রে ছাড়া অন্য কোনো কাজই সৎ নিয়তের কারণে সাওয়াবের কাজ বলে গণ্য হবে না; আর হারাম কাজ তো কোনো অবস্থাতেই সাওয়াবের কাজে রূপান্তরিত হবে না।[10]


[1] সূরা আল-বায়্যেনা, আয়াত: ৫

[2] সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১

[3] বুখারী, হাদিস নং- ১; মুসলিম, হাদিস নং- ৫০৩৬

[4] মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭০৮

[5] মুসলিম, হাদিস নং- ৩৫৪

[6] ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৪২২৮; তিনি হাদিসটি উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন।

[7] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৫১০; বুখারী, হাদিস নং- ৪১৬১

[8] বুখারী, হাদিস নং- ৩১ ও ৬৬৭২; মুসলিম, হাদিস নং- ৭৪৩৪

[9] হাদসটি ইমাম আহমাদ ও ইবনু মাজাহ রহ. বর্ণনা করেছেন এবং ইবনু মাজাহ রহ. ‘মোহর’-এর বিষয়টিকে বাদ দিয়ে শুধু ‘ঋণ’-এর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বর্ণনা করেছেন।

[10] আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, দারুশ্ শুরুক, জেদ্দা, চতুর্থ সংস্করণ, দশম মুদ্রণ: ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ. ১০৩

একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৫

$
0
0

DawahMission_Gloucester_FB-01

লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০

পরনিন্দা (গীবত)

গীবত পরিচিতি

গীবত(غيبة) আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ-কুৎসা, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরোক্ষে নিন্দা ইত্যাদি। কারো অগোচরে তার পোশাক-পরিচ্ছদ, বংশ, চরিত্র, দেহাকৃতি, কর্ম, দ্বীন, চলাফেরা, ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে কোন দোষ অপরের কাছে প্রকাশ করা।

ইবনুল আছীর রহ. বলেছেন :

গীবত হলো কোন মানুষের অগোচরে তার মন্দ বিষয় উল্লেখ করা, যদিও সে ত্রুটি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।৪৩

এ প্রসঙ্গে হাসান বসরী (রহ.) বলেন :

পরচর্চায় তিন ধরণের পাপ হতে পারে। অপরের মধ্যে যে দোষ বিদ্যমান তা আলোচনা করা গীবত; যে ত্রুটি তার মধ্যে নেই তা আলোচনা করা অপবাদ; আর তার সম্বন্ধে যা কিছু শ্রুত তা আলোচনা করা মিথ্যা বলার শামিল।৪৪

গীবতের পরিচয় সম্পর্কে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

“মুত্তালিব ইবনু আব্দিল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ  বলেছেন :

عن المطلب بن عبد الله قال : قال رسول الله صلي الله عليه وسلم: الغيبة أن تذكر الرجل بما فيه من خلفه

গিবত হলো কোনো ব্যক্তি সম্বন্ধে তার অগোচরে এমন কিছু বলা যা তার মধ্যে বিদ্যমান।”৪৫

হাদীসের অপর এক বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدْ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ

“আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ () জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? সাহাবায়েকিরাম রা. উত্তর করলেন : আল্লাহ ও তদীয় রাসূলই সম্যক জ্ঞাত। তিনি বললেন : গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা তাকে নাখোশ করবে। জানতে চাওয়া হলো : যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে তা বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি? তিনি জবাবে বললেন : তোমার ভাইয়ের মধ্যে যা কিছু বিদ্যমান তা বললেই গীবত হবে; অন্যথায় তুমি তাকে অপবাদ দিলে।”৪৬ 

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الْغِيبَةُ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَه 

আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ  বলেছেন : গিবত হলো তোমার ভাই সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা সে অপছন্দ করে।৪৭

গিবত সংঘটিত হওয়ার উদাহরণ

গিবত সাধারণত মুখ দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে। কারণ গিবত হলো অপরের অগোচরে তার সম্বন্ধে অপছন্দনীয়। তবে মুখ ছাড়া মানব দেহের যে সকল অঙ্গ ব্যবহার করে অন্যের দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা হয় তাও গিবতের পর্যায়ভূক্ত। যেমন হাতের ইঙ্গিত ও লেখনি; চোখের ইঙ্গিত; পা দ্বারা অভিনয় করে অন্যকে হেয় করা গিবতের শামিল। এ ছাড়া কান দ্বারা গিবত শ্রবণ করা বা অন্তরে অন্তরে অপরের দোষক্রুতি চর্চা করা বা তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা সহ তার মর্যাদাহানিকর সকল চর্চাই মুখের গিবতের সমপর্যায়ের।

হাদীসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন : জনৈকা মহিলা আমাদের কাছে এসেছিল। তার চলে যাওয়ার পর আমি হাতের ইশারায় তার খর্বতার কথা উল্লেখ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ () বললেন : তুমি ঐ মহিলার গিবত করলে।

  • এমনিভাবে খঞ্জ বা টেরা চক্ষু বিশিষ্ট কোন ব্যক্তির চলন ও চাহনি অনুসরণে কেউ খুড়িয়ে চললে বা টেরা চক্ষে তাকালে উক্ত ব্যক্তির গিবত করা হয়। তবে ব্যক্তি বিশেষের নামোল্লেখ না করে যদি কেউ সাধারণভাবে বলে যে, খঞ্জ ব্যক্তি এভাবে হাটে, টেরা চক্ষু বিশিষ্ট ব্যক্তি এভাবে তাকায় এবং তাতে দর্শকগণ বিশেষ কারো চলন ও চাহনি বুঝতে না পারে তাহলে তা গিবত হবে না। অর্থাৎ আকার-ইঙ্গিতে নিন্দিত ব্যক্তিকে চেনা গেলে তা গিবত হবে; অন্যথায় গিবত হবে না।
  • লেখনির মাধ্যমে গিবত : কলম মানুষের মনের অনুভূতি প্রকাশের একটি মাধ্যম। তাই মুখের দ্বারা যেমন গিবত সংঘটিত হয় তেমনি লেখনির মাধ্যমেও গিবত হয়ে থাকে। যেমন  শরয়ী উপকার বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত বেহুদা অন্যের দোষ-ত্রুটি লেখনির মাধ্যমে প্রচার করা গিবতের শামিল। তবে বিশেষ কাউকে নির্দিষ্ট না করে কোন দল বা গোষ্ঠির গঠনমূলক সমালোচনা করায় কোন দোষ নেই। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স.) কোন জাতি বা গোষ্ঠীর কোন কাজকে অপছন্দ করলে বলতেন : ঐ লোকগুলোর কি হলো যে তারা এসব কাজ করছে।
  • অন্তর দ্বারা গিবত: অন্তরের গিবত হলো মনে মনে কারো সম্বন্ধে কু-ধারণা পোষণ করা। পবিত্র কুর’আন ও হাদীসে এ কু-ধারণা থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ

“তোমরা অধিকাংশ ধারণা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই কতক ধারণা পাপের কাজ।”[সূরা হুজুরাত ১২]

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

عَن ْأبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله ِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ

আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল  বলেছেন : তোমরা ধারণা পোষণ থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই ধারণা করা কঠিনতম মিথ্যা।৪৮

এছাড়া কখনও এমন হয় যে, গিবতকারী কারো নাম উল্লেখ না করে এভাবে বলে, আজ আমার নিকট যে লোকটি এসেছিল সে এরূপ বা একজন মানুষের এরকম ত্রুটি রয়েছে আমি তার নাম বলবো না তবে আপনারা বুঝে থাকলে বুঝতে পারেন। এক্ষেত্রে গিবতকারী এ ধরণের উক্তিকে গিবত বহির্ভূত মনে করে; কিন্তু বাস্তবে তা গিবতের অন্তর্ভূক্ত।

  • কৌশলগত গিবত : এ ধরণের গিবত অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরিপক্ক আলিম ও দ্বীনদার লোকদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তারা মনে করে যে, এতে কোন দোষ নেই বা এটা গিবতের অন্তর্ভূক্ত নয়; প্রকৃত পক্ষে তা মারাত্মক ও জঘন্য গিবত। যেমন তাদের সামনে কোন ব্যক্তির উল্লেখ করা হলে বলে : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমারেদকে রাজা-বাদশাহদের দ্বারস্থ হওয়া ও তুচ্ছ জিনিসের জন্য নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয়ার মতো পরীক্ষায় ফেলেন নাই। অথবা এভাবে বলে : আল্লাহ তায়ালার কাছে নির্লজ্জতা বা লজ্জাহীনতা থেকে পানাহ চাই; আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেন।

এসকল উক্তির দ্বারা দু’ধরণের অপরাধ হয়। একটি গিবত, অপরটি রিয়া বা লৌকিকতা। অর্থাৎ অপরের ত্রুটি বর্ণনার পাশাপাশি নিজের প্রশংসা নিহিত থাকে এ ধরণের উক্তির মধ্যে।

আবার কখনো এমন হয় যে, তাদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা বলে: সুবহানাল্লাহ ! কি আশ্চর্য! লোকটিকে তো আমরা ভাল বলেই জানতাম, তার দ্বারা এসব অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে ! আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রক্ষা করুন। এ সকল উক্তির দ্বারা একদিকে গিবতকারীকে সত্যায়ন করা হয় এবং তাকে উৎসাহ দেয়া হয়। অপরদিকে যারা এখনো নিন্দিত ব্যক্তির অপকর্ম জানতে পারেনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং তাদেরকে তা অবগত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। এমনিভাবে তাদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা বলে : আল্লাহ আমাদিগকে তাওবা করার তাওফীক দিন। এসকল উক্তি দ্বারা নিজেদের জন্য বা গিবতকৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়; বরং অন্যের গিবত প্রসার ও নিজের প্রশংসার জন্যই এমনটি বলা হয়ে থাকে যা বাস্তবতার আলোকে অনুমেয়। কারণ কারো কল্যাণের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্য থাকলে তা জনসমক্ষে উক্ত ব্যক্তির নিন্দা করার সময় না করে নির্জনে করাই শ্রেয়।৪৯

এছাড়া উপরোক্ত শ্রেণীর গিবতকারীদের গিবতের সাথে কপটতাও বিদ্যমান। কারণ বাহ্যত তার প্রতিক্রিয়া নিন্দিত ব্যক্তির স্বপক্ষে মনে হলেও বাস্তবে তার বিপরীত। এধরণের লোকদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা গিবতকারীকে বলে “ চুপ কর, গিবত করিওনা” এ উক্তির দ্বারা প্রকৃতপক্ষে গিবতের প্রতি অবজ্ঞা বা প্রতিবাদ উদ্দেশ্য হলে ভাল কথা; অন্যথায় তা নিফাকী বা কপটতা হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ শ্রোতা মণ্ডলী এই তিরষ্কারের কারণ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হলে নিন্দিত ব্যক্তির দোষ আরো অধিক প্রকাশিত হয়ে পড়বে এবং তাতে সে নিজেও গিবতকারীর সমপর্যায়ের অপরাধী হবে।৫০

বুহতান পরিচিতি

বুহতান (بهتان) আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ-অপবাদ, দুর্নাম, মিথ্যা, রটনা ইত্যাদি। ইসলামের চিরস্থায়ী বিধান হলো, কারো প্রশংসা করতে হলে তার অসাক্ষাতে আর সমালোচনা করতে হলে সাক্ষাতে করতে হয়। এ বিধান লংঘন করে যখনই কারো অসাক্ষাতে নিন্দা, সমালোচনা বা কুৎসা রটানো হয়, তখন তা শরীয়াত বিরোধী কাজে পরিণত হয়। এ ধরনের কাজ তিন রকমের হতে পারে এবং তিনটিই কবীরা গুনাহ। প্রথমত: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ বা দোষ আরোপ করা হয়, তা যদি মিথ্যা, বা প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণহীন হয়, তবে তা নিছক অপবাদ। আরবীতে একে বুহতান বা কাযাফ বলা হয়।

এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে :

আবূ হুরায়রা রা. বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ () জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা কি জান গীবত কী? সাহাবায়েকিরাম বললেন : আল্লাহ ও তার রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন : গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হবে। বলা হলো : যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে তা বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? তিনি জবাবে বললেন : তোমার ভাইয়ের মধ্যে যা কিছু বিদ্যমান তা বললে গীবত হবে; আর তা না থাকলে বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ হবে।৫১

গীবতের শরয়ী বিধান

ইসলামী শরীয়াতে গীবত হারাম। এ প্রসেঙ্গ মহান আল্লাহ বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ .

“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অনেক অনুমান বর্জন কর। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান পাপ।  আর তোমরা কারও দোষ অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা তো অবশ্যই তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”৫২

এ প্রসঙ্গে হাদীসের অনেক বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় এসেছে :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : মি’রাজের রাত্রিতে আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে গমনের সময় দেখলাম তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষের গোশ্ত পিতল বা তামার নখ দ্বারা ছিন্ন করছে। আমি জিব্রাঈলের কাছে জানতে চাইলাম এরা কারা? তিনি বললেন : ওরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করতো ও তাদের সম্মান হরণ করতো।৫৩ 

হাদীসের অপর এক বর্ণনায় এসেছে :

عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلْ الْإِيمَانُ قَلْبَهُ لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلَا تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعُ اللَّهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعْ اللَّهُ عَوْرَتَهُ  َفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ

আবু বারযা আসলামী ও বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : হে মু’মিন সম্প্রদায়! যারা মুখে ঈমানের অঙ্গীকার করেছো; কিন্তু এখনো তা অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা মুসলমানদের অগোচরে তাদের নিন্দা করো না এবং তাদের দোষ অন্বেষণ করো না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার দোষ অন্বেষণ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যার দোষ অন্বেষণ করেন তাকে স্বীয় গৃহে লাঞ্ছিত করেন।৫৪

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেছেন :

আমি যদি কারো গিবত করতে চাই তাহলে আমি আমার পিতা-মাতার গিবত করবো। কারণ তারা আমার পুণ্য পাওয়ার ব্যাপারে অধিক হক্বদার।

ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন :

আমরা আমাদের পূর্বসূরীদেরকে দেখেছি যে, তাঁরা নামায ও রোযার মত মহৎ ইবাদাতের চাইতেও পরনিন্দা গিবত পরিত্যাগ করাকে বড় ইবাদাত মনে করতেন। জনৈক ব্যক্তিকে বলা হলো যে, অমুক আপনার গিবত করেছেন। বিনিময়ে তিনি গিবতকারীর জন্য একঝুঁড়ি খেজুর পাঠালেন এবং বললেন : আমার কাছে এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, আপনি আপনার পুণ্য আমার কাছে হাদিয়া পাঠিয়েছেন, তাই আমি এই খেজুরের মাধ্যমে প্রতিদান দিতে ইচ্ছা পোষণ করছি। তবে পূর্ণ বিনিময় না দিতে পারার কারণে আমি ওজরখাহি করছি।

হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন :

আল্লাহর কসম! মু’মিন ব্যক্তির দ্বীনের মধ্যে পরনিন্দার প্রচলনের কুপ্রভাব মানব দেহে বসন্তের ফোস্কার চাইতেও দ্রুত প্রসার লাভকারী। তিনি আরো বলেছেন : হে আদম সন্তান! তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানের সন্ধান পাবে না যতক্ষণ না তুমি নিজে যে দোষে দুষ্ট সে দোষের কারণে অপরের গিবত পরিত্যাগ না করো এবং নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টা না করো। আর যখন তুমি নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টায় লিপ্ত হবে তখন তাতেই তুমি ব্যস্ত থাকবে। এবং এ জাতীয় ব্যক্তিই আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক প্রিয়। এক ব্যক্তি তাকে বললো : আপনি আমার গিবত করছেন। উত্তরে তিনি বললেন : তোমার মর্যাদা আমার কাছে এ পর্যন্ত পৌঁছায়নি যে, আমার পুণ্যের মধ্যে তোমাকে অংশীদার বানাব।

একদল লোক খাবার মজলিসে বসে খাদ্য গ্রহণ করছেন। এমতাবস্থায় একজনের গিবত করা হলো। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল যে, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষরা গোশত ভক্ষণের পূর্বে রুটি খেত, আর তোমরা রুটি খাওয়ার পূর্বেই গোশত ভক্ষণ করছো’’। এখানে গিবতকে গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। একব্যক্তি তার বন্ধুর সামনে অপরের মন্দ বিষয় উল্লেখ করলে বন্ধু তাকে জিজ্ঞেসা করলো : তুমি কি রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ? তিনি উত্তরে বললেন : না। বন্ধু আবার প্রশ্ন করলো : তুমি কি তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছো? উত্তরে তিনি বললেন : না। অতঃপর বন্ধু বললো : তোমার আক্রমণ থেকে রোমান ও তুর্কীরা রেহাই পেলো; কিন্তু তোমার মুসলিম ভ্রাতা রেহাই পেলো না।

বিভিন্ন মনীষীগণ বলেছেন : তিনটি কাজ করতে তুমি অপারগ হলে অন্য তিনটি কাজ তোমাকে করতে হবে। তুমি কল্যাণমূলক কিছু করতে অক্ষম হলে অকল্যাণমূলক কাজ থেকে বিরত থাকবে। মানুষের উপকার করতে অপারগ হলে তোমার অনিষ্টতা থেকে তাদেরকে মুক্তি দিবে। আর তুমি রোযা পালন করতে অক্ষম হলেও মানুষের গোশত ভক্ষণ করবে না।

মালেক ইবনে দীনার বলেছেন : একদা ঈসা (আ.) স্বীয় সহচরদের নিয়ে একটি মৃত কুকুরের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। সহচরগণ বললেন : কুকুরটি কতই না দুর্গন্ধময়! ঈসা (আ.) বললেন: কিন্তু উহার দাঁতের শুভ্রতা খুবই চমৎকার। এখানে কোন মানুষের মন্দ দিক নিয়ে আলোচনার চাইতে তার ভাল দিকটি তুলে ধরার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

গীবতের কারণ

যে সকল কারণে গীবত তথা পরনিন্দা সংঘটিত হয়ে থাকে সেগুলো হলো :

১. গিবত বা পরনিন্দার প্রধান বা অন্যতম কারণ হলো ক্রোধ। কেউ কারো প্রতি ক্রুদ্ধ হলে সে অবলীলায় তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতে থাকে। সত্য-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তবের তোয়াক্কা না করে মনে যা আসে তাই ব্যক্ত করতে থাকে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে গিবতের মাধ্যমেই ক্রোধ নিবারণ করে থাকে সাধারণ লোকেরা। অবশ্য যারা দ্বীনদার, পরহেযগার ও আলিম এবং গিবতের ভয়াবহতা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল তারা অন্যভাবে ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করে থাকেন।

২. গিবতের আরেকটি কারণ বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীদের সাথে তাল মিলানো এবং তাদের সন্তুষ্টি অর্জন। অর্থাৎ সাথীরা যখন পরনিন্দায় লিপ্ত হয় তখন তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গিবতে জড়িয়ে পড়ে অনেকে। কারণ সে মনে করে যে, এ ব্যাপারে বন্ধুদের সাথে দ্বিমত করলে তাদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বা অসন্তোষ জন্মাতে পারে। এভাবে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে ও অপরের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে কেবলমাত্র বন্ধুদের মনতুষ্টির জন্য গিবত করা কতটা অযৌক্তিক বা অগ্রাহ্য তা সকলকে ভাবা উচিত।

৩. নিজের দোষত্রুটি লুকানোর উদ্দেশ্যে অন্যের গিবত করা হয় কখনো কখনো। যেমন কোন ব্যক্তি জানতে পারলো যে, কেউ তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোন বিচারালয়ে বা আদালতে সাক্ষ্য দেবে বা বিবৃতি দেবে তখন সে ঐ ব্যক্তির গিবত বা নিন্দা করতে থাকে যাতে তার সাক্ষ্যের গুরুত্ব লাঘব হয়ে যায় এবং তার বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য ও পরিত্যাহ্য হয়।

৪. নিজের অপকর্মকে যৌক্তিক প্রমাণ করা বা নিজেকে দোষমুক্ত করার জন্য গিবত বা পরনিন্দার মতো পাপে লিপ্ত হয় অনেকে। যেমন কোন ব্যক্তি নিজে অপরাধ করে এবং তা থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য বলে, অমুক ব্যক্তি ওতো এ অন্যায় করেছে। উপরন্তু আমার এ কাজ করার পিছনে বিশেষ কারণ ছিল; কিন্তু তার তো তাও ছিলনা। মনে রাখতে হবে যে, এ ধরনের পরনিন্দাকারী দু’টি পাপের কাজ সংঘটিত করলো। প্রথমত : সে পাপ কাজে লিপ্ত হলো; দ্বিতীয়ত : নিজেকে দোষ মুক্ত করার জন্য অন্যের গিবত করলো। এতদোভয়ের মধ্যে দ্বিতীয় পাপটি অধিকতর জঘন্য।

৫. গিবত করার আরেকটি কারণ হলো নিজেকে বড় করে জাহির করা। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে কেউ কেউ অন্যকে হেয় ও তুচ্ছ হিসেবে উপস্থাপন করে। যেমন তারা বলে : অমুক ব্যক্তি মূর্খ বা স্বল্পবুদ্ধি। অমুক দুর্বল চিত্তের লোক, অমুকের কথায় কী যায় আসে ? অমুকের কী মূল্য আছে? এ সকল উক্তির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিজের প্রশংসা করা হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে অন্যের নিন্দা করা হয়, যা অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দিত কাজ।

৬. গিবতের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো ঈর্ষা ও পরশ্রিকাতরতা। কতক লোকের স্বভাব এরকম যে, অন্যের সুনাম, সুখ্যাতি এবং সুযশ মোটেই সহ্য হয়না। কোন লোকের উন্নতি সাধিত হলে বা স্বীয় কীর্তির জন্য অভিনন্দিত হতে দেখলে হিংসার দাবানলে জ্বলে উঠে তার অন্তর। তখন ঐ নন্দিত ব্যক্তিকে খাটো করার জন্য তার দোষ অন্বেষণ ও জনসম্মুখে তা প্রচারে লিপ্ত হয় সে। এ ক্ষেত্রে তার লক্ষ্য থাকে কীর্তিমান লোকটিকে হেয় ও তুচ্ছ করে উপস্থাপন করা এবং তার সুখ্যাতিকে ম্লান করে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে নিন্দুক নিজেই গিবত ও হিংসার মতো দু’টি জঘন্য পাপে লিপ্ত হলো; কিন্তু এতে নিন্দিত ব্যক্তির কোন ক্ষতি হবে না।

৭. হাসি-তামাশা, কৌতুক ও রসিকতার মাধ্যমে কখনো কখনো গিবত করা হয়ে থাকে। যেমন লোকদেরকে হাসানোর জন্য ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে অন্যের ত্রুটি প্রকাশ করা। এ ধরণের গিবতের মূল কারণ হলো অহংকার ও আত্মগরিমা।

৮. গিবত বা পরনিন্দার প্রত্যক্ষ কারণ সমূহের আরেকটি হলো মানুষের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। অনেক সময় মানুষ অন্যকে কলঙ্কিত ও অপদস্থ করার উদ্দেশ্য তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রুপে মত্ত হয়। এখানে স্মর্তব্য যে, উপহাসক উপহাসের মাধ্যমে অপরকে লোকের নিকট যতটুকু অপদস্থ করছে সে নিজে আল্লাহর নিকট তদপেক্ষা বেশী অপদস্থ হচ্ছে।

৯. গিবত সংঘটিত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো বেকারত্ব। মানুষ যখন কর্মহীন থাকে তখন তার সময় কাটে না। সময় অতিবাহিত হয় না বলে বিরক্তির উদ্রেক হয়। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তখন অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠে এবং গিবত করতে থাকে।

১০. প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নৈকট্য লাভের জন্য সহকর্মীদের সমালোচনা করা। এতে নিজেকে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ও বড় পদে আসীন হওয়ার আকাঙ্খা লুকায়িত থাকে।

১১. গিবতের আরেকটি কারণ হলো দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্ম তৃপ্তি এবং স্বীয় ভুল-ত্রুটি নিয়ে ভাবনাহীনতা। এক ধরণের মানুষ আছে যারা নিজেদের শত অপরাধ সত্ত্বেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না; বরং সর্বদা অন্যের দোষ তালাশ করে বেড়ায়।

১২. ধর্মীয় অনুভূতি থেকে কোন মানুষ অন্যের অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ভুল সংশোধনের জন্য আশ্চার্যন্বিত হয়ে বলতে থাকে : অমুক এ কাজ করতে পারলো!  তার একাজ করা উচিত হয়নি। তার একাজ পরিত্যাগ করা উচিত। এক্ষেত্রে তার এ প্রতিবাদ প্রশংসার্হ; কিন্তু অপরাধীর নামোল্লেখ করার কারণে সে অনিচ্ছাকৃতভাবে গিবত করার অপরাধে অপরাধী হবে এবং গুণাহগার হবে।

১৩. কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন বা দয়ার্দ হওয়া। যেমন কারো পাপ দেখে চিন্তাগ্রস্থ হওয়া ও দুঃখ প্রকাশ করা। এতে গিবত করা বা পাপীকে হেয় করা উদ্দেশ্য থাকে না। কাজটি শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়। কিন্তু শয়তান বিদ্বেষবশত : পাপী ব্যক্তির নামোল্লেখ করতে প্ররোচিত করে এবং অসতর্কতাবশত লোকটি ভাল নিয়ত থাকা সত্ত্বেও গিবতের  অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে পুণ্য লাভের আশায় তিনি যে অপর মু’মিন ভাইয়ের পাপাচারের জন্য দুঃখ ও সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন তা গিবতের পাপে ধ্বংস হয়ে গেল।

১৪. পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কারো প্রতি ক্রোধান্বিত হওয়া। এটা নিঃসন্দেহে খুব সাওয়াবের কাজ। কিন্তু এখানে পাপীর নামোল্লেখ করলে গিবতের অন্তর্ভূক্ত হবে এবং পুণ্যের পরিবর্তে পাপ হবে; বরং করণীয় হলো পাপীকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা এবং তার পাপ গোপন রাখা ও তা অন্যের সামনে প্রকাশ না করা। এ শেষোক্ত  তিনটি কারণ এত সুক্ষ্ম যে, সাধারণ লোকতো দূরের কথা আলিম সমাজ ও তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুস্কর। কারণ তারা মনে করে যে, কারো পাপে আশ্চার্যন্বিত হওয়া, করুণা প্রদর্শন করা বা ক্রোধান্বিত হওয়া যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় হয় তাহলে পাপীর নামোল্লেখে দোষ নেই; অথচ নামোল্লেখের কারণেই পুণ্য লাভের প্রত্যাশা গিবতের পাপে ব্যর্থ হয়ে গেল।৫৫

এ ছাড়া নিম্নোক্ত কারণেও মানুষের পরস্পরের মধ্যে গীবত সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন :

১. রাগ

২. অপরের সন্তুষ্টি অর্জন

৩. দোষ-ত্রুটি লুকানো

৪. নিজেকে দোষমুক্ত করার

৫. নিজেকে বড় বলে দাবি করা

৬. হিংসা :

৭. দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্মতৃপ্তি এবং স্বীয় ভুল-ত্রুটি নিয়ে ভাবনাহীনতা

৮. কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন বা দয়ার্দ হওয়া

পরনিন্দার কুফল

গীবত একটি ভাইরাসের মত, যা একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রামকের মত বাহিত হয়। অর্থাৎ একজনের দোষ অপর একজনের নিকট বললে সে আবার ঐ দোষ অন্য আরেকজনের নিকট প্রকাশ করে থাকে। আর এতে সমাজে অনেক কুফল পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। গীবতের কুফল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ

“ ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অনেক অনুমান বর্জন কর। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান পাপ।  আর তোমরা কারও দোষ অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা তো অবশ্যই তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”৫৬

আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :

মায়েজ আল-আসলামী (রা.) রাসূলুল্লাহ () এর কাছে এসে চার চার বার নিজের ব্যভিচারের কথা বললেন। প্রত্যেকবারই আল্লার রাসূল () তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সর্বশেষে রাসূল () তার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। তিনি বললেন : আমি চাই আপনি আমার উপর হদ প্রয়োগ করে আমাকে পবিত্র করুন। অতঃপর তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হদ প্রয়োগের নির্দেশ দিলেন রাসূলুল্লাহ () এবং তা বাস্তবায়িত হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ () দু’জন আনসারীকে বলাবলি করতে শুনলেন যে, অমুক ব্যক্তির অপরাধ আল্লাহ তা‘আলা লুকিয়ে রাখলেন অথচ সে নিজে তা প্রকাশ করার কারণে তাকে কুকুরের মতো প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা হলো। বর্ণনাকারী বলেন : এ কথা শ্রবণ করার পর তিনি নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর কিছু সময় পথ চললেন। পথিমধ্যে একটি মৃত গাধার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি ঐ ব্যক্তিদ্বয়ের খোঁজ করলেন। তারা বললেন : আমরা উপস্থিত আছি। তিনি বললেন : তোমরা দু’জনে এ মৃত গাধার মাংস ভক্ষণ করো। তারা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। কেউ কি এই জিনিস ভক্ষণ করে নাকি? জবাবে রাসূলুল্লাহ () বললেন : কিছুক্ষণ পূর্বে তোমরা যে ব্যক্তির সম্মান হরণ করলে তা এই মৃত গাধার মাংস ভক্ষণের চাইতেও কঠিন ও ভয়াবহ। যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, সেতো (মায়েজ আসলামী) এখন বেহেশতের নহর সমূহে সাতরিয়ে বেড়াচ্ছে।৫৭

গীবতের কূফল সম্পর্কে হাদীসের এক বর্ণনায় জানা যায় যে,

عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلْ الْإِيمَانُ قَلْبَهُ لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلَا تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعُ اللَّهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعْ اللَّهُ عَوْرَتَهُ  َفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ

“বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : হে মু’মিন সম্প্রদায়! যারা মুখে ঈমানের অঙ্গিকার করেছো; কিন্তু এখনো তা অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা মুসলমানদের অগোচরে তাদের নিন্দা করো না এবং তাদের দোষ খোঁজ করে বেড়াইও না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার দোষ তালাশ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যার ছিদ্রান্বেষণ করেন তাকে স্বীয় গৃহে লাঞ্ছিত করেন।” ৫৮

অপর এক হাদীসে এসেছে :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ.

“আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : মি’রাজের রাত্রিতে আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে গমনের সময় দেখলাম তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষের গোশ্ত পিতল বা তামার নখ দ্বারা ছিন্ন করছে। আমি জিব্রাঈলের কাছে জানতে চাইলাম এরা কারা? তিনি বললেন : ওরা মানুষের গোশ্ত ভক্ষণ করতো ও তাদের সম্মান হরণ করতো।”৫৯

উপরোক্ত বর্ণনার ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, গিবত একটি জঘন্য কবীরা গুনাহ, যা বান্দার হকের সাথে জড়িত। আর আল্লাহর হকের চাইতে বান্দার হক্ব নষ্ট করা অধিক ভয়াবহ যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না।

গীবত শ্রবণ করার বিধান ও শাস্তি

গিবত করা সর্বসম্মতভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ। অনুরূপভাবে গিবত শ্রবণ করাও হারাম ও নিষিদ্ধ কর্ম। কারণ মানুষের চক্ষু, কর্ণ ও অন্তর সবকিছুই স্বীয় কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا .

“নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।”৬০

আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.) বলেন :

ক্বিয়ামতের দিন কান, চক্ষু ও অন্তঃ করণকে প্রশ্ন করা হবে। কানকে প্রশ্ন করা হবে : তুমি সারা জীবন কি কি শুনেছ? চক্ষুকে প্রশ্ন করা হবে : তুমি সারা জীবন কি কি দেখেছ? অন্তঃকরণকে প্রশ্ন করা হবে : তুমি সারা জীবন মনে কি কি কল্পনা করেছ এবং কি কি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ? যদি কান দ্বারা শরীয়ত বিরোধী কথাবার্তা শুনে থাকে; যেমন কারও গিবত এবং হারাম গানবাদ্য কিংবা চক্ষু দ্বারা শরীয়ত বিরোধী বস্তু দেখে থাকে; যেমন বেগানা স্ত্রীলোক বা শুশ্রী বালকের প্রতি কু-দৃষ্টি করা কিংবা অন্তরে কুর’আন ও সুন্নাহ বিরোধী বিশ্বাসকে স্থান দিয়ে থাকে অথবা কারো সম্পর্কে প্রমাণ ছাড়া কোন অভিযোগ মনে কায়েম করে থাকে, তবে এ প্রশ্নের ফলে আযাব ভোগ করতে হবে।

এছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মু’মিনগনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :

وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ

“তারা (মু’মিনরা) যখন অবাঞ্ছিত বাজে কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”৬১

এখানে আয়াতটি বর্ণনামূলক হলেও তা দ্বারা মু’মিনদেরকে অনর্থক ও বাজে কথা শ্রবণ থেকে নিষেধ করার নির্দেশতুল্য।

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনগণের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ইরশাদ করেন :

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ

“এবং যারা অনর্থক কথাবার্তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বা নির্লিপ্ত থাকে।”৬২

অধিকন্তু হাদীসে গিবতকারী ও গিবত শ্রবণকারী উভয়কে সমভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তা থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পুর্বোল্লেখিত আনাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে আবূ বকর ও উমার (রা.) একে অপরে খাদেমের অতি নিদ্রার কথা বলাবলি করার কারণে রাসূলুল্লাহ () তাঁদের উভয়কেই বলেছিলেন : আমি তোমাদের দাঁতের সাথে তার (খাদেমের) গোশত দেখতে পাচ্ছি।

এমনিভাবে মায়েজ আসলামীর রজম বা প্রস্তর নিক্ষেপে হদ কায়েম সংক্রান্ত হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, তাঁকে রজম করার পর একজন আনসারী অন্য আনসারী সাহাবীর সাথে এতদবিষয়ে সমালোচনা করে গিবতের অপরাধ করেছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ () গিবতকারী ও গিবত শ্রবণকারী উভয়কে ডেকে পাঠালেন এবং মৃত গাধার মাংস ভক্ষণের আহ্বান জানালেন।

গীবত শ্রবণকারীর কর্তব্য

গিবত করা ও কোন প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া ব্যতিরেকে গিবত শ্রবণ করা একই ধরণের অপরাধ; এবং উভয় অপরাধের শাস্তিও একই রকম। তাই এই অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে হলে অন্য যে কোন অন্যায় বা শরীয়াত বিরোধী কর্মের সাথে যে আচরণ একজন মু’মিনের কাছে কাম্য গিবত শ্রবণকারীকেও ঠিক সেই ভূমিকা রাখা উচিত। হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

عن أبي سَعِيدٍ قال سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ.

“আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ  ইরশাদ করেছেন : তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ অবলোকন করে সে হাত (শক্তি) দ্বারা তা প্রতিহত করবে। তাতে সে সক্ষম না হলে মুখ দ্বারা প্রতিবাদ করবে। তাতেও সক্ষম না হলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। এবং এটা হলো ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।”৬৩

গিবতকারীর গিবতের প্রতিবাদ করার প্রথম পদক্ষেপ হলো তাকে হিকমত ও প্রজ্ঞার সাথে নিষেধ করা। তাতে কাজ না হলে গিবতের মজলিস পরিত্যাগ করা। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন :

وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آَيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ.

“যখন আপনি তাদেরকে দেখেন, যারা আমার আয়াতসমূহে ছিদ্রান্বেষণ করে, তখন তাদের কাছ থেকে সরে যান যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় প্রবৃত্ত হয়। যদি শয়তান আপনাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেমদের সাথে উপবেশন করবেন না।”৬৪

উপরোক্ত আয়াতে শরীয়ত গর্হিত যে কোন কাজ বা কথা চর্চা হয় এমন মজলিস পরিত্যাগ করা এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই মতে যে স্থানে কোন মু’মিনের অগোচরে তার দোষ-ক্রটি চর্চা হয় এবং তার সম্মান হানি করা হয় সেই স্থান ত্যাগ করা অন্য মু’মিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

এখানে স্মর্তব্য যে, নিন্দিত ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকায় গিবতের মাধ্যমে মর্যাদা বিনষ্ট করার যে নগ্ন পায়তারা চালানো হচ্ছে তা থেকে উদ্ধার প্রচেষ্টা বা তার মর্যাদা অক্ষুণ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা একজন  মু’মিনের কাছে কাম্য। এবং এ জন্য অনেক পুণ্যের অঙ্গীকার রয়েছে হাদীস শরীফে।

আবূ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি স্বীয় ভ্রাতার মর্যাদা হানির প্রতিবাদ করবে দোযখের আগুন থেকে তাকে রক্ষা করা হবে।

আসমা বিনতে ইয়াযিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন : রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন:

যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অগোচরে তাকে সম্মান হানি থেকে বাঁচাবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিবেন।

অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মর্যাদা রক্ষা করবে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার মুখমণ্ডলকে আগুন থেকে রক্ষা করবেন।

মুয়াজ ইবনে আনাস রা. থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি মুনাফিকের অনিষ্টতা থেকে কোন মু’মিন ব্যক্তিকে রক্ষা করবে (আমার মনে হয় তিনি বলেছেন) ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামের অগ্নি থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা প্রেরণ করবেন।

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :

যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তাকে সাহায্য করবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে সাহায্য করবেন।

কোন কোন ক্ষেত্রে গীবত বৈধ

গীবত একটি নিষিদ্ধকর্ম। কারণ গীবতের মাধ্যমে অনুপস্থিত ব্যক্তির সম্মান বিনষ্ট করা ও তাকে হেয় বা তুচ্ছ করার অপচেষ্টা বৈ আর কোন কাজ হয় না। এতে ইহলৌকিক বা পারলৌকিক কোন সুনিশ্চিত কল্যাণ নিহিত নেই। তবে কোন ব্যক্তির অগোচরে তার দোষ-ক্রটি বর্ণনার মধ্যে যদি অন্য কোন মঙ্গল লুক্বায়িত থাকে; কিংবা কোন দুস্কৃতিকারী, চরিত্রহীন, বদমেজাজী, সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তির অনিষ্টতা থেকে অন্যকে রক্ষা করার কোন মন্ত্র লুক্বায়িত থাকে সেই ক্ষেত্রে ঐ দোষী ব্যক্তির দোষ উল্লেখ করাতে কোন বাঁধা নেই।

অবশ্য এই ক্ষেত্রে যাতে শরীয়াতের সীমা লঙ্ঘিত না হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত আবশ্যক। নিম্নে গীবত বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রসমূহ আলোকপাত করা হলো:

১. বাদশাহ বা বিচারকের নিকট বিচার প্রার্থীরূপে উৎপীড়কের উৎপীড়নের বিষয় বলা বৈধ। এমনিভাবে যার কাছে উৎপীড়নের বিষয় বললে তিনি তার কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা দ্বারা তা থেকে পরিত্রাণ দিতে বা লাঘব করতে সক্ষম তার কাছেও অভিযোগ পেশ করা যেতে পারে।

২. এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

لَا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَنْ ظُلِمَ وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا

“আল্লাহ কোন মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। আল্লাহ শ্রবণকারী, বিজ্ঞ।”৬৫

এখানে অত্যাচারিত বা উৎপীড়িত ব্যক্তিকে নিজের আত্মরক্ষা বা জুলুম-নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণ লাভের স্বার্থে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ হাদীসে আবূ সুফিয়ানের দোষ-বা বদ স্বভাব উল্লেখ করাতে রাসূল () হিন্দাকে বাধা দেন নাই বা তিরষ্কার করেন নাই। যা এই কর্মের বৈধতার দলীল। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেন :

যার অধিকার বিনষ্ট হয় তার কথা বলার অধিকার রয়েছে।

এতে বোঝা গেল উৎপীড়িত, অত্যাচারিত বা অধিকার বঞ্চিত ব্যক্তি স্বীয় অধিকার আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে উৎপীড়ক বা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতে পারবে। তবে যার কাছে অভিযোগ করলে জুলুম বা উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই এমন ব্যক্তির কাছে অভিযোগ পেশ না করাই সঙ্গত।

তাবেয়ী আউফ (রহ.) বলেন : আমি মুহাম্মদ ইবনু সীরীনের কাছে হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলাম। তিনি বললেন : আল্লাহ তা‘আলা ন্যায় বিচারক। তিনি হাজ্জাজ থেকে যেরূপ প্রজা নিপীড়নের নিমিত্তে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন, তদ্রুপ তিনি তার নিন্দুক থেকেও তার নিন্দার প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।৬৬

৩. কোন অন্যায় ও অসঙ্গত কাজের মূলোৎপাটন কল্পে বা কোন পাপাচারী ব্যক্তিকে তার পাপকর্ম থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এমন ব্যক্তির কাছে অভিযোগ করা যার দ্বারা এই উদ্দেশ্য সাধিত হবে। যেমন : অভিযোগকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলবে : অমুক ব্যক্তি এই অন্যায় কাজে লিপ্ত, তাকে উক্ত কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখুন। তবে এই ক্ষেত্রে অন্যায় বা অপকর্মের অবসান বৈ-অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে তা বৈধ হবে না।

৪. ফতোয়া বা শরীয়াতের বিধান প্রার্থনাকল্পে মুফতীর নিকট অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বা তার দোষ-বর্ণনা করলে গীবত হয় না। যেমন : কোন ব্যক্তি মুফতীকে বললো : আমার পিতা বা ভাই বা স্বামী বা অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এ ধরণের আচরণ করছে। শরীয়াতের দৃষ্টিতে এর বিধান কি? আমি কিভাবে তাদের বা তার এই আচরণ বা অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাবো? বা কিভাবে আমার অধিকার বুঝে নেব এবং তাদের অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি পাব? এই সব ক্ষেত্রে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে তার অগোচারে অভিযোগ পেশ করলে গিবত হয় না। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির নামোল্লেখ না করে কার্যসিদ্ধি সম্ভব হলে সেটাই উত্তম। যেমন : বাদী এসে মুফতীকে এইভাবে জিজ্ঞেসা করবে : অমুক ব্যক্তি তার ছেলে বা ভাই বা স্ত্রী বা সন্তানের সাথে এইরূপ আচরণ করছে তার ব্যাপারে শরীয়াতের বিধান কি? তাবে নামোল্লেখে কোন দেষ নেই। যেমনটি আমরা পূর্বোক্ত হযরত আয়শা (রা.) বর্ণিত আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দের হাদীসে লক্ষ্য করেছি।

৫. অনিষ্টকর ব্যক্তির ক্ষতি থেকে কোন লোককে বিশেষত কোন মুসলমানকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তার দোষ উল্লেখ করা বৈধ। কারণ এটা ঈমানের দাবীর আওতায় পড়ে। কেননা সম্ভাব্য বিপদ থেকে কোন মুসলিম ভাইকে সতর্ক করে দেয়া তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারের শামিল। এই বিষয়ে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে : যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে পৃথিবীর কোন বিপদ থেকে রক্ষা করবে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিনের বিপদ থেকে তাকে মুক্ত করবেন।

গীবতের কাফফারা

গীবতের পাপ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য গীবতকারীকে তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে এবং তাওবার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ক্ষমা অর্জনের চেষ্টা করবে। এরপর নিন্দিত ব্যক্তির সাথে আলোচনা করে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে অত্যন্ত লজ্জিত ও ব্যথিত চিত্তে। আর যদি লৌকিকতার খাতিরে প্রকাশ্যে লজ্জিত হওয়ার ভান করলো; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে লজ্জিত হল না, তহলে সে আরেকটি পাপ কাজ করলো।

হাসান বসরী (রহ.) বলেন : নিন্দিত ব্যক্তির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেই যথেষ্ট হবে; তার কাছ থেকে দায় মুক্ত হওয়ার আবশ্যকতা নেই।

মুজাহিদ (রহ.) বলেন : তোমর ভ্রাতার গোশত ভক্ষণের (গীবত) কাফ্ফারা হলো তুমি তার প্রশংসা করবে এবং তার কল্যাণের জন্য দু‘আ করবে।

গীবতের তাওবা সম্পর্কে আতা ইবনে আবী রাবাহ এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন : গীবতের পাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তুমি নিন্দিত ব্যক্তির কাছে গিয়ে তাকে বলবে, আমি যা বলেছি মিথ্যা বলেছি এবং তোমার উপর যুলুম করেছি ও অসদাচরণ করেছি। এখন তুমি চাইলে তোমার হক বুঝে নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করতে পারো; নতুবা ক্ষমা করে দিতে পারো। উপরোক্ত অভিমতসমূহ উল্লেখ করার পর ইমাম গাযযালী (রহ.) এই শেষোক্তটিকে অধিক বিশুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন।৬৭

কোন কোন মনীষী বলেছেন যে, মান-সম্মান নষ্টের কোন বিনিময় নেই। তাই সম্পদ নষ্ট করলে যেমন তা ফিরিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে হবে সম্মান নষ্টের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। ইমাম গাযযালী (রহ.) এ মতকে দুর্বল হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন : সম্মান নষ্টের ক্ষেত্রেও জবাবদিহিতার বিধান রয়েছে। যেমন : মিথ্যা অপবাদের শাস্তি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে একটি বিশুদ্ধ হাদীসের দিক নির্দেশনা রয়েছে। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের ধন-সম্পদ বা সম্মানের ক্ষতি করে তার উপর যুলুম করেছে ক্বিয়ামতের দিবস আসার পূর্বেই যেন তা শুধরিয়ে নিয়ে দায়মুক্ত হয়ে যায়। কারণ সেদিন দিনার ও দিরহামের কোন লেনদেন থাকবে না। আর যদি সে তা না করে তাহলে তার পুণ্যসমূহ তার সঙ্গীকে দিয়ে দেয়া হবে। আর যদি তার কোন পুণ্য না থাকে তাহলে তার সঙ্গীর পাপসমূহ তার পাপের সাথে যুক্ত করে দেয়া হবে।

যদি নিন্দিত ব্যক্তি জীবিত থাকে এবং তার কাছে নিন্দুক নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনার পরিবেশ থাকে ও অন্য কোন সংকট বা ফেৎনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা না থাকে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে যেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করাই উত্তম। আর যদি নিন্দিত ব্যক্তি জীবিত না থাকে বা তার কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার পরিবেশ নিশ্চিত না হয়, তাহলে ঐ ব্যক্তির জন্য দু‘আ করবে, তার পাপ মোচনের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে এবং নিজে বেশী বেশী করে পুণ্য অর্জনের চেষ্টা করবে। এ ছাড়া নিন্দিত ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা লাভের পরিবেশ তৈরী করার জন্য বেশী বেশী করে তার প্রশংসা করবে। তার প্রতি প্রীতি এবং অধিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে এবং তাকে সন্তষ্ট করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। আর যদি কোন ক্রমেই এ সব চেষ্টা সফল না হয় অর্থাৎ নিন্দিত ব্যক্তির হৃদয় না গলে তাহলে তার এ প্রচেষ্টার জন্য পুণ্য লাভ করবে যা ক্বিয়ামতের দিন গীবতের পাপের মোকাবিলায় কাজে আসবে।

এবার প্রশ্ন হলো গীবতকারী ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রর নিন্দিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তাকে মাফ করে দেয়ার বিধান কি? নিন্দিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নিন্দাকারীকে ক্ষমা করা ওয়াজিব না হলেও অতি উত্তম ও মহৎ কাজ।৬৮

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল () কে ক্ষমা প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছেন এবং ক্ষমাশীলতাকে মু’মিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল-কুর’আনে বলা হয়েছে :

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ 

“ক্ষমার অভ্যাস গড়ে তোল, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং জাহেলদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।”৬৯

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ

“তারাই মুত্তাকী যারা নিজেদের রাগ সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে।”[সূরা আলে ইমরান ১৩৪]

তাছাড়া নিন্দিত ব্যক্তি নিন্দাকারীকে ক্ষমা করা বা দায়মুক্ত করার নিমিত্তে নিজেকে এ ভাবে প্রস্তুত করতে পারে যে, যা ঘটার ঘটে গেছে, এর প্রতিশোধ নেয়াও সম্ভব নয়। তাই একজন মু’মিন ভাইকে দায়মুক্ত করে পুণ্য লাভের প্রত্যাশায় থাকাই শ্রেয়। মহান আল্লাহ বলেন :

وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

“অবশ্যই যে সবর করে ও ক্ষমা করে নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।”[সূরা আশ শুরা ৪৩]

মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ () ও এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রা.) বর্ণিত হাদীসে তিঁনি বলেছেন: তিনটি বিষয়ে আমি শপথ করছি। আর তাহলো : সাদক্বা  সম্পদকে হ্রাস করে না। অতএব তোমরা দান করো। কোন ব্যক্তি অত্যাচারিত হয়ে অত্যাচারীকে ক্ষমা করে দিলে আল্লাহ তার সম্মান বাড়িয়ে দেন। অতএব তোমরা ক্ষমা প্রদর্শন করো; আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সম্মান বৃদ্ধি করবেন। আর কোন ব্যক্তি অন্যের কাছে কিছু চাওয়ার অভ্যাস করলে আল্লাহ তা‘আলা তার দরিদ্রতার পথ উন্মুক্ত করে দিবেন।

অন্য একটি হাদীসে রাসূলূল্লাহ () বলেছেন : তোমরা দয়া করো; তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে এবং তোমরা ক্ষমা করো; তোমাদেরকেও ক্ষমা করা হবে।

তিনি আরো বলেছেন : যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হয় না। যিনি ক্ষমা করেন না, তাকে ক্ষমা করা হয় না। আর যিনি তাওবা করেন না, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করেন না।

উকবা ইবনু আমের (রা). বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ () এর সাথে সাক্ষাত করতে গেলে তিনি আমাকে বললেন : হে উকবা ইবনু আমের! যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করো। যিনি তোমাকে বঞ্চিত করে, তুমি তাকে দান করো। যে তোমার উপর অত্যাচার করে তুমি তাকে ক্ষমা করো।

হাসান ইবনু আলী (রা). বলেন : কোন ব্যক্তি যদি আমার এক কানে গালি দেয় আর অন্য কানে এসে ওযরখাহী করে, আমি তার ওযর গ্রহণ করবো।

হাসান থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, মু’মিনের চরিত্রের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমা প্রদর্শন করা।

আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মদ ইবনু  যিয়াদ বলেন : আমি ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বলের কাছে ছিলাম, এমন সময় এক ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে বললেন : হে আবূ আব্দুল্লাহ ! আমি আপনার গীবত করেছি, আমাকে দায়মুক্ত করুন। তিনি বললেন : গীবতের পুনরাবৃত্তি না করার শর্তে তোমাকে দায়মুক্ত করা হলো। আমি বললাম : হে আবূ আব্দুল্লাহ! লোকটি আপনার গীবত করলো আর আপনি তাকে দায়মুক্ত করে দিলেন? তিনি বললেন : তুমি দেখনি যে, আমি শর্ত আরোপ করেছি?৭০ 

আল্লামা মুনাবী ইবনু আব্দুস সালামের বরাতে একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন, তাহলো : লজ্জিত ও অনুতপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করা বা দায়মুক্ত করা মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে নির্দেশিত ইহসানের অন্তর্ভূক্ত।

গীবত থেকে বাঁচার উপায়

এক. গীবতের কূফল সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া :

গিবতের মতো জঘন্য পাপ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার জন্য কুর’আন ও হাদীসে বর্ণিত গিবতের ক্ষতিকারক দিক- যেমন : পুণ্য লাঘব; নিন্দিত ব্যক্তির পাপের বোঝা বহন ও পরকালীন শাস্তি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিশেষ মনযোগের সাথে পাঠ করত এর মর্ম সম্যকরূপে উপলব্ধি করা এবং তদনুযায়ী নিজের করণীয় নির্ধারণ করা।

দুই. পরের দোষ নয় নিজের দোষ আগে অনুসন্ধান করা

স্বীয় দোষ অনুসন্ধান করা। যদি নিজের মধ্যে দোষ পাওয়া যায় তাহলে মনে করতে হবে অপরের দোষ থাকাও অসম্ভব নয়। তাছাড়া নিজে কোন দোষে দুষ্ট হয়ে অপরের দোষের নিন্দা করাও এক ধরণের নির্লজ্জতা বৈ কিছু নয়। আর প্রকৃত পক্ষেই যদি নিজে নির্দোষ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়ে থাকে তাহলে যিনি এ তাওফীক দান করলেন সে মহান বিধাতার শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতায় মস্তক অবনত রাখতে হবে। নিজেকে নির্দোষ মনে করার অজুহাতে অন্যের দোষ অন্বেষণ বা চর্চা করে মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করার মতো পাপে লিপ্ত হওয়া আদৌ ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে যে, অন্যের দ্বারা নিজের সমালোচনা হলে যেমন কষ্ট পাওয়া যায় তেমনি অন্য ব্যক্তিও অনুরূপ কষ্ট পেয়ে থাকে। সর্বোপরি নিজেকে নির্দোষ মনে করা ও অপরকে দোষী সাব্যস্ত করাও এক প্রকার শয়তানী প্ররোচনা। কারণ কোন মানুষই সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিষ্পাপ থাকতে পারে না। আর জন্মগতভাবে মানুষের মধ্যে যে সব ত্র“টি বিদ্যমান যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয় যেমন খঞ্জ, অন্ধ, বধির ইত্যাদি- এগুলোর সমালোচনা করা বা তা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হেয় করা প্রকৃত পক্ষে মহান স্রষ্টার নিন্দা করার শামিল।৭১

তিন. ক্রোধ দমন করা

যেহেতু গীবতের যতগুলো কারণ রয়েছে তন্মধ্যে ক্রোধও একটি উল্লেখ্যযোগ্য কারণ। তাই ক্রোধ সংবরণ গিবত থেকে পরিত্রাণ লাভের একটি উপায়। ক্রোধের বশবতী হয়ে অন্যের নিন্দায় লিপ্ত হওয়া এবং তজ্জন্য আল্লাহ ও রাসূলের ক্রোধের পাত্র হওয়া কোন সুবিবেচক ব্যক্তির জন্য শোভনীয় নয়। ক্রোধান্বিত হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটলে তা থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য পবিত্র কুর’আন ও হাদীসে ক্রোধ সংবরণের মর্যাদা সংক্রান্ত উক্তির কথা স্মরণ করতে হবে। তাহলে ক্রোধের সার্বিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকী বা পরহেযগারদের চরিত্র উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন :

وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ

আর যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে।৭২ 

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

من كظم غيظا و هو قادر على أن ينفذه دعاه الله على رءوس الخلائق حتى يخيره من الحور العين يزوجه منها ما شاء 

যে ব্যক্তি ক্রোধ প্রকাশ ও তদনুযায়ী কাজ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা দমন করল আল্লাহ তা‘আলা তাকে ( কিয়ামত দিবসে) সৃষ্টিকূলের সামনে ডেকে পাঠাবেন এবং তার পছন্দমতো হুরের সাথে তাকে বিয়ে দিবেন।৭৩

চার. অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা

আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা না করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন বা বন্ধু-বান্ধবের মন জোগানোর বাসনা পরিত্যাগ করা। মনে রাখতে হবে যে, মানুষের মনতুষ্টির চেষ্টায় আল্লাহ তা‘আলার বিরাগ ভাজন হওয়া নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা ও মুর্খতার কাজ। অথচ ঈমানের দাবী হলো এর বিপরীত, অর্থাৎ মানুষের অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা না করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সচেষ্ট হওয়া।

রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে মানুষের মুখাপেক্ষি করেন না; পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় তাকে মানুষের দায়িত্বে ছেড়ে দেন।৭৪

পাঁচ. সর্বদা আল্লাহকে ভয় করা

নিজেকে পবিত্র প্রমাণ করার জন্য অন্যের গিবত করে তার মর্যাদাহানির উদ্যোগ নেয়ার সময় স্মরণ করা উচিত যে, সৃষ্টিজগতের বিরাগভাজন হওয়ার চাইতে মহান স্রষ্টার বিরাগভাজন হওয়া অধিক ভয়ঙ্কর। মানুষের কাছে নিজের চরিত্রকে কলুষমুক্ত করতে অন্যের গিবতে লিপ্ত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির পাত্র হওয়া নির্বুদ্ধিতা ও বোকামির নামান্তর। উপরন্তু যে উদ্দেশ্য এ অপকর্ম করা হলো তারও কোন নিশ্চয়তা নেই অর্থাৎ অপরের গিবত করে নিজেকে পুতপবিত্র প্রমাণ করা ও জনরোষ বা জন অসন্তুষ্টি থেকে নিজেকে হেফাযত করার যে উদ্দেশ্য তা হাসিল নাও হতে পারে।

ছয়. সর্বদা নিজের অপরাধ স্বীকার করা

নিজের অপরাধকে হালকা প্রমাণ করা বা অপরাধ সংঘটনের খোড়া যুক্তি হিসেবে অন্যের দ্বারা উক্ত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে গিবত করার যে প্রবণতা তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য স্মরণ করা উচিত যে, অন্য লোক হারাম ভক্ষণ করলেও তোমার জন্য তা ভক্ষণের বৈধতা অর্জিত হয় না। যেহেতু তুমি এমন ব্যক্তির অনুসরণের যুক্তি পেশ করলে যার অনুসরণ বৈধ নয়। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ লঙ্ঘন করে সে যেই হোক না কেন তার অনুসরণ অবৈধ। যদি কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আগুনে ঝাপ দেয় তুমি তো জ্ঞান থাকা অবস্থায় তা অনুসরণ করবে না, তাহলে অন্য ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত পাপকে দলিল হিসেবে দাঁড় করিয়ে সে পাপে লিপ্ত হওয়ার স্পর্ধা তুমি কোথায় পেলে? সর্বোপরি এতে দু’ধরণের পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার পথ সুগম করলে তুমি। প্রথমত : গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া; দ্বিতীয়ত: উক্ত কাজকে বৈধতা প্রদান বা তাকে লঘু সাব্যস্ত করার জন্য অন্য ব্যক্তির গিবত করা যার দ্বারা একই গুণাহর কাজ সংঘটিত হয়েছে।

সাত. কাউকে তুচ্ছ মনে না করা

নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্য যারা অন্যকে হেয় ও তুচ্ছ হিসেবে উপস্থাপন করে এবং গিবতের মতো জঘন্য পাপে লিপ্ত হয় তাদের মনে রাখা দরকার যে, যে উদ্দেশ্যে সে অন্যের গিবত করলো, তার মর্যাদা হানি ঘটালো সে উদ্দেশ্য-অর্থাৎ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ-সাময়িকভাবে অজ্ঞ ও নিম্ন শ্রেণীর লোকদের কাছে সাধিত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এছাড়া জ্ঞানী ও উচ্চ শ্রেণীর লোকদের সামনে কেউ অন্যের নিন্দা করলে তারা নিন্দাকারীকে কখনোই মহৎ মনে করে না। ফলে তার উদ্দেশ্য ব্যর্থই রয়ে গেল। উপরন্তু অপরের নিন্দা ও পরোক্ষভাবে আত্ম প্রশংসা করার মাধ্যমে সে মহান আল্লাহর বিরাগ ভাজন ও তাঁর অসন্তুষ্টির পাত্রে পরিণত হলো। তার পরও যদি ধওে নেয়া হয় যে, এ কাজের মাধ্যমে মানুষের কাছে নিজেকে মহৎ ও নিষ্কলঙ্ক প্রমাণ করা সম্ভব, কিন্তু তাও তো একজন মু’মিনের জন্য আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির মোকাবিলায় মূল্যহীন ও তুচ্ছ ব্যাপার মাত্র।

আট. অন্যের ভাল দেখে হিংসা না করা

আর যে ব্যক্তি অন্যের ভাল দেখে ঈর্ষান্বিত হয় এবং হিংসার দাবানলে জ্বলে  উঠে তার অন্তর সেতো ইহকাল ও পরকাল দু’টিই নষ্ট করল। এ বিষয়টি ভাল করে চিন্তা করলেই গিবত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অন্যের মঙ্গলে ঈর্ষান্বিত হয়ে গিবত করার মাধ্যমে হিংসুক তিনটি শাস্তির সমন্বয় ঘটালো। একটি ইহলোকে; অপর দু’টি পরলোকে। ইহলৌকিক শাস্তি বলতে এখানে কারো ধন-সম্পদ এবং মান-সম্মান দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ঈর্ষার আনলে দগ্ধীভূত হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। আর পরলৌকিক শাস্তি বলতে প্রথমত : হিংসার শাস্তি, দ্বিতীয়ত: গিবতের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। হিংসার শাস্তি হাদীস শরীফে এবাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অগ্নি যেভাবে কাষ্ঠকে ভষ্মিভূত করে তেমনি হিংসা মানুষের পুণ্যকে নিঃশেষ করে দেয়।

নয়. জিহ্বাকে সংযত করা

খেল-তামাশা, কৌতুক-রসিকতা ও ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে মানুষের দোষ-ক্রটি বর্ণনা করে উপস্থিত জনতাকে মাতিয়ে তোলা বা হাসির বন্যা বইয়ে দেয়ার জন্য যারা গিবত করে তাদেরকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে, ইসলামে অনর্থক কথা ও কাজের কোন স্থান নেই। উপরন্ত উক্ত কাজের মাধ্যমে যেমন মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে তেমন গিবত ও মানুষের সম্মান বিনষ্ট করার মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ফলে এতেও দু’ধরণের পাপে পড়ছে নিন্দুক। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় মহানবী স. ইরশাদ করেছেন :

عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم: من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه

আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল সা. বলেছেন : অনর্থক কথা ও কাজ ছেড়ে দেয়া ইসলামের অন্যতম শোভাবর্ধক স্বভাব।৭৫

অপর এক হাদীসে এসেছে :

যে ব্যক্তি মিথ্যা কথার মাধ্যমে মানুষদেরকে হাসায় তার জন্য অভিসম্পাত, তার জন্য অভিসম্পাত, তার জন্য অভিসম্পাত।৭৬

দশ. কলঙ্কিত বা নিন্দিত ব্যক্তিকে নিয়ে উপহাস না করা

অপর ব্যক্তিকে কলঙ্কিত ও অপদস্থ করার জন্য তাকে নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রপের মাধ্যমে যে গিবত করা হয় তা থেকে পরিত্রানের জন্য নিন্দুককে জানা উচিত যে সে দুনিয়ার মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে নিন্দিত ব্যক্তিকে অপদস্থ করার বিনিময়ে ক্বিয়ামতের দিন বিশাল জনসমষ্টির সম্মুখে তাকে অপদস্থ, লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হবে। এ ছাড়া এ অপকর্মের কারণে সে আল্লাহ, ফিরিশতা ও নবীগণের কাছে হেয় ও তুচ্ছ হিসেবে বিবেচিত হবে। নিন্দুক যদি ক্বিয়ামতের সে দিনের কথা চিন্তা করে যে দিন উপহাসকৃত ব্যক্তির পাপের বোঝা তাকে বহন করতে হবে এবং জাহান্নামের দিকে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তাহলে সে নিজেই নিজকে নিয়ে উপহাস করত এবং অপর ব্যক্তির উপহাস থেকে বিরত থাকত।৭৭

এগার. অবসর সময় আল্লাহকে বেশি বেশি করে স্মরণ করা

বেকারত্ব ও অবসরের বিরক্তির কারণে কর্মহীন লোকেরা যে গিবত করে থাকে তা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য গিবতকারীকে তার অবসর সময়ে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য, ইবাদত ও উপাসনার মধ্যে অতিবাহিত করা উচিত। তাতে সময়ের সদ্ব্যবহার ও গিবতের পাপ থেকে মুক্তি নিশ্চিত হবে। এ হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

” لا تزول قدما ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس : عن عمره فيما أفناه و عن شبابه فيما أبلاه و ماله من أين اكتسبه و فيما أنفقه و ماذا عمل فيما علم ” 

রাসূল  বলেছেন : ক্বিয়ামতের দিন বনি আদমকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও অতিক্রম করতে দেয়া হবে না। তার জীবন কী কাজে নিঃশেষ করেছে। তার যৌবন কীভাবে অতিবাহিত হয়েছে। সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে এবং কী কাজে ব্যয় করেছে। নিজের ইলম বা বিদ্যা অনুযায়ী আমল করেছে কিনা?৭৮

বার. কাউকে খুশি করতে যেয়ে অন্যকে হেয় না করা

প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নৈকট্য লাভ ও সহকর্মীদের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে গিবত করা হয় তা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে কুর’আন ও হাদীসে উল্লেখিত রিযিক সংক্রান্ত আয়াত ও রাসূলের বাণী স্মরণ করা দরকার এবং তাকদীরের প্রতি বিশ্বাসকে সুর্দঢ় করা উচিত। মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর সকল শক্তি একত্রিত হলেও আল্লাহ তা‘য়ালার ইচ্ছা ব্যতিরেকে কেউ তাকে উপকার করতে পারবে না এবং ক্ষতিসাধনও করতে পারবে না। অতএব কোন মানুষকে খুশি করার জন্য অন্যের গিবত করে আল্লাহ তা‘আলার অসন্তষ্টির পাত্র হওয়া ও নিজের পরকালকে বিপদসংকুল করা বোকামি ও নির্বুদ্ধিতার নামান্তর।৭৯

তের. সর্বদা অন্যের দোষ-ত্রুটির দিকেই খেয়াল না করা

দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্মতৃপ্তির জন্য যে নিজের ক্রটির প্রতি লক্ষ্য করে না; বরং সর্বদাই মানুষের দোষ অন্বেষণে ব্যস্ত থাকে তার স্মরণ করা উচিত যে, নিজে পাপী হয়ে অন্যের পাপ নিয়ে ভাবনা করা কতইনা লজ্জাকর ও নির্বোধসুলভ কাজ। অথচ তার উচিত নিজের দোষ খুঁজে বের করে তা সংশোধনের চেষ্টা করা। আর যদি সে নিজেকে দোষমুক্ত মনে করে তাহলে সেজন্য আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করবে এবং তার প্রশংসা করবে। রাসূলুল্লাহ () পাপকর্মের চাইতে দম্ভ ও অহমকে অধিক নিন্দা করে ইরশাদ করেন : তোমরা যদি পাপ না কর তাহলে আমি এর চাইতেও অধিক ভয়ঙ্কর জিনিস তোমাদের ব্যাপারে আশঙ্কা করছি, আর তা হলো দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্ম তৃপ্তি।

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০


৪৩. ইবনুল আছীর, আন-নিহায়া ফী গারীবিল হাদীছ, ৩য় খ., পৃ. ৩৯৯।
৪৪. গাযযালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৪।
৪৫ ইমাম মালিক, মুয়াত্তা, ৩য় খ., পৃ. ১৫০।
৪৬. মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল বিররি ওয়াচ্ছিলা, বাবু তাহরীমিল গিবা, (কায়রো, দার আররাইয়্যান লিততুরাছ, ১ম সংস্কারণ, ১৪০৭হি./১৯৮৭খ্রী.), ১৬শ খ., পৃ. ১৪২; আবূ দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল আদব, বাবুন ফিল গিবা, (সিরিয়া, দারুল হাদীছ, তাবি.), ৫ম খ., পৃ. ১৯১-১৯২।
৪৭. আলবানী, সহীহুল জামি‘, ২য় খ., পৃ. ৭৭০, হাদীস নং-৪১৮৭।
৪৮. বুখারী, আল-জামে‘ আস-সহীহ, কিতাবুন নিকাহ, বাবু লা ইয়াখতুবু আলা খিতবাতি আখীহি, ৯ম খ., পৃ. ১০৬, হাদীস নং-৫১৪৩।
৪৯. গাজ্জালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৬।
৫০. গাজ্জালী, সৌভাগ্যের পরশমনি, অনু: আব্দুল খালেক, (ঢাকা , ইফাবা প্রকাশনা, ৫ম সংস্করণ, ডিসেম্বর, ২০০৪), ৩য় খ., পৃ. ১০৩।
৫১. আলী ইব্ন হিশামুদ্দীন, কানযুল উম্মাল, খ. ৩, পৃ. ৫৮৪, হাদীস নং-৮০১২।
৫২. আল-কুরআন, সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত : ১২।
৫৩. আবূ দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল আদব, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪, হাদীস নং- ৪৮৪৭।
৫৪. আবূ দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল আদব, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪-১৯৫, হাদীস নং-৪৮৮০; আলবানী, সহীহুল জামে‘, ২য় খ., পৃ. ১৩২২-১৩২৩, হাদীসনং-৭৯৮৪।
৫৫. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৬-১৪৮।
৫৬. আল-কুরআন, ৪৯ : ১২।
৫৭. ৪খ., পৃ. ১৩, হাদীস নং-৪১৬৮।
৫৮. আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪-১৯৫।
৫৯. আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪, হাদীস নং- ৪৮৪৭।
৬০. আল-কুরআন, ১৭ : ৩৬।
৬১. আল-কুরআন, ২৮ :৫৫।
৬২. আল-কুরআন, ২৩ : ৩।
৬৩. মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খন্ড, পৃ.১৬৭, হাদীস নং-৭০।
৬৪. আল-কুরআন, ৬ :৬৮।
৬৫. আল-কুরআন, ৪ : ১৪৮।
৬৬. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৫৩।
৬৭. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৫৩।
৬৮. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৫৩-১৫৪।
৬৯. আল-কুরআন, ৭ : ১৯৯।
৭০. আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৯ম খ., পৃ. ১৭৪; মুহাম্মদ ইবনু আহমদ আল-মুকাদ্দেম, হুরমাতু আহলিল ইলম, পৃ.১১৫।
৭১. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৮; গায্যালী, সৌভাগ্যের পরশমনি, পৃ. ১০৫-১০৬।
৭২. আল-কুরআন, ৩ : ১৩৪।
৭৩. আলবানী, সহীহুল জামে‘, ২য় খ., পৃ. ১১১২, হাদীস নং- ৬৫২২।
৭৪. পৃ. ২য় খণ্ড, ১০৫২, হাদীস নং-৬০৯৭।
৭৫. তিরমিযী, আস-সুনান, কিতাবুয যুহদ, ৪র্থ খ., পৃ. ৪৮৩-৪৮৪, হাদীস নং-৩৩১৭, ৩৩১৮।
৭৬ আলবানী, সহীহুল জামে‘ , ২য় খ., পৃ. ১১৯৯, হাদীস নং-৭১৩৬।
৭৭. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৯-১৫০।
৭৮. আলবানী, সহীহুল জামে‘ , ২য় খ., পৃ. ১২২০-১২২১, হাদীস নং-৭২৯৯।
৭৯. হুসাইন ‘আওয়াইশা, আল-গীবাত, পৃ. ১৪-১৫।

বইঃ বিবাহের মাসায়েল

$
0
0

BibaherMasail

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ ইসলামে বিয়ে মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়, বিয়ের মাধ্যমে বর-কনের নব জীবন শুরু হয়, এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কল্পনাতীত অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয়, পরিবার ও বংশধারা বিস্তার লাভ করে। আবার পৃথিবীর এ উন্নতীর যুগে এসে বিয়ের সাথে যোগ হয়েছে যৌতুকের টানাপোড়ন, অথচ ইসলাম বিয়েকে মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রূপে চিহ্নিত করেছেন এবং এক্ষেত্রে বর ও কনের বাছাই এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য বিভিন্ন নিয়ম নির্ধারণ করেছে। যা অবলম্বনে একটি সুন্দর পরিবার সৃষ্টি হতে পারে; কিন্তু বিয়ের সময় অনেকেই সেদিকে দৃষ্টিপাত করে না আবার যখন সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তখন তা পুর্ণগঠনের জন্য অনেকেই মাসজিদ মাদ্রাসার সরনাপন্ন হয়ে থাকে।

এখানে উর্দূভাষী সুলেখক জনাব ইকবাল কিলানী সাহেব তাঁর “নিকাহ কে মাসায়েল” নামক গ্রন্থে কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে বিয়ে সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেছেন। যা একজন মুসলমানের জন্য এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন এবং এক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য সহায়ক হবে। ইন শাহ আল্লাহ।

বিবাহের মাসায়েল – QuranerAlo Server

বিবাহের মাসায়েল – Mediafire

নিয়ত: একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

$
0
0

intentionflower

শব্দ-বিশ্লেষণ:

নিয়ত আরবী শব্দ (نية বা نيَّة) অর্থ:  اَلْقَصْدُ وَ الْاِرَادَةউদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, অভিলাষ, মনোবাঞ্ছা, মনের ঝোঁক, কোনো কিছু করার ইচ্ছা, কোনো কাজের প্রতি মনকে ধাবিত করা ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলা হয় Intension[1]

ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, মনের মধ্যে কোনো ভাবের উদয় হলে, সে ভাব অনুযায়ী ‘আমল করা কিংবা না করার কোনো দিকেই মন ধাবিত না হলে, মনের ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া সে ভাবকে বলা হয় হাদসুন-নাফস বা ওয়াস্ওয়াসা। আর সে ভাবকে বাস্তবে রূপদানের জন্য মনকে ধাবিত করার নাম ‘হাম্ম’ বা নিয়ত (অভিপ্রায়) এবং মজবুত নিয়তকে বলা হয় ‘আযম তথা সংকল্প।[2] আবার  নিয়ত  (অভিপ্রায়) এবং ইরাদাহ (ইচ্ছা) শব্দ দু’টি বাহ্যত সমার্থক মনে হলেও এবং কখনো কখনো এক অর্থে ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মাঝে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন,

এক. ইরাদাহ (ইচ্ছা)-এর সম্পর্ক নিজের কাজের সাথেই নির্দিষ্ট নয়; বরং অন্যের কাজের সাথেও ইরাদাহ (ইচ্ছা)-এর সম্পর্ক হতে পারে। পক্ষান্তরে নিয়তের সম্পর্ক শুধু নিয়তকারীর কাজের সাথেই হয়ে থাকে। যেমন, এটা বলা চলে যে, “আমি তোমার নিকট এ ধরণের আচরণের ইরাদাহ বা ইচ্ছা (কামনা) করি নি” কিন্তু এভাবে বলা যায় না যে, ‘‘আমি তোমার নিকট এ ধরণের আচরণের নিয়ত বা উদ্দেশ্য করি নি।”

দুই. ইরাদাহ (ইচ্ছা) সম্ভাব্য কাজের ব্যাপারেই কেবল ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে নিয়ত শব্দটি সম্ভব-অসম্ভব সকল কাজের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এজন্যই আল্লাহর ব্যাপারে নিয়ত শব্দের ব্যবহার করা যায় না। যেহেতু তাঁর নিকট সবকিছুই সম্ভব তাই তিনি কোনো কাজ করার ইরাদাহ বা  ইচ্ছা করেন, নিয়ত নয়। তবে যেহেতু কখনো কখনো উভয় শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয় তাই কুরআন মাজীদে অনেক স্থানে আল্লাহ তা‘আলা ইরাদাহ শব্দটিকে নিয়ত অর্থে ব্যবহার করেছেন।[3]

শরী‘আতের দৃষ্টিতে নিয়ত ও তার প্রকারভেদ:

আল্লামা মাওয়ারদী রহ. বলেন:

النية هي قصد الشيء مقترنًا بفعله

“কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট মনের উদ্দেশ্য।”[4]

আল্লামা কাযী বায়যাভী রহ. বলেন:

النية هي عبارة عن انبعاث القلب نحو ما يراه موافقا لغرض من جلب نفع اودفع ضرر حالا اومالا

“বর্তমান বা ভবিষ্যতের ভালো কিংবা খারাপ কোনো স্বার্থের জন্য কোনো কাজের প্রতি মনের অভিনিবেশ।”[5]

অর্থাৎ মানুষ কোনো কাজ করার সময় তার মনের অভ্যন্তরে যে উদ্দেশ্য থাকে, যার কারণে মানুষ কাজটি করার জন্য উদ্ভুদ্ধ হয় সে উদ্দেশ্য বা কারণটিকেই শরী‘আতের পরিভাষায় নিয়ত বলা হয়। কোনো ইবাদত করার সময় সে ইবাদতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সংক্রান্ত মনের ভাব বা অবস্থাই নিয়ত। নিয়ত ভালো কিংবা খারাপ উভয়ই হতে পারে। শরী‘আতের দৃষ্টিতে নিয়ত দু প্রকার।

  • ইখলাস
  • রিয়া

যখন কোনো মানুষ আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত করে তখন সে ইবাদত সংক্রান্ত মনের ঐ অবস্থাকে ইখলাস বলা হয়। আর কেউ লোক দেখানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে ইবাদতকালীন মনের সেই অবস্থাকে বলা হয় রিয়া।

নিয়তের শর‘ঈ বিধান:

ইসলামে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। সকল ইবাদতের জন্য শুরুতে মনে মনে নিয়ত করে নেওয়া আবশ্যক। নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদতই আদায় হবে না।

নিয়তের উদ্দেশ্য:

নিয়তের দু’টি উদ্দেশ্য থাকে:

এক. ‘আমল বা কাজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ। অর্থাৎ ‘আমলের উদ্দেশ্য কি লা-শরীক আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি, নাকি সরাসরি আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো সন্তুষ্টি অথবা আল্লাহর সাথে সাথে অন্য কারো সন্তুষ্টিও? -তার পার্থক্য নিরূপণ করা। উদাহরণত: সালাত আদায় করা। নিয়তের মাধ্যমে সহজে এ পার্থক্য নির্ণয় করা যায় যে, বান্দা কি শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর নির্দেশ পালনার্থেই তা আদায় করছে, নাকি তার সালাত আদায়ের পেছনে লোক-দেখানো কিংবা যশ-খ্যাতি পাওয়ার মতো হীন কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে।

দুই. আমল বা ইবাদতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা অথবা ইবাদতকে অভ্যাসগত নিত্যকর্ম থেকে পৃথক করা। যেমন, যোহরের সালাতকে আসরের সালাত থেকে পৃথক করা এবং রমযান মাসের সাওমকে অন্য মাসের সাওম থেকে পৃথক করা যায় নিয়তের মাধ্যমে। আবার নিয়তের দ্বারাই অপবিত্রতার গোসলকে অভ্যাসগত পরিচ্ছন্নতা ও শীতলতা লাভের গোসল থেকে ভিন্ন করা যায়।

নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-কুরআন

এক. আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ [الزمر: ٢

“তুমি আল্লাহর ইবাদত করো তাঁরই জন্য ইবাদতকে বশুদ্ধ করে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ০২]

তিনি অন্যত্র আরো বলেন:

أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصَُۚ [الزمر: ٣

“জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্ত।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ০৩]

উক্ত আয়াতদ্বয়ে দীন (دين) শব্দটি আনুগত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যকে তারই জন্য খাঁটি করুন। যাতে শির্ক, রিয়া ও যশ-খ্যাতির উদ্দেশ্যের নাম-গন্ধও না থাকে। এরই তাগিদার্থে দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, খাঁটি ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই শোভনীয়। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এর যোগ্য নয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, ‘আমি মাঝে মাঝে দান-খয়রাত করি অথবা কারো প্রতি অনুগ্রহ করি, এতে আমার নিয়ত আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিও থাকে এবং এটাও থাকে যে, মানুষ আমার প্রশংসা করুক।’

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: সে সত্ত্বার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আল্লাহ তা‘আলা এমন কোনো বস্তু কবূল করেন না, যাতে অন্যকে শরীক করা হয়। অতঃপর তিনি প্রমাণস্বরূপ ﴿ أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصَُۚ﴾ [الزمر: ٣] আয়াতখানি তিলাওয়াত করলেন।[6]

বস্তুত নিয়তের একনিষ্ঠতা অনুপাতে আল্লাহর নিকট ‘আমল গৃহীত হয়। কুরআনে কারীমের অনেক আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর কাছে ‘আমলের হিসাব গণনা দ্বারা নয় -ওজন দ্বারা হয়ে থাকে। আর ‘আমলের মূল্যায়ন ওজন নিষ্ঠাপূর্ণ নিয়তের অনুপাতে হয়ে থাকে এবং পূর্ণ খাঁটি নিয়ত এই যে, আল্লাহ ব্যতীত কাউকে লাভ-লোকসানের মালিক গণ্য করা যাবে না। নিজের কাজকর্মে কাউকে ক্ষমতাশীল মনে করা যাবে না এবং কোনো ইবাদত ও আনুগত্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কল্পনা ও ধ্যান করা যাবে না। যে সাহাবায়ে কেরাম মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রথম সারিতে অবস্থিত, তাদের ‘আমলের পরিমাণ তেমন একটা বেশি দেখা যাবে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের সামান্য ‘আমল অবশিষ্ট উম্মতের বড় বড় ‘আমলের চেয়ে উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠ তো তাদের পূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ নিষ্ঠার কারণেই ছিল।[7]

ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারীর  শেষ বাবের শিরোনাম করেছেন:

بَابُ قَوْلِ اللهِ تَعَالَى  – وَنَضَعُ ٱلۡمَوَٰزِينَ ٱلۡقِسۡط [الانبياء: ٤٧

“অধ্যায়: ‘আমি ইনসাফের পাল্লা স্থাপন করবো” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৪৭]

আল্লাহর এ উক্তি।”[8]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ ‘আলেমের মত হলো, কিয়ামতের দিন মানুষের ‘আমলকে ওজন করা হবে; গণনা নয়। আর এ ক্ষেত্রে মানুষের একই ‘আমলের মধ্যে ওজনের কম বেশি হবে তাদের নিয়তের কারণে এবং ‘আমলের মধ্যে ইখলাস কম-বেশি হওয়ার কারণে।

আবদুল্লাহ ইবন মুবারক রহ. বলেন:

رُبَّ عَمَلٍ صَغِيْرٍ تُعَظِّمُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَبِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةِ

“নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র ‘আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। আবার অনেক বৃহৎ ‘আমলকেও তা ক্ষুদ্র করে দেয়।”[9]

নিয়তের গুরুত্ব আমলের চেয়েও বেশি। মানুষের নিয়ত তার ‘আমলের চেয়ে অধিক কার্যকারী। যেমন, এক ব্যক্তি ৬০/৭০ বছর ঈমান অবস্থায় জীবিত ছিলো এবং ইবাদত করল; কিন্তু তার এ নিয়ত ছিলো যে, সে যদি সব সময় জীবিত থাকতো তাহলে ঈমান অবস্থায়ই থাকতো এবং ইবাদত করতে থাকতো। এজন্যই মৃত্যুর পর সে অনন্ত কাল জান্নাতে থাকবে। পক্ষান্তরে বেঈমানরা ৬০/৭০ বছর জীবিত থাকলেও তাদের নিয়তে এটা থাকে যে, তারা যত দিন জীবিত থাকবে বেঈমান অবস্থাতেই থাকবে। তাই তারাও এরূপ বদ-নিয়তের কারণে সব সময় জাহান্নামে থাকবে।[10]

দুই. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ  [الشورا: ٢٠

“যে পরকালের ফসল প্রত্যাশা করে আমরা তার জন্য সে ফসল আরো বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালের ফসল কামনা করে আমরা তাকে এর কিছু দিয়ে দেই। কিন্তু পরকালে তার জন্য কিছু থাকবে না।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২০]

তিন. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

فَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖ [البقرة: ٢٠٠  

“যে সকল লোকেরা বলে যে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে দান করুন। তাদের জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই।” [সূরা  আল-বাকারাহ, আয়াত: ২০০]

চার. অন্য আয়াতে আছে:

لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ  [الحج: ٣٧

“আল্লাহর কাছে কখনো এগুলোর (কুরবানীর) গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের (অন্তরের) তাক্বওয়া।” [সূরা আল-হজ, আয়ত: ৩৭]

কুরবানীর ক্ষেত্রে করবানীর জন্তুর গোশত ও রক্ত নয়; বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে আল্লাহর আদেশ পালন করাই কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতী শফী রহ. লিখেন যে, কুরবানী একটি মহান ইবাদত। কিন্তু আল্লাহর কাছে এর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না এবং করবানীর উদ্দেশ্যও এগুলো নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা এবং পূর্ণ আন্তরিকতাসহ রবের আদেশ পালন করা।[11] অন্যান্য সব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যও তাই। সালাতে উঠা-বসা করা এবং সাওমে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা আসল উদ্দেশ্য নয় । বরং আল্লাহর আদেশ পালন করাই আসল লক্ষ্য। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র।

পাঁচ. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيۡهِمۡ أَعۡمَٰلَهُمۡ فِيهَا وَهُمۡ فِيهَا لَا يُبۡخَسُونَ (١٥) أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيهَا وَبَٰطِلٞ مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ (١٦) [هود: ١٥،  ١٦

“যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের দুনিয়াতে ‘আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেই এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই হল সে সব লোক আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছুই নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে আর যা কিছু উপার্জন করেছিল সবই বিনষ্ট হলো।” [সূরা হূদ, আয়াত: ১৫-১৬]

মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, মায়মুন ইবনে মিহরান ও মুজাহিদ রহ.প্রমুখ উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন: অত্র আয়াতে ঐ সব লোকের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে যারা তাদের যাবতীয় সৎকাজ শুধু পার্থিব ফায়দা হাসিলের জন্য করে থাকে, চাই সে আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসী কাফির হোক অথবা নামধারী মুসলিম হোক, যে পরকালকে মৌখিক স্বীকার করেও কার্যত: সে দিকে কোনো লক্ষ্য রাখে না বরং পার্থিব লাভের দিকেই সম্পূর্ণ মগ্ন ও বিভোর থাকে।[12] সহীহ মুসলিমে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি যুলুম করেন না। সৎকর্মশীল মু‘মিন ব্যক্তিরা দুনিয়াতে আংশিক প্রতিদান লাভ করে থাকে এবং পূর্ণ প্রতিদান আখেরাতে লাভ করবে। আর কাফিররা যেহেতু আখেরাতের কোনো ধ্যান-ধারনাই রাখে না, তাই তাদের প্রাপ্য হিস্যা ইহজীবনেই তাদেরকে পুরোপুরি ভোগ করতে দেওয়া হয়। তাদের সৎ কার্যাবলীর প্রতিদানস্বরূপ তাদেরকে ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশ, বস্তুগত উন্নতি ও ভোগ-বিলাসের সামগ্রী দান করা হয়। অবশেষে যখন আখেরাতে উপস্থিত হবে, তখন সেখানে তাদের প্রাপ্তব্য কিছুই থাকবে না।”[13]

আয়াতটি অবতরণের প্রেক্ষাপট বা শানে নুযূল:

ইসলাম বিরোধীদেরকে যখন ‘আযাবের ভয় দেখানো হতো, তখন তারা নিজেদের দান-খয়রাত, জনসেবা ও জনহিতকর কাজসমূহকে সাফাইরূপে তুলে ধরতো। তারা বলত যে, এতসব সৎকাজ করা সত্ত্বেও আমাদের শাস্তি হবে কেন? উক্ত আয়াতে সে মনোভাবেরই জবাব দেওয়া হয়েছে। জবাবের সারকথা এই যে, প্রতিটি সৎকার্য গ্রহণযোগ্য ও পারলৌকিক মুক্তির কারণ হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে, সেটি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকা মোতাবেক হতে হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তদিয় রাসূলের প্রতি ঈমানই রাখে না ,তার কার্যকলাপ গুণ-গরিমা, নীতি-নৈতিকতা প্রাণহীন দেহের ন্যায়। যার বাহ্যিক আকৃতি অতি সুন্দর হলেও আখেরাতে তার কানাকড়িরও মূল্য নেই। তবে দৃশ্যতঃ সেটা যেহেতু পুণ্যকার্য ছিল এবং তা দ্বারা বহু লোক উপকৃত হয়েছে, তাই আল্লাহ তা‘আলা এহেন তথাকথিত সৎকার্যকে সম্পূর্ণ বিফল ও বিনষ্ট করেন না; বরং এসব লোকের যা মুখ্য উদ্দেশ্য ও কাম্য ছিল যেমন তার সূনাম ও সম্মান বৃদ্ধি হবে, লোকে তাকে দানশীল, মহান ব্যক্তিরূপে স্মরণ করবে, নেতারূপে তাকে বরণ করবে ইত্যাদি আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ইনসাফ ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে তা ইহজীবনেই দান করেন । অপরদিকে আখেরাতে মুক্তি লাভ করা যেহেতু তাদেরও কাম্য ছিলনা এবং প্রাণহীন সৎকার্য আখেরাতের অপূর্ব ও অনন্ত নি‘আমতসমূহের মূল্য হওয়ার যোগ্য ছিলনা, কাজেই আখেরাতে তার কোনো প্রতিদানও লাভ করবে না । বরং নিজেদের কুফরী, শিরকী ও গুনাহের কারণে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল তাদের জ্বলতে হবে।

ছয়. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 فَوَيۡلٞ لِّلۡمُصَلِّينَ (٤) ٱلَّذِينَ هُمۡ عَن صَلَاتِهِمۡ سَاهُونَ (٥) ٱلَّذِينَ هُمۡ يُرَآءُونَ (٦) وَيَمۡنَعُونَ ٱلۡمَاعُونَ (٧)  [الماعون: ٤،  ٧

“অতএব, দুর্ভাগ্য সে সব সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে বে-খবর। যারা তা লোক দেখানোর জন্য করেএবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয় না।” [সূরা আল-মা‘ঊন: ৪-৭]

উক্ত পাঁচটি আয়াতে  সেসব মুনাফিকদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা লোক দেখানো এবং ইসলামের দাবীকে প্রমাণ করার জন্য বাহ্যত সালাতসালাত আদায় করে। কিন্তু তারা যেহেতু সালাতসালাত ফরয হওয়াকেই স্বীকার করে না তাই তারা সময়ের কোনো গুরুত্ব প্রদান করে না। তদ্রূপ মূল সালাতেও অলসতা করে- এবং তারা (مَاعُونَ) তথা যৎকিঞ্চিৎ তুচ্ছ বস্তু যেমন- কুড়াল, কোদাল, রান্না-বান্নার পাত্র, ছুরি ইত্যাদি কার্পন্যবশতঃ প্রতিবেশিদেরকে দেয় না। উক্ত আয়াতগুলোতে এ কথার প্রতি কঠোর সতর্কবাণী রয়েছে যে, লোক দেখানোর জন্য সালাত আদায় বা অন্য কোনো ইবাদত করা মুনাফিকদের স্বভাব।  কোনো মুসলিম যদি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ছাড়া লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করে তবে তা হবে মুনাফিকসুলভ আচরণ। যা সওয়াব প্রাপ্তির যোগ্যতা রাখে না।

সাত. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُۥ فُرُطٗا  (٢٨) [الكهف: ٢٨

“আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের রবকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে। এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নেবেন না এবং যার মনকে আমার স্মরণ হতে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।” [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ২৮]

অর্থাৎআপনি নিজেকে তাদের সাথে বেঁধে রাখুন। সম্পর্ক ও মনোযোগ তাদের প্রতি নিবদ্ধ রাখুন। কাজে কর্মে তাদের থেকেই পরামর্শ নিন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা খাঁটি নিয়তে সকাল সন্ধ্যায় অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবাদত ও জিকির করে। তাদের কার্যকলাপ একান্তভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত।

আট. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 مَّن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡعَاجِلَةَ عَجَّلۡنَا لَهُۥ فِيهَا مَا نَشَآءُ لِمَن نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلۡنَا لَهُۥ جَهَنَّمَ يَصۡلَىٰهَا مَذۡمُومٗا مَّدۡحُورٗا (١٨) وَمَنۡ أَرَادَ ٱلۡأٓخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعۡيَهَا وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ كَانَ سَعۡيُهُم مَّشۡكُورٗا(١٩) [الاسراء: ١٨،  ١٩

“যারা ইহকাল কামনা করে, আমি সে সব লোককে যা ইচ্ছা সত্ত্বর দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে।  আর যারা পরকাল কামনা করে এবং মু‘মিন অবস্থায় তার জন্য যথাযথ চেষ্টা-সাধনা করে, এমন লোকদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে।” [সূরা বানী ইসরাঈল: ১৮-১৯]

উপরোক্ত প্রথম আয়াতটি কাফিরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যারা নিজেদের প্রত্যেক কাজকে ক্রমাগতভাবে ও সদাসর্বদা শুধু ইহকালের উদ্দেশ্যেই আচ্ছন্ন করে রাখে-পরকালের প্রতি কোনোই লক্ষ্য রাখে না। দ্বিতীয় আয়াতে মু‘মিনদের কথা বলা হয়েছে অর্থ এই যে, মু‘মিন যখনই যে কাজে পরকালের ইচ্ছা ও নিয়ত করবে, তার সে কাজ গ্রহণযোগ্য হবে। মু‘মিনের যে কর্ম খাঁটি নিয়ত সহকারে অন্যান্য শর্তানুযায়ী হবে, তা কবুল করা হবে আর  যে কর্ম এরূপ হবে না, তা কবুল করা হবে না।

নয়. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ  [البينة: ٥

“তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামায কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে। আর এটাই সঠিক ধর্ম।” [সূরা আল-বাইয়িনাহ: ০৫]

দশ. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 قُلۡ إِن تُخۡفُواْ مَا فِي صُدُورِكُمۡ أَوۡ تُبۡدُوهُ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ  [ال عمران: ٢٩

“বলুন, তোমাদের মনে যা আছে তা যদি তোমরা গোপন রাখ কিংবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ তা‘আলা তা অবগত আছেন।” [সূরা আলে ইমরান: ২৯]

নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-হাদীস

এক. উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ، وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ

“যাবতীয় কাজ/আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষের তাই প্রাপ্য যার সে নিয়ত করবে। অতএব, যে ব্যক্তির হিজরত আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর রাসূলের জন্য হবে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার জন্য হবে;  তার হিজরত যে নিয়তে করবে তারই জন্য হবে।”[14]

অন্তর্ভুক্তএ হাদীসটি ইসলামী জীবনাচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। মানুষের সকল প্রকার কাজকর্মের গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য হওয়া একমাত্র তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল। যাবতীয় আমলের প্রতিদান পাওয়া না পাওয়া সে আমলকারীর নিয়তের খাঁটি-অখাঁটি হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। এ হাদীস দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শরী‘আতে নিয়তের অবস্থান অতি উঁচু স্থানে। বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হয় না। আমলের শুদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়ত। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা সকল ইবাদতে নিয়তকে খাঁটি করার  নির্দেশ দিয়েছেন। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো আমল কিছুতেই সঠিক হতে পারে না। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত উক্ত হাদীস থেকে এ বিষয়টিও সাব্যস্ত হয় যে, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই কৃতকর্মের ফলাফল লাভ করে। এমনকি সে নিজের ব্যবহারিক জীবনে পানাহার, উপবেশন, নিদ্রা ইত্যাদির ন্যায় যে কাজগুলো সে অভ্যাস-বশে সম্পাদন করে সে সব কাজও সদিচ্ছা এবং সৎ নিয়তের কারণে পুণ্যময় আমলে পরিণত হতে পারে। পারে সওয়াব অর্জনের মাধ্যম হতে। যেমন কেউ হালাল খাবার খাওয়ার সময় উদর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইবাদতের জন্য শক্তি ও সক্ষমতা  লাভের নিয়তও যদি করে নেয় তাহলে এর জন্য সে অবশ্যই সওয়াবের অংশিদার হবে।

এমনিভাবে মনোমুগ্ধকর ও মনোরঞ্জক যে কোনো বৈধ বিষয়ও নেক নিয়তের সঙ্গে উপভোগ করলে তা ইবাদতে রূপান্তরিত হয়। উক্ত হাদীসে এ বিষয়টিও লক্ষ্যনীয় যে, নিয়তের সম্পর্ক অন্তরের সাথে। কাজেই কোনো ইবাদতের সময় ‘নিয়তের দো‘আ’ জাতীয় কিছু  মুখে উচ্চারণ করা যাবে না; কাজের সাথে অন্তরের উদ্দেশ্যেরও সমন্বয় থাকতে হবে। বরং মুখে উচ্চারণের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যেমন, যদি কোনো ব্যক্তি জোহরের সালাত আদায় করার সময় অন্তরে জোহরের সালাত আদায় করার নিয়ত করে আর মুখে অন্য সালাতের কথা এসে যায় । তাহলে তার জোহরের সালাতই আদায় হবে। এতে জোহরের সালাতের নিয়তের কোনো ত্রুটি হবে না।[15]

দুই. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ، فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنْ الْأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، قَالَتْ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ! كَيْفَ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ وَفِيهِمْ أَسْوَاقُهُمْ وَمَنْ لَيْسَ مِنْهُمْ؟ قَالَ: يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، ثُمَّ يُبْعَثُونَ عَلَى نِيَّاتِهِمْ

“একটি বাহিনী কা‘বা ঘরের উপর আক্রমন করার উদ্দেশ্যে বের হবে। অতঃপর যখন তারা সমতল মরুপ্রান্তরে পৌছবে তখন তাদের প্রথম ও শেষ ব্যক্তি সকলকেই যমীনে ধসিয়ে দেয়া হবে । তিনি (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন যে, আমি (এ কথা শুনে) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কেমন করে তাদের প্রথম ও শেষ সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হবে? অথচ তাদের মধ্যে তাদের বাজারের ব্যবসায়ী এবং এমন লোক থাকবে যারা তাদের (আক্রমণকারীদের) অন্তর্ভুক্তঅন্তর্ভুক্ত নয়। তিনি বললেন, তাদের প্রথম ও শেষ সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাদেরকে তাদের নিয়ত অনুযায়ী পুনরুত্থিত করা হবে।”[16]

অর্থাৎ, বাহ্যত কা‘বা ঘরের উপর আক্রমনকারীদের দলভুক্ত থাকার কারণে সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হলেও কিয়ামত দিবসের চূড়ান্ত হিসাব নিয়তের ভিত্তিতেই হবে।

তিন. অন্যত্র আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«لاَ هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا»

“মক্কা বিজয়ের পর (মক্কা থেকে) হিজরত নেই; বরং বাকী আছে জিহাদ ও নিয়ত। সুতরাং যদি তোমাদেরকে জিহাদের জন্য ডাক দেওয়া হয় তাহলে তোমরা বেরিয়ে পড়।”[17]

চার. আবু আব্দুল্লাহ জাবের ইবন আব্দুল্লাহ আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা হতে বর্ণিত; তিনি বলেন:

كُنَّا مَعَ النَّبيِّ ﷺ في غَزَاةٍ، فَقالَ : إِنَّ بالمدِينَةِ لَرِجَالاً ما سِرْتُمْ مَسِيراً، وَلاَ قَطَعْتُمْ وَادِياً، إلاَّ كَانُوا مَعَكمْ حَبَسَهُمُ الْمَرَضُ

“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এক অভিযানে ছিলাম। তিনি বললেন, মদীনাতে কিছু লোক এমন আছে যে, তোমরা যত সফর করছ এবং যে কোনো উপত্যকা অতিক্রম করছ, তারা তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। অসুস্থতা তাদেরকে মদীনায় থাকতে বাধ্য করেছে।”[18]

অর্থাৎ পূর্ণ নিয়ত বা সদিচ্ছা থাকার পরও অসুস্থতার কারণে যারা অভিযানে অংশ নিতে পারে নি, শুধুমাত্র নিয়তের কারণে তারাও অভিযান পরিচালনাকারীদের সমপরিমান সাওয়াবের অধিকারী হবে।

পাঁচ. অন্য হাদীসে এসেছে,

وعَنْ أَبِي يَزيدَ مَعْنِ بنِ يَزيدَ بنِ الأخنسِ رضي الله عنه، وهو وأبوه وَجَدُّه صحابيُّون، قَالَ : كَانَ أبي يَزيدُ أخْرَجَ دَنَانِيرَ يَتَصَدَّقُ بِهَا، فَوَضعَهَا عِنْدَ رَجُلٍ في الْمَسْجِدِ، فَجِئْتُ فأَخذْتُها فَأَتَيْتُهُ بِهَا . فقالَ: واللهِ، مَا إيَّاكَ أرَدْتُ، فَخَاصَمْتُهُ إِلى رسولِ اللهِ ﷺ ، فقَالَ: لكَ مَا نَوَيْتَ يَا يزيدُ، ولَكَ ما أخَذْتَ يَا مَعْنُ

“আবূ ইয়াযীদ মা‘ন ইবনে ইয়াযীদ ইবনে আখনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু- তিনি (মা‘ন) এবং তার পিতা ও দাদা সকলেই সাহাবীবলেন: আমার পিতা ইয়াযীদ দান করার জন্য কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা বের করলেন। অতঃপর তিনি সেগুলো (দান করার জন্য) মসজিদে একটি লোককে দায়িত্ব দিলেন। আমি মসজিদে এসে তার কাছ থেকে অন্যান্য ভিক্ষুকের মত তা নিয়ে নিলাম এবং তা নিয়ে বাড়ি এলাম। (যখন আমার পিতা এ ব্যাপারে অবগত হলেন তখন) বললেন, আল্লাহর কসম! ‘তোমাকে দেওয়ার নিয়ত আমার ছিল না’। ফলে (এগুলো আমার জন্য হালাল হবে কি না তা জানার জন্য) আমি আমার পিতাকে নিয়ে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, ‘হে ইয়াযীদ! তোমার জন্য সে বিনিময় রয়েছে যার নিয়ত তুমি করেছ আর হে মা‘ন! তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্য হালাল’।”[19]

আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা‘আতের সর্বসম্মতিক্রমে আকীদাহ হলো পিতা কর্তৃক নিজ সন্তানকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। এভাবে যাকাত আদায় হবে না।[20] কিন্তু উক্ত হাদীসে দেখা যাচ্ছে, পিতার যাকাতের টাকা পুত্র গ্রহণ করেছে। তথাপি পিতা কর্তৃক পুত্রকে দেওয়ার নিয়ত না থাকার কারণে এবং পুত্রের তা গ্রহণ করার সময় পিতার যাকাত হওয়ার কথা নিয়তে (জানা) না থাকার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে ইয়াযীদ! তোমার জন্য সে বিনিময় রয়েছে যার নিয়ত তুমি করেছ আর হে মা‘ন! তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্য হালাল।

ছয়. অন্য হাদীসে সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাসকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«وَإنَّكَ لَنْ تُنفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغي بِهَا وَجهَ اللهِ إلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّى مَا تَجْعَلُ في فِيِّ امْرَأَتِكَ»

 “মনে রেখ, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তুমি যা ব্যয় করবে তোমাকে তার বিনিময় দেওয়া হবে। এমনকি তুমি যে গ্রাস তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দাও তারও তুমি বিনিময় পাবে।”[21]

স্ত্রীর মুখে গ্রাস তুলে দেওয়া নিত্য প্রয়োজনীয় একটি পার্থিব কাজ মাত্র। তথাপিও নিয়ত বিশুদ্ধ রেখে শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তা করলে তারও বিনিময় বা সাওয়াব পাওয়া যাবে।

সাত. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«إنَّ الله لاَ ينْظُرُ إِلى أجْسَامِكُمْ، وَلاَ إِلَى صُوَرِكمْ، وَلَكن ينْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعمَالِكُم»

“নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও ‘আমল দেখেন।”[22]

অর্থাৎ আমল ও আকৃতি মৌলিক বিষয় নয়; বরং নিয়তই মূল।

আট. আবু মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত:

سُئِلَ رَسُولُ اللهِ ﷺ عَنِ الرَّجُلِ يُقاتلُ شَجَاعَةً، ويُقَاتِلُ حَمِيَّةً، ويُقَاتِلُ رِيَاءً، أَيُّ ذٰلِكَ في سبيلِ الله ؟ فَقَالَ رَسُول الله: مَنْ قَاتَلَ لِتَكونَ كَلِمَةُ اللهِ هي العُلْيَا، فَهوَ في سَبِيلِ اللهِ

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য যুদ্ধ করে, অন্ধ পক্ষপাতিত্বের জন্য যুদ্ধ করে; এবং লোক দেখানোর (সুনাম অর্জনের) জন্য যুদ্ধ করে, এর কোনো যুদ্ধটি আল্লাহর পথে হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার জন্য যুদ্ধ করে একমাত্র তারই যুদ্ধ আল্লাহর পথে হয়।”[23]

দেখুন, অন্ধ পক্ষপাতিত্বের জন্য যুদ্ধ করাও -চাই সেটি মুসলিমদের পক্ষেই হোক না কেন- আল্লাহর পথের জিহাদ নয়। একমাত্র আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার নিয়তই জিহাদ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত।

নয়. আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

إِذَا التَقَى المُسلِمَان بسَيْفَيهِمَا فالقَاتِلُ وَالمَقْتُولُ في النّارِ قُلتُ : يا رَسُولَ اللهِ! هَذا القَاتِلُ فَمَا بَالُ المقْتُولِ ؟ قَالَ: إنَّهُ كَانَ حَريصاً عَلَى قتلِ صَاحِبهِ

“যখন দু‘জন মুসলিম তরবারী নিয়ে পরস্পরে লড়াই করে, তখন হত্যাকারী ও নিহত দু’ জনই জাহান্নামে যাবে। (বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন) আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর জাহান্নামে যাওয়া তো স্পষ্ট; কিন্তু নিহত ব্যক্তির ব্যাপার কী?’ তিনি বললেন, ‘‘সেও তার সঙ্গীকে হত্যা করার জন্য লালায়িত ছিল’’।[24]

দেখুন, নিহত ব্যক্তির প্রতিপক্ষকে হত্যা করার নিয়ত, সংকল্প বা হত্যা করার জন্য লালায়িত থাকাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

দশ. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত:

عَن رَسُول الله ﷺ، فِيمَا يَروِي عَن رَبّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالى، قَالَ: إنَّ اللهَ كَتَبَ الحَسَنَاتِ والسَّيِّئَاتِ ثُمَّ بَيَّنَ ذلِكَ، فَمَنْ هَمَّ بحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَها اللهُ تَبَارَكَ وتَعَالى عِنْدَهُ حَسَنَةً كامِلَةً،وَإنْ هَمَّ بهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ عَشْرَ حَسَناتٍ إِلى سَبْعمئةِ ضِعْفٍ إِلى أَضعَافٍ كَثيرةٍ، وإنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ تَعَالَى عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلةً، وَإنْ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً

“ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বরকতময় মহান রব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ পুণ্য ও পাপসমূহ লিখে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তার ব্যাখ্যাও করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি কোনো নেকী করার সংকল্প করে কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত করতে পারে না, আল্লাহ তা‘আলা (শুধু নিয়ত করার বিনিময়ে) তাকে একটি পূর্ণ নেকী লিখে দেন । আর সে যদি সংকল্প করার পর কাজটি করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার বিনিময়ে দশ থেকে সাতশ গুণ বরং তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি নেকী লিখে দেন। পক্ষান্তরে যদি সে একটি পাপ করার সংকল্প করে কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত না করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার নিকট একটি পূর্ণ নেকী হিসাবে লিখে দেন। আর সে যদি সংকল্প করার পর ঐ পাপ কাজটি করে ফেলে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা মাত্র একটি পাপ লিপিবদ্ধ করেন। [25]

এগার. আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে,

انْطَلَقَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَتَّى أَوَوْا الْمَبِيتَ إِلَى غَارٍ فَدَخَلُوهُ فَانْحَدَرَتْ صَخْرَةٌ مِنْ الْجَبَلِ فَسَدَّتْ عَلَيْهِمْ الْغَارَ فَقَالُوا إِنَّهُ لَا يُنْجِيكُمْ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ إِلَّا أَنْ تَدْعُوا اللَّهَ بِصَالِحِ أَعْمَالِكُمْ فَقَالَ رَجُلٌ مِنْهُمْ اللَّهُمَّ كَانَ لِي أَبَوَانِ شَيْخَانِ كَبِيرَانِ وَكُنْتُ لَا أَغْبِقُ قَبْلَهُمَا أَهْلًا وَلَا مَالًا فَنَأَى بِي فِي طَلَبِ شَيْءٍ يَوْمًا فَلَمْ أُرِحْ عَلَيْهِمَا حَتَّى نَامَا فَحَلَبْتُ لَهُمَا غَبُوقَهُمَا فَوَجَدْتُهُمَا نَائِمَيْنِ وَكَرِهْتُ أَنْ أَغْبِقَ قَبْلَهُمَا أَهْلًا أَوْ مَالًا فَلَبِثْتُ وَالْقَدَحُ عَلَى يَدَيَّ أَنْتَظِرُ اسْتِيقَاظَهُمَا حَتَّى بَرَقَ الْفَجْرُ فَاسْتَيْقَظَا فَشَرِبَا غَبُوقَهُمَا اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيهِ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ فَانْفَرَجَتْ شَيْئًا لَا يَسْتَطِيعُونَ الْخُرُوجَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ الْآخَرُ اللَّهُمَّ كَانَتْ لِي بِنْتُ عَمٍّ كَانَتْ أَحَبَّ النَّاسِ إِلَيَّ فَأَرَدْتُهَا عَنْ نَفْسِهَا فَامْتَنَعَتْ مِنِّي حَتَّى أَلَمَّتْ بِهَا سَنَةٌ مِنْ السِّنِينَ فَجَاءَتْنِي فَأَعْطَيْتُهَا عِشْرِينَ وَمِائَةَ دِينَارٍ عَلَى أَنْ تُخَلِّيَ بَيْنِي وَبَيْنَ نَفْسِهَا فَفَعَلَتْ حَتَّى إِذَا قَدَرْتُ عَلَيْهَا قَالَتْ لَا أُحِلُّ لَكَ أَنْ تَفُضَّ الْخَاتَمَ إِلَّا بِحَقِّهِ فَتَحَرَّجْتُ مِنْ الْوُقُوعِ عَلَيْهَا فَانْصَرَفْتُ عَنْهَا وَهِيَ أَحَبُّ النَّاسِ إِلَيَّ وَتَرَكْتُ الذَّهَبَ الَّذِي أَعْطَيْتُهَا اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيهِ فَانْفَرَجَتْ الصَّخْرَةُ غَيْرَ أَنَّهُمْ لَا يَسْتَطِيعُونَ الْخُرُوجَ مِنْهَا قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ الثَّالِثُ اللَّهُمَّ إِنِّي اسْتَأْجَرْتُ أُجَرَاءَ فَأَعْطَيْتُهُمْ أَجْرَهُمْ غَيْرَ رَجُلٍ وَاحِدٍ تَرَكَ الَّذِي لَهُ وَذَهَبَ فَثَمَّرْتُ أَجْرَهُ حَتَّى كَثُرَتْ مِنْهُ الْأَمْوَالُ فَجَاءَنِي بَعْدَ حِينٍ فَقَالَ يَا عَبْدَ اللَّهِ أَدِّ إِلَيَّ أَجْرِي فَقُلْتُ لَهُ كُلُّ مَا تَرَى مِنْ أَجْرِكَ مِنْ الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ وَالْغَنَمِ وَالرَّقِيقِ فَقَالَ يَا عَبْدَ اللَّهِ لَا تَسْتَهْزِئُ بِي فَقُلْتُ إِنِّي لَا أَسْتَهْزِئُ بِكَ فَأَخَذَهُ كُلَّهُ فَاسْتَاقَهُ فَلَمْ يَتْرُكْ مِنْهُ شَيْئًا اللَّهُمَّ فَإِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيهِ فَانْفَرَجَتْ الصَّخْرَةُ فَخَرَجُوا يَمْشُونَ

“তোমাদের পূর্বে (বনী ইসরাঈলের যুগে) তিন ব্যক্তি একদা সফরে বের হল। চলতে চলতে রাত এসে গেল। তারা রাত কাটানোর জন্য একটি পর্বত-গুহায় প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ পরেই একটি বড় পাথর উপর থেকে গড়িয়ে নীচে এসে গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। এ দেখে তারা বলল যে, এ বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে এই যে, তোমরা তোমাদের নেক আমলসমূহকে ওসীলা বানিয়ে আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। সুতরাং তারা স্ব স্ব আমলের ওসীলায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করতে লাগল।

তাদের মধ্যে একজন বলল: হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার অত্যন্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিল এবং আমি সন্ধ্যাবেলায় সবার আগে তাদেরকে দুধ পান করাতাম। তাদের পূর্বে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও কৃতদাস-দাসী কাউকেই পান করাতাম না। একদিন আমি ঘাসের খোঁজে দূরে চলে গেলাম এবং বাড়ি ফিরে দেখতে পেলাম যে, পিতা-মাতা ঘুমিয়ে গেছে। আমি সন্ধ্যার দুধ দোহন করে তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলাম তারা ঘুমিয়ে আছে। আমি তাদেরকে জাগানো পছন্দ করলাম না এবং এও পছন্দ করলাম না যে, তাদের পূর্বে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও কৃতদাস-দাসীকে দুধ পান করাই। তাই আমি দুধের বাটি নিয়ে তাদের ঘুম থেকে জাগার অপেক্ষায় তাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অথচ শিশুরা ক্ষুধার তাড়নায় আমার পায়ের কাছে চেঁচামেচি করছিল। এভাবে ফজর উদয় হয়ে গেল এবং তারা জেগে উঠল। তারপর তারা নৈশদুধ পান করল । হে আল্লাহ!  আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য করে থাকি, তাহলে পাথরের কারণে যে আমরা গুহায় বন্দি হয়ে আছি এ থেকে তুমি আমাদেরকে উদ্ধার কর। এই দো‘আর ফলস্বরূপ পাথর একটু সরে গেল। কিন্তু তাতে তারা বের হতে সক্ষম ছিল না।

দ্বিতীয়জন দো‘আ করল: ‘হে আল্লাহ! আমার একটি চাচাতো বোন ছিল। সে আমার নিকট সকল মানুষের চেয়ে প্রিয়তমা ছিল। (অন্য বর্ণনা মতে) আমি তাকে এত বেশি ভালোবাসতাম, যত বেশি ভালো পুরুষরা নারীদেরকে বাসতে পারে। একবার আমি তার কু-কর্মের ইচ্ছা করলাম। কিন্তু সে অস্বীকার করল। পরিশেষে সে যখন এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ল, তখন সে আমার কাছে এল। আমি তাকে এ শর্তে ১২০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিলাম যেন সে আমার সঙ্গে কু-কর্মে লিপ্ত হয়। এতে সে (অভাবের তাড়নায়) রাজি হয়ে গেল। অতঃপর যখন আমি তাকে আয়ত্তে পেলাম। (অন্য বর্ণনা মতে) যখন আমি তার দু‘পায়ের মাঝে বসলাম, তখন সে বলল, তুমি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং অবৈধভাবে আমার পবিত্রতা নষ্ট করো না। এটা শুনে আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম; যদিও সে আমার একান্ত প্রিয়তমা ছিল। এবং যে স্বর্ণমুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম তাও পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি তাহলে আমাদের উপর পতিত মুসীবতকে দূরীভূত কর।’ এই দো‘আর ফলস্বরূপ পাথর আরো কিছুটা সরে গেল কিন্তু তাতে তারা বের হতে সক্ষম ছিল না।

তৃতীয়জন দো‘আ করল: ‘হে আল্লাহ! আমি কিছু লোককে মজুর রেখেছিলাম। কাজ শেষ হলে আমি তাদের সকলকে মজুরি দিয়ে দিলাম। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন মজুরি না নিয়ে চলে গেল। আমি তার মজুরির টাকা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করলাম। (কিছুদিন পর) তা থেকে প্রচুর অর্থ জমে গেল । অনেক দিন পর একদিন ঐ মজুর এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা তুমি আমার মজুরি দিয়ে দাও । আমি বললাম, এসব উট, গাভী, ছাগল এবং গোলাম যা তুমি দেখছ সবই তোমার মজুরির ফল। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা, তুমি আমার সঙ্গে উপহাস করছ। আমি বললাম, আমি তোমার সাথে উপহাস করছি না (সত্য কথাই বলছি)। সুতরাং আমার কথা শুনে সে তার সমস্ত মাল নিয়ে চলে গেল এবং কিছুই ছেড়ে গেল না। হে আল্লাহ! যদি আমি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি তাহলে যে বিপদে আমরা পড়েছি তা তুমি দূরীভূত কর। এই দো‘আর  ফলে পাথর সম্পূর্ণ সরে গেল এবং সকলে (গুহা থেকে) বের হয়ে চলতে লাগল।[26]

বিশুদ্ধ নিয়তে সম্পাদিত আমল আল্লাহর নিকট অতি পছন্দনীয়। উক্ত ঘটনায় তিন ব্যক্তি তাদের বিশুদ্ধ নিয়তে সম্পাদিত আমলের উসিলায় বিপদ মুক্তির জন্য দো‘আ করার সাথে সাথেই তা গ্রহণ করা হয়েছে।

বারো. উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

لا عمل لمن لا نية له، ولا أجر لمن لا حسبة له

“যার নিয়ত নেই তার কোনো আমল নেই। এবং যার কোনো সাওয়াবের উদ্দেশ্য নেই তার কোনো পুরস্কার  নেই।”[27]

তেরো. আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

لا ينفع قول إلا بعمل، ولا عمل إلا بنية، ولا ينفع قول ولا عمل ولا نية إلا بما وافق السنة

“কাজ বা আমল ছাড়া কথায় কোনো ফল নেই। আর বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কাজ বা আমল অসার। আবার কর্ম, কথা ও নিয়ত কোনোটিই কাজে আসবে না, যতক্ষণ না তা রাসূলের সুন্নাতের অনুসারে করা হবে।[28]

চৌদ্দ. অন্য হাদীসে এসেছে:

إنما هي أهل الدنيا أربعة نفر عبد رزقه الله فيها مالا وعلما فهو يتقي فيه ربه ويصل فيه رحمه ويعمل لله فيه بحقه فهذا بأفضل المنازل وعبد رزقه الله علما ولم يرزقه مالا فهو صادق النية يقول : لو أن لي مالا عملت بعمل فلان فأجرهما سواء

“পৃথিবী তো চার শ্রেণির লোকের, এক শ্রেণির লোক রয়েছে যাকে আল্লাহ তা‘আলা ইলম ও সম্পদ দুটিই দিয়েছেন। সে ইলম অনুযায়ী আমল করা ও সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। এ হলো সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণি। আবার এমন শ্রেণির ব্যক্তিও রয়েছে যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন কিন্তু সম্পদ দেন নি। সে বিশুদ্ধ নিয়তের অধিকারী। সে মনে মনে বলে- ‘যদি আল্লাহ আমাকে সম্পদ দিতেন তাহলে আমি তাঁর সন্তুষ্টির জন্য অমুক অমুক কাজ করতাম’। এ উভয় শ্রেণির সাওয়াব সমান।”[29]

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে  বিশুদ্ধ নিয়তে যাবতীয় আমল সম্পাদন করার  তাওফীক দান করুন। আমীন।

সমাপ্ত

………………………………………………………………

[1]. লিসানুল আরব (১৪/৩৭৮), আল-মু‘জামুল ওয়াফী (১০৯১)

[2]. ইযাহুল মিশকাত বাংলা (১/২৪৭)

[3]. بدائع الفوائد [৩/১৯০], ডক্টর ওসমান শাব্বীর: القواعد الكلية والضوابط الفقهية[৯৩-৯৪],

[4]. আল-মানসূর ফিল কাওয়ায়েদ, খ-৩, পৃষ্ঠা-২৮৪।

[5]. আল-আশবাহ ওয়ান-নাযায়ের (৩০)

[6]. তাফসীরে কুরতুবি এর সূত্রে মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা (মুফতী শফী রহ.) [১১৭২]।

[7]. মাআরিফুল কুরআন বংলা: মুফতী শফী রহ. [১১৭৩]

[8]. বুখারী: খণ্ড-২ অধ্যায় ৫৮।

[9]. যাদুদ দা-‘য়িয়াহ: [৬]

[10]. কাশফুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী [১/৪৮৮]।

[11]. আল্লামা মুফতী শফী রহ.: মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা [৯০২]।

[12]. মুফতী শফী রহ., তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা [৬২৫]।

[13]. মুফতী শফী রহ., তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন বাংলা [৬২৪-৬২৫]।

[14]. বুখারী, হাদীস নং [৬৬৮৯],  মুসলিম হাদীস নং [৫০৩৬]।

[15]. আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ:  الفتاوى الكبرى(১/২১৪-২১৫)

[16]. বুখারী, হাদীস নং [২১১৯]

[17]  বুখারী [২৮২৫] মুসলিম [৪৪৫]

[18]. মুসলিম [৫০৪১]

[19] . বুখারী [১৪২২]

[20]. হিদায়া, কিতাবুয্-যাকাত (১/৯৫)

[21]. বুখারী [১২৯৫, ৬৩৭৩]।

[22]. মুসলিম [৬৭০৮]

[23] . বুখারী [২৮১০], মুসলিম  [৫০২৮]।

[24]. বুখারী,[৬৮৭৫] মুসলিম [৭৪৩৫]।

[25]. মুসলিম, হাদীস নং ৩৫৫, সহীহ ইবন হিব্বান [১০৫]।

[26]. বুখারী [২২৭২], মুসলিম [১০০]।

[27]. যাদুদ দায়িয়াহ [৬]।

[28]. যাদুদ দায়িয়াহ [৬]।

[29]. তাবরানী [৩৪৫]।

উমার ইবনুল খাত্তাব রাঃ এর জীবনী

$
0
0

umar-series-title

সংকলন: এম.এ. ইমরান

নাম ’উমার, লকব ফারুক এবং কুনিয়াত আবু হাফ্‌স। পিতা খাত্তাব ও মাতা হান্‌তামা। কুরাইশ বংশের আ’দী গোত্রের লোক। ’উমারের অষ্টম উর্ধ পুরুষ কা’ব নামক ব্যক্তির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। পিতা খাত্তাব কুরাইশ বংশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। মাতা ‘হানতামা’ কুরাইশ বংশের বিখ্যাত সেনাপতি হিশাম ইবন মুগীরার কন্যা। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ এই মুগীরার পৌত্র। মক্কার ‘জাবালে ’আকিব’- এর পাদদেশে ছিল জাহিলী যুগে বনী ‘আ’দী ইবন কা’বের বসতি। এখানেই ছিল হযরত উমারের বাসস্থান। ইসলামী যুগে ’উমারের নাম অনুসারে পাহাড়টির নাম হয় ‘জাবালে ’উমার’- ’উমারের পাহাড়। [ তাবাকাতে ইবন সা’দ ৩/৬৬]

’উমারের চাচাত ভাই, যায়িদ বিন নুফাইল। হযরত রাসূলে কারীমের আবির্ভাবের পূর্বে নিজেদের বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে জাহিলী আরবে যাঁরা তাওহীদবাদী হয়েছিলেন, যায়িদ তাঁদেরই একজন।

রাসূলুল্লাহর সা. জন্মের তের বছর পর তাঁর জন্ম। মৃত্যুকালেও তাঁর বয়স হয়েছিল রাসূলুল্লাহর সা. বয়সের সমান ৬৩ বছর। তবে তাঁর জন্ম ও ইসলাম গ্রহণের সন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, টাক মাথা, গন্ডদেশ মাংসহীন, ঘন দাড়ি, মোঁচের দু’পাশ লম্বা ও পুরু এবং শরীর দীর্ঘাকৃতির। হাজার মানুষের মধ্যেও তাঁকেই সবার থেকে লম্বা দেখা যেত।

তাঁর জন্ম ও বাল্য সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। ইবন আসাকির তাঁর তারীখে ’আমর ইবন ’আস রা. হতে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে জানা যায়, একদিন ’আমর ইবন ’আস কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবসহ বসে আছে, এমন সময় হৈ চৈ শুনতে পেলেন। সংবাদ নিয়ে জানতে পেলেন, খাত্তাবের একটি ছেলে হয়েছে। এ বর্ণনার ভিত্তিতে মনে হয়, হযরত ’উমারের জন্মের সময় বেশ একটা আনন্দোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

তাঁর যৌবনের অবস্থাটাও প্রায় অনেকটা অজ্ঞাত। কে জানতো যে এই সাধারণ একরোখা ধরনের যুবকটি একদিন ‘ফারুকে আযমে’ পরিণত হবেন। কৈশোরে ’উমারের পিতা তাঁকে উটের রাখালী কাজে লাগিয়ে দেন। তিনি মক্কার নিকটবর্তী ‘দাজনান’ নামক স্থানে উট চরাতেন। তিনি তাঁর খিলাফতকালে একবার এই মাঠ অতিক্রমকালে সঙ্গীদের কাছে বাল্যের স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবেঃ ‘এমন এক সময় ছিল যখন আমি পশমী জামা পরে এই মাঠে প্রখন রোদে খাত্তাবের উট চরাতাম। খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নীরস ব্যক্তি। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিলে পিতার হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হতাম। কিন্তু আজ আমার এমন দিন এসেছে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আমার উপর কতৃত্ব করার আর কেউ নেই।’ [তাবাকাতঃ ৩/২৬৬-৬৭]

যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি তৎকালীন অভিজাত আরবদের অবশ্য-শিক্ষণীয় বিষয়গুলি যথাঃ যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা ও বংশ তালিকা শিক্ষা প্রভৃতি আয়ত্ত করেন। বংশ তালিকা বা নসবনামা বিদ্যা তিনি লাভ করেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর পিতা ও পিতামহ উভয়ে ছিলেন এ বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর। আরবের ‘উকায’ মেলায় তিনি কুস্তি লড়তেন।

আল্লামা যুবইয়ানী বলেছেনঃ ‘উমার ছিলেন এক মস্তবড় পাহলোয়ান।’ তিনি ছিলেন জাহিলী আরবের এক বিখ্যাত ঘোড় সওয়ার। আল্লামা জাহিয বলেছেনঃ ‘উমার ঘোড়ায় চড়লে মনে হত, ঘোড়ার চামড়ার সাথে তাঁর শরীর মিশে গেছে।’ [আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন]

তাঁর মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তৎকালীন খ্যাতনামা কবিদের প্রায় সব কবিতাই তাঁর মুখস্থ ছিল। আরবী কাব্য সমালোচনার বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে তিনিই। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মতামতগুলি পাঠ করলে এ বিষয়ে তাঁর যে কতখানি দখল ছিল তা উপলব্ধি করা যায়। বাগ্মিতা ছিল তাঁর সহজাত গুণ। যৌবনে তিনি কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। বালাজুরী লিখেছেনঃ ‘রাসূলে কারীমের সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় গোটা কুরাইশ বংশে মাত্র সতের জন লেখা-পড়া জানতেন। তাদের মধ্যে ’উমার একজন।

ব্যবসা বাণিজ্য ছিল জাহিলী যুগের আরব জাতির সম্মানজনক পেশা। ’উমারও ব্যবসা শুরু করেন এবং তাতে যথেষ্ট উন্নতিও করেন। ব্যবসা উপলক্ষে অনেক দূরদেশে গমন এবং বহু জ্ঞানী-গুণী সমাজের সাথে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন। মাসউদী বলেনঃ ’উমার রা. জাহিলী যুগে সিরিয়া ও ইরাকে ব্যবসা উপলক্ষে ভ্রমণে যেতেন। ফলে আরব ও আজমের অনেক রাজা-বাদশার সাথে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন।’ শিবলী নু’মানী বলেনঃ ‘জাহিলী যুগেই ’উমারের সুনাম সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে কুরাইশরা সর্বদা তাঁকেই দৌত্যগিরিতে নিয়োগ করতো। অন্যান্য গোত্রের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি হলে নিষ্পত্তির জন্য তাঁকেই দূত হিসেবে পাঠানো হত।’ [আল-ফারুকঃ ১৪]

’উমারের ইসলাম গ্রহণ এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা। তাঁর চাচাত ভাই যায়িদের কল্যাণে তাঁর বংশে তাওহীদের বাণী একেবারে নতুন ছিল না। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম যায়িদের পুত্র সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেন। সাঈদ আবার ’উমারের বোন ফাতিমাকে বিয়ে করেন। স্বামীর সাথে ফাতিমাও ইসলাম গ্রহণ করেন। ’উমারের বংশের আর এক বিশিষ্ট ব্যক্তি নাঈম ইবন আবদুল্লাহও ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত ’উমার ইসলাম সম্পর্কে কোন খবরই রাখতেন না। সর্বপ্রথম যখন ইসলামের কথা শুনলেন, ক্রোধে জ্বলতে লাগলেন। তাঁর বংশে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের তিনি পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন। এর মধ্যে জানতে পেলেন, ‘লাবীনা’ নামে তাঁর এক দাসীও ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যাঁদের ওপর তাঁর ক্ষমতা চলতো, নির্মম উৎপীড়ন চালালেন। এক পর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ইসলামের মূল প্রচারক মুহাম্মাদকেই সা. দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। যে কথা সেই কাজ।

আনাস ইবন মালিক থেকে বির্ণত। ‘তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে ’উমার চলেছেন। পথে বনি যুহরার এক ব্যক্তির (মতান্তরে নাঈম ইবন আবদুল্লাহ) সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কোন দিকে ’উমার? বললেনঃ মুহাম্মাদের একটা দফারফা করতে। লোকটি বললেন, মুহাম্মাদের সা. দফারফা করে বনি হাশিম ও বনি যুহরার হাত থেকে বাঁচবে কিভাবে? একথা শুনে ’উমার বলে উঠলেনঃ মনে হচ্ছে, তুমিও পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছে। লোকটি বললেনঃ ’উমার, একটি বিস্ময়কর খবর শোন, তোমার বোন-ভগ্নিপতি বিধর্মী হয়ে গেছে। তারা তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছে। (আসলে লোকটির উদ্দেশ্য ছিল, ’উমারকে তার লক্ষ্য থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।) একথা শুনে রাগে উন্মত্ত হয়ে ’উমার ছুটলেন তাঁর বোন-ভগ্নিপতির বাড়ীর দিকে। বাড়ীর দরজায় ’উমারের রা. করাঘাত পড়লো। তাঁরা দু’জন তখন খাব্বাব ইবন আল-আরাত-এর কাছে কুরআন শিখছিলেন। ’উমারের আভাস পেয়ে খাব্বাব বাড়ীর অন্য একটি ঘরে আত্মগোপন করলেন। ’উমার বোন-ভগ্নিপতিকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের এখানে গুণগুণ আওয়ায শুনছিলেন, তা কিসের? তাঁরা তখন কুরআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন। তাঁরা উত্তর দিলেনঃ আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম। ’উমার বললেনঃ সম্ভবতঃ তোমরা দু’জন ধর্মত্যাগী হয়েছো। ভগ্নিপতি বললেনঃ তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে ’উমার? ’উমার তাঁর ভগ্নিপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং দু’পায়ে ভীষণভাবে তাঁকে মাড়াতে লাগলেন। বোন তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে এলে ’উমার তাঁকে ধরে এমন মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। বোন রাগে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ সত্য যদি তোমার দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও থেকে থাকে, তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।

এ ঘটনার কিছুদিন আগ থেকে ’উমারের মধ্যে একটা ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছিল। কুরাইশরা মক্কায় মুসলমানদের ওপর নির্মম অত্যাচার-উৎপীড়ন চালিয়ে একজনকে ফেরাতে পারেনি। মুসলমানরা নীরবে সবকিছু মাথা পেতে নিয়েছে। প্রয়োজনে বাড়ী-ঘর ছেড়েছে, ইসলাম ত্যাগ করেনি। এতে ’উমারের মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল। তিনি একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আবর্তে দোল খাচ্ছিলেন। আজ তাঁর প্রিয় সহোদরার চোখ-মুখের রক্ত, তার সত্যের সাক্ষ্য তাঁকে এমন একটি ধাক্কা দিল যে, তাঁর সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কর্পুরের মত উড়ে গেল। মুহূর্তে হৃদয় তাঁর সত্যের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি পাক-সাফ হয়ে বোনের হাত থেকে সূরা ত্বাহার অংশটুকু নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বললেনঃ আমাকে তোমরা মুহাম্মাদের সা. কাছে নিয়ে চল। ’উমারের একথা শুনে এতক্ষণে খাব্বাব ঘরের গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেনঃ ‘সুসংবাদ ’উমার! বৃহস্পতিবার রাতে রাসূলুল্লাহ সা. তোমার জন্য দুআ করেছিলেন। আমি আশা করি তা কবুল হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ ‘আল্লাহ, ’উমার ইবনুল খাত্তাব অথবা ’আমর ইবন হিশামের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী কর।’ খাব্বাব আরো বললেনঃ রাসূল সা. এখন সাফার পাদদেশে ‘দারুল আরকামে’।

’উমার চললেন ‘দারুল আরকামের’ দিকে। হামযা এবং তালহার সাথে আরো কিছু সাহাবী তখন আরকামের বাড়ীর দরজায় পাহারারত। ’উমারকে দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তবে হামযা সান্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ আল্লাহ ’উমারের কল্যাণ চাইলে সে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলের অনুসারী হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য খুবই সহজ হবে। রাসূল সা. বাড়ীর ভেতরে। তাঁর উপর তখন ওহী নাযিল হচ্ছে। একটু পরে তিনি বেরিয়ে ’উমারের কাছে এলেন। ’উমারের কাপড় ও তরবারির হাতল মুট করে ধরে বললেনঃ ’উমার, তুমি কি বিরত হবে না?’ …. তারপর দুআ করলেনঃ হে আল্লাহ, ’উমার আমার সামনে, হে আল্লাহ, ’উমারের দ্বারা দ্বীনকে শক্তিশালী কর।’ ’উমার বলে উঠলেনঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। ইসলাম গ্রহণ করেই তিনি আহ্‌বান জানালেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, ঘর থেকে বের হয়ে পড়ুন।’ (তাবাকুতুল কুবরা/ইবন সা’দ ৩/২৬৭-৬৯) এটা নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরের ঘটনা।

ইমাম যুহরী বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. দারুল আরকামে প্রবেশের পর ’উমার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পূর্বে নারী-পুরুষ সর্বমোট ৪০ অথবা চল্লিশের কিছু বেশী লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ’উমারের ইসলাম গ্রহণের পর জিবরীল আ. এসে বলেনঃ ‘‘মুহাম্মাদ, ’উমারের ইসলাম গ্রহণে আসমানের অধিবাসীরা উৎফুল্ল হয়েছে।’’ [তাবাকাতঃ ৩/২৬৯]

’উমারের ইসলাম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। যদিও তখন পর্যন্ত ৪০/৫০ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে হযরত হামযাও ছিলেন, তথাপি মুসলমানদের পক্ষে কা’বায় গিয়ে নামায পড়া তো দূরের কথা নিজেদেরকে মুসলমান বলে প্রকাশ করাও নিরাপদ ছিল না। হযরত ’উমারের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে এ অবস্থার পরিবর্তন হলো। তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিলেন এবং অন্যদের সংগে নিয়ে কা’বা ঘরে নামায আদায় শুরু করলেন।

’উমার রা. বলেনঃ আমি ইসলাম গ্রহণের পর সেই রাতেই চিন্তা করলাম, মক্কাবাসীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সবচেয়ে কট্টর দুশমন কে আছে। আমি নিজে গিয়ে তাকে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা জানাবো। আমি মনে করলাম, আবু জাহলই সবচেয়ে বড় দুশমন। সকাল হতেই আমি তার দরজায় করাঘাত করলাম। আবু জাহল বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি মনে করে?’ আমি বললামঃ ‘আপনাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের সা. প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান ও বাণীকে মেনে নিয়েছি।’ একথা শোনা মাত্র সে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল এবং বললোঃ ‘আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক এবং যে খবর নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলংকিত করুক।’ [সীরাতু ইবন হিশাম]

এভাবে এই প্রথমবারের মত মক্কার পৌত্তলিক শক্তি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো। সাঈদ ইনবুল মুসায়্যিব বলেনঃ ‘তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্য রূপ নেয়।’ আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেনঃ ’উমার ইসলাম গ্রহণ করেই কুরাইশদের সাথে বিবাদ আরম্ভ করে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ক’বায় নামায পড়ে ছাড়লেন। আমরাও সকলে তাঁর সাথে নামায পড়েছিলাম।’ সুহায়িব ইবন সিনান বলেনঃ তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর আমরা কা’বার পাশে জটলা করে বসতাম, কা’বার তাওয়াফ করতাম, আমাদের সাথে কেউ রূঢ় ব্যবহার করলে তার প্রতিশোধ নিতাম এবং আমাদের ওপর যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করতাম। [তাবকাতঃ ৩/২৬৯]

তাই রাসূল সা. তাঁকে –‘আল-ফারুক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। কারণ, তাঁরই কারণে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে প্রকাশ্য বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। রাসূল  সা. বলেছেনঃ ’উমারের জিহ্বা ও অন্তঃকরণে আল্লাহ তাআলা সত্যকে স্থায়ী করে দিয়েছেন। তাই সে ‘ফারুক’। আল্লাহ তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন। [তাবাকাতঃ ৩/২৭০]

মক্কায় যাঁরা মুশরিকদের অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন, রাসূল সা. তাদেরকে মদীনায় হিজরাতের নির্দেশ দিলেন। আবু সালামা, আবদুল্লাহ বিন আশহাল, বিলাল ও ’আম্মার বিন ইয়াসিরের মদীনায় হিজরাতের পর বিশজন আত্মীয় বন্ধুসহ ’উমার মদীনার দিকে পা বাড়ালেন। এ বিশজনের মধ্যে তাঁর ভাই যায়িদ, ভাইয়ের ছেলে সাঈদ ও জামাই খুনাইসও ছিলেন। মদীনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে তিনি রিফায়া’ ইবন আবদুল মুনজিরের বাড়ীতে আশ্রয় নেন।

’উমারের হিজরাত ও অন্যদের হিজরাতের মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য ছিল। অন্যদের হিজরাত ছিল চুপে চুপে। সকলের অগোচরে। আর উমারের হিজরাত ছিল প্রকাশ্যে। তার মধ্যে ছিল কুরাইশদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ও বিদ্রোহের সূর। মক্কা থেকে মদীনায় যাত্রার পূর্বে তিনি প্রথমে কা’বা তাওয়াফ করলেন। তারপর কুরাইশদের আড্ডায় গিয়ে ঘোষণা করলেন, আমি মদীনায় চলছি। কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোক দিতে চায়, সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়। এমন একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি সোজা মদীনার পথ ধরলেন। কিন্তু কেউ এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দুঃসাহস করলো না। [তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাহঃ খিদরী বেক, ১/১৯৮]

বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের সাথে ’উমারের দ্বীনী ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। আবু বকর সিদ্দীক, ’উয়াইস ইবন সায়িদা, ইতবান ইবন মালিক ও মুয়াজ ইবন আফরা রা. ছিলেন ’উমারের দ্বীনী ভাই। তবে এটা নিশ্চিত যে, মদীনায় হিজরাতের পর বনী সালেমের সরদার ইতবান ইবন মালিকের সাথে তাঁর দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। [তাবাকাতঃ ৩/২৭২]

হিজরী প্রথম বছর হতে রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকাল পর্যন্ত ’উমারের রা. কর্মজীবন প্রকৃতপক্ষে হযরত রাসূলে কারীমের সা. কর্মময় জীবনেরই একটা অংশবিশেষ। রাসূলকে সা. যত যুদ্ধ করতে হয়েছিল, যত চুক্তি করতে হয়েছিল, কিংবা সময় সময় যত বিধিবিধান প্রবর্তন করতে হয়েছিল এবং ইসলাম প্রচারের জন্য যত পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল তার এমন একটি ঘটনাও নেই, যা ’উমারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত সম্পাদিত হয়েছে। এইজন্য এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে গেলে তা ’উমারের রা. জীবনী না হয়ে হযরত রাসূল কারীমের সা. জীবনীতে পরিণত হয়। তাঁর কর্মবহুল জীবন ছিল রাসূল কারীমের সা. জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।

হযরত ’উমার বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই রাসূলুল্লাহর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া আরো বেশ কিছু ‘সারিয়্যা’ (যে-সব ছোট অভিযানে রাসূলুল্লাহ সা. নিজে উপস্থিত হননি)-তে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বদর যুদ্ধের পরামর্শদান ও সৈন্যচালনা হতে আরম্ভ করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রাসূলে কারীমের সা. সাথে দৃঢ়ভাবে কাজ করেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের সম্পর্কে তাঁর পরামর্শই আল্লাহর পসন্দসই হয়েছিল। এ যুদ্ধে তাঁর বিশেষ ভূমিকা নিম্নরূপঃ

  • ১. এ যুদ্ধে কুরাইশ বংশের প্রত্যেক শাখা হতে লোক যোগদান করে; কিন্তু বণী আ’দী অর্থাৎ ’উমারের খান্দান হতে একটি লোকও যোগদান করেনি। ’উমারের প্রভাবেই এমনটি হয়েছিল।
  • ২. এ যুদ্ধে ইসলামের বিপক্ষে ’উমারের সাথে তাঁর গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ লোকদের থেকে মোট বারো জন লোক যোগদান করেছিল।
  • ৩. এ যুদ্ধে হযরত ’উমার তাঁর আপন মামা আ’সী ইবন হিশামকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এ হত্যার মাধ্যমে তিনিই সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন, সত্যের পথে আত্মীয় প্রিয়জনের প্রভাব প্রাধান্য লাভ করতে পারে না।

উহুদ যুদ্ধেও হযরত ’উমার রা. ছিলেন একজন অগ্রসৈনিক। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম সৈন্যরা যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন এবং রাসূল সা. আহত হয়ে মুষ্টিমেয় কিছু সঙ্গী-সাথীসহ পাহাড়ের এক নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেন, তখন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান নিকটবর্তী হয়ে উচ্চস্বরে মুহাম্মাদ সা., আবু বকর রা., ’উমার রা. প্রমুখের নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা বেঁচে আছ কি? রাসূলের সা. ইঙ্গিতে কেউই আবু সুফিয়ানের জবাব দিল না। কোন সাড়া না পেয়ে আবু সুফিয়ান ঘোষণা করলোঃ ‘নিশ্চয় তারা সকলে নিহত হয়েছে।’ এ কথায় ’উমারের পৌরুষে আঘাত লাগলো। তিনি স্থির থাকতে পারলেন না।’ বলে উঠলেঃ ‘ওরে আল্লাহর দুশমন! আমরা সবাই জীবিত।’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘উ’লু হুবল-হুবলের জয় হোক।’ রাসূলুল্লাহর সা. ইঙ্গিতে ’উমার জবাব দিলেনঃ ‘আল্লাহু আ’লা ও আজাল্লু- আল্লাহ মহান ও সম্মানী।’

খন্দকের যুদ্ধেও ’উমার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। খন্দকের একটি বিশেষ স্থান রক্ষা করার ভার পড়েছিল ’উমারের ওপর। আজও  সেখানে তাঁর নামে একটি মসজিদ বিদ্যমান থেকে তাঁর সেই স্মৃতির ঘোষণা করছে। এ যুদ্ধে একদিন তিনি প্রতিরক্ষায় এত ব্যস্ত ছিলেন যে, তাঁর আসরের নামায ফউত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। রাসূল সা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেনঃ ‘ব্যস্ততার কারণে আমিও এখন পর্যন্ত নামায আদায় করতে পারিনি।’ [আল-ফারুকঃ শিবলী নু’মানীঃ ২৫]

হুদাইবিয়ার শপথের পূর্বেই হযরত ’উমার যুদ্ধের প্রস্তুতি আরম্ভ করে দিলেন। পুত্র আবদুল্লাহকে পাঠালেন কোন এক আনসারীর নিকট থেকে ঘোড়া আনার জন্য। তিনি এসে খবর দিলেন, ‘লোকেরা রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করছেন।’ ’উমার তখন রণসজ্জায় সজ্জিত। এ অবস্থায় দৌড়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করেন।

হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তগুলি বাহ্য দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মনে হলো। ’উমার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। প্রথমে আবু বকর, তারপর খোদ রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এ সন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ ‘আমি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কোন কাজ আমি করিনে।’ ’উমার শান্ত হলেন। তিনি অনুতপ্ত হলেন। নফল রোযা রেখে, নামায পড়ে, গোলাম আযাদ করে এবং দান খয়রাত করে তিনি গোস্‌তাখীর কাফ্‌ফারা আদায় করলেন।

খাইবারে ইহুদীদের অনেকগুলি সুরক্ষিত দুর্গ ছিলো। কয়েকটি সহজেই জয় হলো। কিন্তু দু’টি কিছুতেই জয় করা গেল না। রাসূল সা. প্রথম দিন আবু বকর, দ্বিতীয় দিন ’উমারকে পাঠালেন দুর্গ দু’টি জয় করার জন্য। তাঁরা দু’জনই ফিরে এলেন অকৃতকার্য হয়ে। তৃতীয় দিন রাসূল সা. ঘোষণা করলেনঃ ’আগামীকাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ঝাণ্ডা দেব, যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন।’ পর দিন সাহাবায়ে কিরাম অস্ত্র সজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির। প্রত্যেকেরই অন্তরে এই গৌরব অর্জনের বাসনা। ’উমার বলেনঃ ‘আমি খাইবারে এই ঘটনা ব্যতীত কোনদিনই সেনাপতিত্ব বা সরদারীর জন্য লালায়িত হইনি।’ সে দিনের এ গৌরব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শের-ই-খোদা আলী রা.।খাইবারের বিজিত ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। হযরত ’উমার রা. তাঁর ভাগ্যের অংশটুকু আল্লাহর রাস্তার ওয়াক্‌ফ করে দিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম ওয়াক্‌ফ। [আল-ফারুকঃ ৩০]

মক্কা বিজয়ের সময় হযরত ’উমার রা. ছায়ার মত রাসূলকে সা. সঙ্গ দেন। ইসলামের মহাশত্রু আবু সুফিয়ান আত্মসমর্পণ করতে এলে ’উমার রাসূলুল্লাহকে সা. অনুরোধ করেনঃ ‘অনুমতি দিন এখনই ওর দফা শেষ করে দিই।’ এদিন মক্কার পুরুষরা রাসূলুল্লাহর সা. হাতে এবং মহিলারা রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে ’উমারের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছিলেন।

হুনায়িন অভিযানেও হযরত ’উমার অংশগ্রহণ করে বীরত্ব সহকারে লড়াই করেছিলেন। এ যুদ্ধে কাফিরদের তীব্র আক্রমণে বারো হাজার মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। ইবন ইসহাক বলেনঃ মুহাজির ও আনসারদের মাত্র কয়েকজন বীরই এই বিপদকালে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে দৃঢ়পদ ছিলেন। তাদের মধ্যে আবু বকর, ’উমার ও আব্বাসের রা. নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাবুক অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহর সা. আবেদনে সাড়া দিয়ে হযরত ’উমার রা. তাঁর মোট সম্পদের অর্ধেক রাসূলুল্লাহর সা. হাতে তুলে দেন।

রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের খবর শুনে হযরত ’উমার কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন। তারপর মসজিদে নববীর সামনে যেয়ে তরবারি কোষমুক্ত করে ঘোষণা করেন, ‘যে বলবে রাসূলুল্লাহ সা. ইনতিকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবো।’ এ ঘটনা থেকে রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসার পরিমাণ সহজেই অনুমান করা যায়।

রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর ‘সাকীফা বনী সায়েদায়’ দীর্ঘ আলোচনার পর ’উমার খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে হযরত আবু বকরের হাতে খিলাফতের বাইয়াত গ্রহণ করেন। ফলে খলীফা নির্বাচনের মহা সংকট সহজেই কেটে যায়।

খলীফা হযরত আবু বকর যখন বুঝতে পারলেন তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে, মৃত্যুর পূর্বেই পরবর্তী খলীফা মনোনীত করে যাওয়াকে তিনি কল্যাণকর মনে করলেন। তাঁর দৃষ্টিতে ’উমার রা. ছিলেন খিলাফতের যোগ্যতম ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও উঁচু পর্যায়ের সাহাবীদের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করা সমীচীন মনে করলেন। তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফকে রা. ডেকে বললেন, ’উমার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে জানান।’ তিনি বললেনঃ ‘তিনি তো যে কোন লোক থেকে উত্তম; কিন্তু তাঁর চরিত্রে কিছু কঠোরতা আছে।’ আবু বকর বললেনঃ ‘তার কারণ, আমাকে তিনি কোমল দেখেছেন, খিলাফতের দায়িত্ব কাঁধে পড়লে এ কঠোরতা অনেকটা কমে যাবে।’ তারপর আবু বকর অনুরোধ করলেন, তাঁর সাথে আলোচিত বিষয়টি কারো কাছে ফাঁস না করার জন্য। অতঃপর তিনি ’উসমান ইবন আফ্‌ফানকে ডাকলেন। বললেন, ‘আবু আবদিল্লাহ, ’উমার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে জানান।’ ’উসমান বললেনঃ আমার থেকে আপনিই তাঁকে বেশী জানেন। আবু বকর বললেনঃ তা সত্ত্বেও আপনার মতামত আমাকে জানান। ’উসমান বললেনঃ তাঁকে আমি যতটুকু জানি, তাতে তাঁর বাইরের থেকে ভেতরটা বেশী ভালো। তাঁর মত দ্বিতীয় আর কেউ আমাদের মধ্যে নেই। আবু বকর রা. তাঁদের দু’জনের মধ্যে আলোচিত বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ করে তাঁকে বিদায় দিলেন।

এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মতামত নেওয়া শেষ হলে তিনি উসমান ইবনে আফ্‌ফানকে ডেকে ডিক্‌টেশন দিলেনঃ ‘বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটা আবু বকর ইবন আবী কুহাফার পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি অঙ্গীকার। আম্মাবাদ’- এতটুকু বলার পর তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তারপর ’উসমান ইবন আফ্‌ফান নিজেই সংযোজন করেন- ‘আমি তোমাদের জন্য ’উমার ইবনুল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করলাম এবং এ ব্যাপারে তোমাদের কল্যাণ চেষ্টায় কোন ত্রুটি করি নাই।’ অতঃপর আবু বকর সংজ্ঞা ফিরে পান। লিখিত অংশটুকু তাঁকে পড়ে শোনান হলো।’ সবটুকু শুনে তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ওঠেন এবং বলেনঃ আমার ভয় হচ্ছিল, আমি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মারা গেলে লোকেরা মতভেদ সৃষ্টি করবে। ’উসমানকে লক্ষ্য করে তিনি আরো বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপনাকে কল্যাণ দান করুন।

তাবারী বলেনঃ অতঃপর আবু বকর লোকদের দিকে তাকালেন। তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতু উমাইস তখন তাঁকে ধরে রেখেছিলেন। সমবেত লোকদের তিনি বলেনঃ ‘যে ব্যক্তিকে আমি আপনাদের জন্য মনোনীত করে যাচ্ছি তাঁর প্রতি কি আপনারা সন্তুষ্ট? আল্লাহর কসম, মানুষের মতামত নিতে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আমার কোন নিকট আত্মীয়কে এ পদে বহাল করিনি। আমি ’উমার ইবনুল খাত্তাবকে আপনাদের খলীফা মনোনীত করেছি। আপনারা তাঁর কথা শুনুন, তাঁর আনুগত্য করুন।’ এভাবে ’উমারের রা. খিলাফত শুরু হয় হিঃ ১৩ সনের ২২ জামাদিউস সানী মুতাবিক ১৩ আগস্ট ৬৩৪ খৃঃ।

হযরত ’উমারের রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা সম্ভব নয়। দশ বছরের স্বল্প সময়ে গোটা বাইজান্টাইন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। তাঁর যুগে বিভিন্ন অঞ্চলসহ মোট ১০৩৬ টি শহর বিজিত হয়। ইসলামী হুকুমাতের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা মূলতঃ তাঁর যুগেই হয়। সরকার বা রাষ্ট্রের সকল শাখা তাঁর যুগেই আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর শাসন ও ইনসাফের কথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মত ছড়িয়ে আছে।

হযরত ’উমার প্রথম খলীফা যিনি ‘আমীরুল মুমিনীন’ উপাধি লাভ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন, তারাবীর নামায জামাআতে পড়ার ব্যবস্থা করেন, জন শাসনের জন্য দুর্রা বা ছড়ি ব্যবহার করেন, মদপানে আশিটি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন, বহু রাজ্য জয় করেন, নগর পত্তন করেন, সেনাবাহিনীর স্তরভেদ ও বিভিন্ন ব্যাটালিয়ান নির্দিষ্ট করেন, জাতীয় রেজিষ্টার বা নাগরিক তালিকা তৈরী করেন, কাযী নিয়োগ করেন এবং রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।

’উমার রা. ছিলেন রাসূলুল্লাহর অন্যতম কাতিব। নিজ কন্যা হযরত হাফসাকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে দেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা. ও আবু বকরের রা. মন্ত্রী উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ও পরে ব্যবসা ছিল তাঁর জীবিকার উপায়। খিলাফতের গুরুদায়িত্ব কাঁধে পড়ার পরও কয়েক বছর পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যান। কিন্তু পরে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালে হযরত আলী রা. সহ উঁচু পর্যায়ের সাহাবীরা পরামর্শ করে বাইতুল মাল থেকে বাৎসরিক মাত্র আট শ’ দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করেন। হিজরী ১৫ সনে বাইতুল মাল থেকে অন্য লোকদের ভাতা নির্ধারিত হলে বিশিষ্ট সাহাবীদের ভাতার সমান তাঁরও ভাতা ধার্য করা হয় পাঁচ হাজার দিরহাম।

বাইতুল মালের অর্থের ব্যাপারে হযরত ’উমারের রা. দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইয়াতিমের অর্থের মত। ইয়াতিমের অভিভাবক যেমন ইয়াতিমের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইয়াতীমের ও নিজের জন্য প্রয়োজন মত খরচ করতে পারে কিন্তু অপচয় করতে পারে না। প্রয়োজন না হলে ইয়াতিমের সম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে শুধু হিফাজত করে এবং ইয়াতিম বড় হলে তাকে তার সম্পদ ফিরিয়ে দেয়। বাইতুল মালের প্রতি ’উমারের রা. এ দৃষ্টিভঙ্গিই সর্বদা তাঁর কর্ম ও আচরণে ফুটে উঠেছে।

হযরত ’উমার সব সময় একটি দুর্রা বা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতেন। শয়তানও তাঁকে দেখে পালাতো। (তাজকিরাতুল হুফফাজ) তাই বলে তিনি অত্যাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কঠোর ন্যায় বিচারক। মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন, মানুষও তাঁকে ভালোবাসতো। তাঁর প্রজাপালনের বহু কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায়।

হযরত ফারুকে আযমের ফজীলাত ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে এত বেশী ইঙ্গিত ও প্রকাশ্য বাণী রয়েছে যে, সংক্ষিপ্ত কোন প্রবন্ধে তা প্রকাশ করা যাবে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. নিকট তাঁর স্থান অতি উচ্চে। এজন্য বলা হয়েছে, ’উমারের সব মতের সমর্থনেই সর্বদা কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে।’ হযরত আলী রা. মন্তব্য করেছেনঃ ‘খাইরুল উম্মাতি বা’দা নাবিয়্যিহা আবু বকর সুম্মা ’উমার- নবীর সা. পর উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি আবু বকর, তারপর ’উমার।’ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেনঃ ’উমারের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়। তাঁর হিজরাত আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর খিলাফত আল্লাহর রহমত।’ ’উমারের যাবতীয় গুণাবলী লক্ষ্য করেই রাসূলে করীম সা. বলেছিলেনঃ ‘লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লাকানা ’উমার- আমার পরে কেউ নবী হলে ’উমারই হতো।’ কারণ তাঁর মধ্যে ছিল নবীদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য।

জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে ’উমারের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি আরবী কবিতা পঠন-পাঠন ও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। আরবী ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ; তাঁর সামনে ভাষার ব্যাপারে কেউ ভুল করলে শাসিয়ে দিতেন। বিশুদ্ধভাবে আরবী ভাষা শিক্ষা করাকে তিনি দ্বীনের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করতেন। আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফ্‌ফাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ’উমার ছিলেন অত্যন্ত কঠোর, একই হাদীস বিভিন্ন সনদের মাধ্যমে বর্ণনার প্রতি তিনি তাকিদ দেন।

প্রখ্যাত সাহাবী মুগীরা ইবন শু’বার রা. অগ্নি উপাসক দাস আবু লু’লু ফিরোজ ফজরের নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় এই মহান খলীফাকে ছুরিকাঘাত করে। আহত হওয়ার তৃতীয় দিনে হিজরী ২৩ সনের ২৭ জিলহজ্জ বুধবার তিনি ইনতিকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে আলী, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ, সা’দ, যুবাইর ও তালহা রা.- এ ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর ওপর তাদের মধ্য থেকে কোন একজনকে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করে যান। হযরত সুহায়িব রা. জানাযার নামায পড়ান। রওজায়ে নববীর মধ্যে হযরত সিদ্দীকে আকবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তাঁর খিলাফতকাল দশ বছর ছয় মাস চার দিন।

————–
উৎস: আসহাবে রাসূলের জীবনকথা


একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৬

$
0
0

DawahMission_Gloucester_FB-01

লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০

লোভ-লালসা

লোভ-লালসার পরিচয় ও হুকুম

লোভ-লালসার আরবী প্রতিশব্দ হলো : হিরছ (حرص)। যার আভিধানিক অর্থ লোভ, লালসা, লিপ্সা, কামনা, প্রলোভন, কার্পণ্য ইত্যাদি।

পরিভাষায়,

কারো কোন জিনিস দেখে তা লাভের আশা করা যা মানুষকে সর্বদাই আল্লাহ্ বিমূখ করে দেয় এবং দুনিয়া মুখী করে দেয় তাই-ই হিরছ।

লোভ-লালসার হুকুম

হিরছ দুই প্রকার। একটি হলো সৎ উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে খোদাদ্রোহী কোন বিষয় সম্পৃক্ত নয়। অপরটি হলো অসৎ উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে দুনিয়াবী কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রথম প্রকারে হিরছ সর্বসম্মতক্রমে বৈধ। দ্বিতীয় প্রকারের হিরছ সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।

লোভ-লালসা কারণ

হিরছের একমাত্র কারণ হলো মানুষর বড় হওয়ার প্রবল আকাঙ্খা করা। এখানে উল্লেখ্য যে, বড় হওয়া বলতে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, যে জিনিসের অধিকার আমি নই বা যা আমার প্রাপ্য নয় তার আশা করাই হলো হিরছের প্রধান ও অন্যতম কারণ। এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে, বৈধ ভাবে মানুষ যদি বড় হতে চায় যেমন : কোন ছাত্র ইচ্ছা করলো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে এটি তার জন্য হারাম নয়। মূলকথা হলো এমন কোন লোভ-লালসা করা যা আল্লাহর স্মরণ থেকে ব্যক্তিকে বিরত রাখে।

লোভ-লালসা পরিণতি

হাসান (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন :

নিশ্চয়ই হিংসা-বিদ্বেষ নেকীসমূহকে নি:শেষ করে দেয়, যেমনিভাবে আগুন শুকনো কাঠকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।৮০

রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন : সাবধান শুনে নাও! আল্লাহর নিয়ামতেরও কিছু শত্রু রয়েছে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু কারা? রাসূল সা. বললেন : আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে যে নিয়ামত দান করেছেন, তার কারণে মানুষকে যে হিংসা করে, সে আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু।

বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবু লাইস আস-সমরকন্দী রহ. বলেন : তিন ব্যক্তির দু‘আ কবুল হয় না।

এক. হারাম ভক্ষণকারীর দু‘আ,

দুই. বেশি গীবতকারীর,

তিন. হিংসুকের দু‘আ।

লোভ-লালসা থেকে বাঁচার উপায়

মানুষের একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহের মধ্যে অর্থসম্পদ অন্যতম। অর্থসম্পদ ব্যতীত মানুষের জীবনধারণ একেবারেই অসম্ভব। জীবন এবং সম্পদ একটি আরেকটির পরিপূরক। সম্পদ ছাড়া যেমন জীবনধারণ সম্ভব নয়, তেমনি প্রাণহীন ব্যক্তির জন্য অর্থেরও কোন মূল্য নেই। অর্থসম্পদ মূলত: আল্লাহ্ তৈরীই করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য কিন্তু এ অর্থই আবার কখনও কখনও অনর্থের কারণ হয়ে থাকে। বিত্ত-বৈভব যেমন মানুষের প্রভূত কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে অনুরূপভাবে তা আবার মানুষের ক্ষতিকর কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি নির্ভর করে সম্পদের সঠিক ও অপব্যবহার এবং সুসম ও অসম বণ্টন ব্যবস্থার উপর। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সকল মতবাদ প্রচলিত আছে, তার সবগুলোই সম্পদ সঠিক ব্যবহার ও সুসম বণ্টনের মাধ্যমে সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। হিরছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় দুটি। এক. হালাল পন্থায় উপার্জন করা দুই. হারাম পেশা ত্যাগ করা। নিম্নে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হলো :

এক. হালাল পন্থায় উপার্জন করা

বৈধ পন্থায় উপার্জনের জন্য আমরা সর্বদা চেষ্টা-প্রচেষ্টা করি। কীভাবে আমরা আমাদের রিযিক বৈধ্য পন্থায় উপার্জন করতে পারি? কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অন্যতম একটি শর্ত হলো বান্দাহর উপার্জন হালাল পন্থায় হওয়া। কেননা রিযিক যদি হালাল পন্থায় উপার্জিত না হয় তাহলে তার কোন দু‘আ-ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দরবারে কবুল হয় না। আর আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনও হালাল রিযিকের খেয়ে জীবনধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা আল-কুর’আনে ঘোষণা করে বলেন :

“ আমি তোমাদের জন্য যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে পবিত্রতম বস্তু তোমরা ভক্ষণ কর।”

আর বৈধ পেশায় নিয়োজিত থেকে সম্পদ উপার্জনের জন্য পবিত্রতম ও হালাল বস্তুর খোঁজ করার নির্দেশও আল্লাহ্ তা‘আলা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

“হে মু’মিনগণ! জুমু‘আর দিনে যখন সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর। সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়ায়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। যখন তোমরা দেখলে ব্যবসায় ও কৌতুক তখন তারা তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে উহার দিকে ছুটে গেল। বল: আল্লাহর নিকট যা আছে তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ রিয্কদাতা।”৮১

এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন :

“পৃথিবী মিষ্ট ও শ্যামল। এখানে যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ উপার্জন করবে এবং ন্যায়সংগত পথে তা ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ উপার্জন করবে এবং তা অন্যায় পথে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে অপমানজনক স্থানে নির্বাসিত করবেন। আর হারাম সম্পদ হস্তগতকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন আগুনে জ্বলবে।”৮২

দুই. হারাম পন্থায় উপার্জন থেকে বিরত থাকা

পৃথিবীতে দু’ধরণের উপার্জন পরিলক্ষিত হয়। একটি হলো হালাল তথা বৈধ পন্থায় উপার্জন। আর অপরটি হলো হারাম তথা অবৈধ পন্থায় উপার্জন। মানবজীবনে এ অবৈধ পন্থায় উপার্জনকে কুর’আন ও হাদীসে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا.

“হে মু’মিনগণ! তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।”৮৩

রাসূল (ﷺ) বলেছেন : “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধুসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে “হে প্রভু! হে প্রভু! বলে মুনাজাত করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মুনাজাত কিভাবে কবুল হবে?”৮৪ 

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০


৮০. আবূ দাউদ
৮১. সূরা আল-জুমু‘আহ, ৯-১১
৮২. ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, (দারুল ফিকর, তা.বি.), খ. ১০, পৃ. ৩৭০, হাদীস নং-৪৫১২
৮৩. সূরা আন-নিসা, ২৯
৮৪. ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ ইবনে মুসলিম, আস-সহীহ, (বৈরূত : দারুর যাইল, তা.বি.), খণ্ড ৩, পৃ. ৮৫, হাদীস নং-২৩৯৩

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -৩

$
0
0

Adab in Muslim Life QA

লেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুসলিম বান্দার আদব

মুসলিম ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অগণিত নি‘য়ামতের প্রতি লক্ষ্য করে; আরও লক্ষ্য করে ঐসব নি‘য়ামতের প্রতি, যেসব নি‘য়ামত তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে শুরু করে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ (মৃত্যু) করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ফলে সে তার নিজ মুখে তাঁর যথাযথ প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার দ্বারা এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে তাঁর আনুগত্যের অধীনস্থ করে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে; আর এটাই হলো তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে আদব; কেননা, নি‘য়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা, তাকে এবং তার ইহসান ও অবদানকে অবজ্ঞা করাটা কোনো আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

[ وَمَا بِكُم مِّن نِّعۡمَةٖ فَمِنَ ٱللَّهِۖ ] [النحل: ٥٣]

“তোমাদের নিকট যেসব নিয়ামত রয়েছে, তা তো আল্লাহর নিকট থেকেই (এসেছে)।”[1]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ وَإِن تَعُدُّواْ نِعۡمَةَ ٱللَّهِ لَا تُحۡصُوهَآۗ ] [النحل: ١٨]

“তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না।”[2]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ فَٱذۡكُرُونِيٓ أَذۡكُرۡكُمۡ وَٱشۡكُرُواْ لِي وَلَا تَكۡفُرُونِ ] [البقرة: ١٥٢]

“কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।”[3]

আর মুসলিম ব্যক্তি গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সম্পর্কে জানেন এবং তার সকল অবস্থা অবলোকন করেন; ফলে তার হৃদয়-মন তাঁর ভয়ে ও তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে; যার কারণে সে তাঁর অবাধ্যতায় লজ্জিত হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ ও তাঁর আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটাকে রীতিমত অপমান মনে করে। সুতরাং এটাও তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে আদব; কেননা, গোলাম কর্তৃক তাঁর মালিকের সাথে অবাধ্য আচরণ করা অথবা মন্দ ও ঘৃণ্য কোনো বস্তু বা বিষয় নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হওয়া, অথচ তিনি তা সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন— তা কোনো ভাবেই আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارٗ , وَقَدۡ خَلَقَكُمۡ أَطۡوَارً] [نوح: ١٣،  ١٤]

“তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহ‌র শ্রেষ্ঠত্বের পরওয়া করছ না। অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে।”[4]

তিনি আরও বলেন:

[ وَيَعۡلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعۡلِنُونَۚ ] [التغابن: ٤]

“আর তিনি জানেন তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর।”[5]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

 وَمَا تَكُونُ فِي شَأۡنٖ وَمَا تَتۡلُواْ مِنۡهُ مِن قُرۡءَانٖ وَلَا تَعۡمَلُونَ مِنۡ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيۡكُمۡ شُهُودًا إِذۡ تُفِيضُونَ فِيهِۚ وَمَا يَعۡزُبُ عَن رَّبِّكَ مِن مِّثۡقَالِ ذَرَّةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِي ٱلسَّمَآءِ  [يونس: ٦١

“আর আপনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন এবং আপনি সে সম্পর্কে কুরআন থেকে যা-ই তিলাওয়াত করেন এবং তোমরা যে আমলই কর না কেন, আমরা তোমাদের সাক্ষী থাকি- যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও। আর আসমানসমূহ ও যমীনের অণু পরিমাণও আপনার রবের দৃষ্টির বাইরে নয়।”[6]

আবার মুসলিম ব্যক্তি গভীরভাবে এটাও লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ক্ষমতাবান, সে তাঁর আয়াত্তাধীন এবং তাঁর দিকে ছাড়া তার পালানোর, মুক্তির ও আশ্রয় নেয়ার আর কোনো জায়গা নেই; সুতরাং সে আল্লাহর দিকে ধাবিত হবে, তাঁর সামনে নিজেকে সমর্পণ করে দেবে, তার বিষয়াদি তাঁর নিকট সোপর্দ করবে এবং তাঁর উপর ভরসা করবে; ফলে এটা তার পক্ষ থেকে তার প্রতিপালক ও সৃষ্টা আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব বলে গণ্য হবে; কেননা, যাঁর থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো সুযোগ নেই তাঁর কাছ থেকে পালানো, যার কোনো ক্ষমতা নেই তার উপর নির্ভর করা এবং যার কোনো শক্তি ও ক্ষমতা নেই তার উপর ভরসা করা কোনো আদব বা শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ مَّا مِن دَآبَّةٍ إِلَّا هُوَ ءَاخِذُۢ بِنَاصِيَتِهَآۚ ] [هود: ٥٦]

“এমন কোন জীব-জন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়।”[7]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ فَفِرُّوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۖ إِنِّي لَكُم مِّنۡهُ نَذِيرٞ مُّبِينٞ ] [الذاريات: ٥٠]

“অতএব তোমরা আল্লাহর দিকে ধাবিত হও, নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক স্পষ্ট সতর্ককারী।”[8]

তিনি আরও বলেন:

[ وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ] [المائ‍دة: ٢٣]

“এবং আল্লাহর উপরই তোমরা নির্ভর কর, যদি তোমরা মুমিন হও।”[9]

আবার মুসলিম ব্যক্তি এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সকল বিষয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তার প্রতি ও তাঁর (আল্লাহর) সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া ও করুণা করেন, যার কারণে সে এর চেয়ে আরও বেশি আশা করে; ফলে সে খালেসভাবে তাঁর নিকট অনুনয়, বিনয় ও নিবেদন করে এবং ভালো কথা ও সৎ আমলের অছিলা ধরে তাঁর নিকট প্রার্থনা করে; সুতরাং এটা তার পক্ষ থেকে তার মাওলা আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব বলে গণ্য হবে; কারণ, যে রহমত সকল কিছুকে বেষ্টন করে রেখেছে তার থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া, যে ইহসান সকল সৃষ্টিকে শামিল করে তার থেকে হতাশ বা নিরাশ হওয়া এবং যে দয়া ও অনুগ্রহ সকল সৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করে তার আশা ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো আদব বা শিষ্টাচার নেই।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ ] [الاعراف: ١٥٦]

“আর আমার দয়া তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে।”[10]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ ٱللَّهُ لَطِيفُۢ بِعِبَادِهِۦ ] [الشورا: ١٩]

“আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত কোমল।”[11]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ وَلَا تَاْيۡ‍َٔسُواْ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ ] [يوسف: ٨٧]

“এবং আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না।”[12]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ ] [الزمر: ٥٣]

“তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না।”[13]

আর মুসলিম ব্যক্তি এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা’র ধরা বড় কঠিন, তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি খুব দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী; ফলে সে তাঁর আনুগত্য করার মাধ্যমে তাঁকে ভয় করে এবং আত্মরক্ষা করে তাঁর অবাধ্য না হওয়ার মধ্য দিয়ে; ফলে এটাও আল্লাহ তা‘আলার সাথে তার পক্ষ থেকে আদব বলে গণ্য হয়; কারণ, কোনো বুদ্ধিমানের নিকটই এটা আদব বলে গণ্য হবে না যে, একজন দুর্বল আক্ষম বান্দা মহাপরাক্রমশালী প্রবল শক্তিধর মহান ‘রব’ আল্লাহ তা‘আলার মুখোমুখী হবে বা তাঁর বিরোধিতা করবে; অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ وَإِذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِقَوۡمٖ سُوٓءٗا فَلَا مَرَدَّ لَهُۥۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَالٍ ] [الرعد: ١١]

“আর কোনো সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছে করেন, তবে তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই।”[14]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ إِنَّ بَطۡشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ ] [البروج: ١٢]

“নিশ্চয় আপনার রবের পাকড়াও বড়ই কঠিন।”[15]

তিনি আরও বলেন:

[ وَٱللَّهُ عَزِيزٞ ذُو ٱنتِقَامٍ ] [ال عمران: ٤]

“আর আল্লাহ মহা-পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।”[16]

আর মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়ার মুহূর্তে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁর প্রতি এমনভাবে লক্ষ্য করে যে, মনে হয় যেন আল্লাহর দেওয়া হুমকি তাকে পেয়ে বসেছে, তাঁর আযাব বুঝি তার প্রতি নাযিল হয়ে গেল এবং তাঁর শাস্তি যেন তার আঙ্গিনায় আপতিত হল; অনুরূপভাবে সে তাঁর আনুগত্য করার মুহূর্তে এবং তাঁর শরী‘য়তের অনুসরণ করার সময় তাঁর প্রতি এমনভাবে লক্ষ্য করে যে, মনে হয় যেন তিনি তাঁর দেয়া প্রতিশ্রুতি তার জন্য সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন এবং তাঁর সন্তুষ্টির চাদর খুলে তাকে ঢেকে দিয়েছেন; সুতরাং এটা হলো মুসলিম ব্যক্তির পক্ষ থেকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সুধারণা বিশেষ; আর আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটা আদব বা শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত; কেননা, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করাটা কোনো ভাবেই আদবের মধ্যে পড়ে না; কারণ, সে তাঁর অবাধ্য হয়ে চলবে এবং তাঁর আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে, আর ধারণা করবে যে, তিনি তার ব্যাপারে অবগত নন এবং তিনি তাকে তার পাপের জন্য পাকড়াও করবেন না; অথচ তিনি বলেন:

 [ وَلَٰكِن ظَنَنتُمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَا يَعۡلَمُ كَثِيرٗا مِّمَّا تَعۡمَلُونَ ٢٢ وَذَٰلِكُمۡ ظَنُّكُمُ ٱلَّذِي ظَنَنتُم بِرَبِّكُمۡ أَرۡدَىٰكُمۡ فَأَصۡبَحۡتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ] [فصلت: ٢٢،  ٢٣]

“বরং তোমরা মনে করেছিলে যে, তোমরা যা করতে তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না। আর তোমাদের রব সম্বন্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদের ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা হয়েছ ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।”[17]

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার সাথে এটাও আদব নয় যে, বান্দা তাঁকে ভয় করবে ও তাঁর আনুগত্য করবে এবং ধারণা করবে যে, তিনি তাকে তার ভালো কাজের প্রতিদান দিবেন না এবং তার পক্ষ থেকে তিনি তাঁর আনুগত্য ও ‘ইবাদতকে কবুল করবেন না; অথচ তিনি বলেন:

[ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَخۡشَ ٱللَّهَ وَيَتَّقۡهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَآئِزُونَ ] [النور: ٥٢]

“আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে তারাই কৃতকার্য।”[18]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ] [النحل: ٩٧]

“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।”[19]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ عَشۡرُ أَمۡثَالِهَاۖ وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَا وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ  ] [الانعام: ١٦٠]

“কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার দশ গুণ পাবে। আর কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু তার অনুরূপ প্রতিফলই দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।”[20]

আর মূলকথা হলো: মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক তার প্রতিপালকের দেয়া নি‘য়ামতের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করা, তাঁর অবাধ্যতার দিকে ধাবিত হওয়ার সময় তাঁকে লজ্জা পাওয়া, তাঁর কাছে সত্যিকার অর্থে তাওবা করা, তাঁর উপর ভরসা করা, তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে এবং তাঁর ইচ্ছা মাফিক তাঁর কোনো বান্দার প্রতি শাস্তিমূলক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাঁর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটাই হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে তার আদব রক্ষা করে চলা; আর বান্দা কর্তৃক এ আদবের যতটুকু ধারণ ও রক্ষা করে চলবে, ততটুকু পরিমাণে তার মর্যাদা সমুন্নত হবে, মান উন্নত হবে এবং সম্মান বৃদ্ধি পাবে; ফলে সে আল্লাহর অভিভাবকত্ব ও তা তাঁর তত্ত্ববধানে থাকা ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাঁর রহমত ও নি‘য়ামত পাওয়ার উপযুক্ত হবে।

আর এটাই মুসলিম ব্যক্তির দীর্ঘ জীবনের একমাত্র চাওয়া এবং চূড়ান্ত প্রত্যাশা। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার অভিভাবকত্ব নসীব করুন, আপনি আমাদেরকে আপনার তত্ত্ববধান থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার নিকটতম বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত করুন; হে আল্লাহ! হে জগতসমূহের প্রতিপালক! আমাদের আবেদন কবুল করুন।

……………………………………………………


[1] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৩

[2] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৮

[3] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫২

[4] সূরা নূহ, আয়াত: ১৩ – ১৪

[5] সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৪

[6] সূরা ইউনুস, আয়াত: ৬১

[7] সূরা হুদ, আয়াত: ৫৬

[8] সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫০

[9] সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২৩

[10] সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৬

[11] সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ১৯

[12] সূরা ইউসূফ, আয়াত: ৮৭

[13] সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩

[14] সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১১

[15] সূরা আল-বুরূজ, আয়াত: ১২

[16] আলে ইমরান, আয়াত: ৪

[17] সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ২২ – ২৩

[18] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫২

[19] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৯৭

[20] সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬০

আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি (Video Reminder)

$
0
0

 

বক্তাঃ নুমান আলী খান

বইঃ আবু বকর (রাঃ) সম্পর্কে ১৫০ টি শিক্ষণীয় ঘটনা

$
0
0

HBOOK007সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃরাসুলুল্লাহ ( ﷺ ) এর পর এ পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন খুলাফায়ে রশিদীন (রাঃ) তাদের মধ্যে প্রথম খলীফা ছিলেন আবু বকর (রাঃ)। তাঁর জীবনী ইসলামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানবজাতির ইতিহাস আবু বকর (রাঃ) এর সম্মান, মর্যাদা, একনিষ্ঠতা, জিহাদ, এবং দাওয়াত এর এক চিরন্তন সাক্ষী। লেখক তার এই বইয়ে আবু বকর (রাঃ) এর জীবন, চরিত্র, মর্যাদা সহ এমন ১৫০ টি  শিক্ষণীয়  বিষয়ের উপর দলীলভিত্তিক আলোচনা করেছেন। বইটি একজন দায়ী, খতীব সহ সাধারণ পাঠক, উলামায়ে কেরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ, ও সর্বস্তরের জ্ঞানপিপাসুদের উপকারে আসবে বলে আমরা আশা করি।

আবু বকর (রাঃ) সম্পর্কে ১৫০ টি শিক্ষণীয় ঘটনা – QA Server

আবু বকর (রাঃ) সম্পর্কে ১৫০ টি শিক্ষণীয় ঘটনা – Mediafire

আপনার সন্তান থেকে আপনি কী চান?

$
0
0

125098-christmas-gift

লেখকঃ আহমেদ রফিক

গাজিপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। বাসে উঠে বসলাম। কিছুক্ষন পর এক মুরব্বী উঠে আমার পাশেই বসলেন। আমি সালাম দিলাম। স্নিগ্ধ কোমল চেহারা। শ্বেত-শুভ্র লম্বা দাড়ি। দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে। বয়সের ভারে বেশ ন্যুজ বোঝা যায়। যেন জোর করেই লুকোনোর চেষ্টা। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট পরা। ইন করা। হাতে একটি এক্সিকিউটিভ ফাইল। কাগজ-পত্র ভরা।

কিছুক্ষন পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা আপনার নাম? নাম বললাম। জিজ্ঞেস করলেন কী করেন? সংক্ষেপে বললাম। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় থাকেন। বললাম। জানতে চাইলেন বাসায় কে কে আছে।

বললাম, আলহামদু লিল্লাহ সবাই আছে। বাবা-মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে।

প্রশ্ন করলেন, ছেলে মেয়ে ক’টা? বললাম, আলহামদু লিল্লাহ আমার মোট ছয় ছেলে-মেয়ে। চারটা ছোট, আর দু’জন বড়।

মনে হয় তিনি পুরো কথাটা ধরতে পারেননি। বললেন, কী বলছেন?

বললাম, হ্যা চাচা, আমার নিজের চার ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়ে, দুই ছেলে। আর বুড়ো দুই সন্তান হলেন আমার বাবা মা।

জিজ্ঞেস করলেন, বাবা মা কি আপনার সাথেই থাকেন?

বললাম, সব সময় থাকেন না। মানুষের ভীড়ে ঢাকা শহরে বাবার না কি দম বন্ধ হয়ে আসে। উনি গ্রামেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তাই বাবা মা গ্রামেই থাকেন। কিন্তু নাতীদের টানে আবার গ্রামেও তাদের মন টেকে না। তাই এখন এখানেই আছেন। সারাক্ষন নাতী-নাতনীদের নিয়ে থাকেন। দেখছি, এখানেই ওনারা বেশ আনন্দে আছেন আলহামদু লিল্লাহ। তাই আমিও ওনাদেরকে আর গ্রামে যেতে দিতে চাই না। মাঝে-মধ্যে গ্রামের বাড়িঘর, জায়গা-জমি দেখা শোনার জন্য গিয়ে কিছু দিন থেকে আবার চলে আসবেন।

বললাম, চাচা আপনি আমার বাবার চেয়েও বয়সে অনেক বড় হবেন মনে হয়। আমাকে তুমি করে বলেন। আপনার মুখে ‘আপনি’ করে শুনতে আমার আন-ইজি লাগছে।

বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, থ্যাংক ইউ।

কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছিলো ভদ্রলোকের সাথে। দেখলাম, উনি আর কিছু জিজ্ঞেস করছেন না। অগত্যা আমিই জানতে চাইলাম ওনার কথা। কী করেন, ছেলে-মেয়ে ক’টা, কী করে ইত্যাদি।

ছেলে-মেয়েদের কথা বললেন। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, অ্যামেরিকাতে থাকে। মেঝ ছেলে এই দেশেরই একজন উপ-সচিব। এর পর তার আরেকটি মেয়েও আছে। সে যুক্তরাজ্যে স্বামীর সাথে থাকে; সেখানকার নাম করা একটি কলেজের শিক্ষক। তিনি নিজে একটি সি.এ ফার্মে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন।

এরপর কিছুক্ষন নিরবে কেটে গেলো। আমি মনে হয় অন্য কিছু চিন্তা করছিলাম, না যেন ফোনে কথা বলছিলাম।
হঠাৎ ফিরে দেখলাম ভদ্রলোক চোখ মুছছেন। পানি বেয়ে পড়ছে গণ্ড বেয়ে। আমি ভাবলাম, শরীরে কোনো আঘাত-টাঘাত পেয়েছেন হয়তো। বললাম, চাচা কী হয়েছে? বললেন, কিছু না বাবা।

আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। কী করবো, কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। বললাম, চাচা কিছু মনে না করলে আমাকে বলুন কী হয়েছে? কিছুক্ষণ হাতের রুমালে চোখ চেপে রেখে, কী হয়েছে সেটা না বলে তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা-মা সত্যিই সৌভাগ্যবান’।

বললাম, আলহামদু লিল্লাহ। দোয়া করবেন, যেন আজীবন ওনাদের খিদমত করে যেতে পারি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাচা আপনার এই বয়সে এভাবে বাসে দৌড়-ঝাপ করে চলাফেরা করতে কষ্ট হয় না? কেনই বা করেন? আপনার ছেলে-মেয়েরা তো সব সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বচ্ছল!

বললেন, কষ্ট তো হয়ই বাবা, কিন্তু না করেও তো উপায় নেই!

বললাম, কেন, আপনার সন্তানরা…?

বললেন, তাদের সময় নেই খোজ খবর নেওয়ার। তারা তাদের নিজেদের জীবন-ক্যারিয়ার নিয়ে এতো ব্যাস্ত যে সময়ই পায় না। টাকা-পয়সাও পাঠায় না। আমার তো স্ত্রী আছে। আমার ও তার জীবনধারণের জন্য হলেও আমাকে এই বয়সে চাকুরি করতে হচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা বলে, আমি বসে থাকলে নাকি অসুস্থ অচল হয়ে পড়বো, ডায়াবেটিক প্রেসারে আক্রান্ত হবো। অতএব আমার খেটে খাওয়া উচিৎ।

আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। শুধু তাকিয়ে রইলাম কতোক্ষণ। অসহায়ের মতো। ভাবছিলাম এই আধুনিক বস্তুবাদী সেক্যুলার সমাজব্যবস্থার কথা। এখান থেকে কী তৈরি হচ্ছে! এতো মানুষকে জন্তু জানোয়ার বানানোর কারখানা হয়ে দাড়িয়েছে! কোথায় যাচ্ছি আমরা! কিসের পেছনে ছুটে চলছি। কোথায় হারিয়ে গেলো আমাদের শান্তির সুখ পাখিটি? কোথায়? কে দায়ভার নেবে এই অসহায় বৃদ্ধার? কে তাকে শান্তনা দেবে? কে রুমালটা এগিয়ে দেবে অন্তত, তার চোখের জলটুকু মোছার?

বললাম, চাচা দোয়া করেন ছেলে-মেয়েদের জন্য, আল্লাহ ওদেরকে সঠিক বুঝ দান করবেন। চাচা বললেন, দোয়া তো করি, কিন্তু দোয়া তো কবুল হচ্ছে না…।. বললাম চাচা দোয়া করতে থাকেন। দোয়া আল্লাহ নিশ্চয়ই কবুল করেন; যদি তা সঠিকভাবে হয়। এই দেখুন, আমার বাবাকে আমি ছোট সময় থেকে দেখেছি, তিনি আল্লাহর কাছে কেবল একটিই দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে খাটি মুসলিম বানাও, দ্বীনদার বানাও। আমি কতোটুকু দ্বীনদার খাটি মুসলিম হতে পেরেছি তা জানি না। ভুল-ত্রুটি, গুনাহ খাতা তো হর হামেশাই করে ফেলি। কিন্তু বাবা-মায়ের খেদমত করার চেষ্টা করি আপ্রান। এটা শুধু বাবা-মা’র সন্তুষ্টির জন্যই যে করি—তা নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করি মুলত। কারণ আমার দ্বীন, আমার ইসলাম আমাকে এটা শিখিয়েছে চাচা। আমার দ্বীনই আমাকে শিখিয়েছে যে, বাবা মা যে সন্তানের উপর সন্তুষ্ট নয় আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট নন।

দেখুন চাচা, আমার বাবা অনেক পয়সাওয়ালা মানুষ ছিলেন না। অনেক আবদারই অনেক সময় পুরণ করতে পারেন নি। তথাকথিত নামি-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও লেখা-পড়া করাতে পারেননি হয়তো। সামর্থ্যে যতোটুকু ছিলো চেষ্টা করেছেন। আমি হয়তো অ্যামেরিকান কোনো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়নি, অন্তত বাবা-মা’র চক্ষু-শীতলকারী সন্তান হতে পেরেছি, আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন আজীবন ওনাদের চক্ষু শীতলকারী হয়ে থাকতে পারি।

চাচা অপলক তাকিয়ে আছেন। বললাম, চাচা, আপনার দোয়াও নিশ্চয়ই কবুল হয়েছে। আপনি মনে করুন তো, আপনার সেই তরুণ বয়সের কথা। যখন আপনার সন্তানগুলো জন্মগ্রহণ করেছিলো। আপনি তাদের লেখা-পড়া, ভবিষ্যত নিয়ে কতো চিন্তিতো ছিলেন! কতো উদ্বিগ্ন! দোয়া কি করতেন না তখন? অবশ্যই করতেন। মনে করুন তো কী দোয়া করতেন?

চাচা বললেন, হ্যা বাবা! দোয়া করতাম তারা যেন বড় হয়, শিক্ষিত হয়। সমাজে আমার মুখ উজ্জ্বল করে। সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারে…।

বললাম, চাচা দেখেন, আপনার দোয়া কিন্তু কবুল হয়েছে! আপনি যা চেয়েছিলেন তা কিন্তু হয়েছে। তারা বড় শিক্ষিত হয়েছে, সমাজে আপনার মুখও উজ্জ্বল করেছে। ভালো করে মনে করে দেখেন চাচা, আপনার সন্তানদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কিন্তু আপনি গুরুত্ব দেননি। তাদেরকে মহান স্রষ্টা আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াকে গুরুত্ব দেননি। কখনো হাত তুলে এই বলে কান্নাকাটি করেননি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানদেরকে ভালো দ্বীনদার বানাও, ভালো মুসলিম বানাও, ঈমানদার বানাও। কখনো বলেননি, রব্বানা, হাব লানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা কুররাতা আ’ইউন, ওয়াজ ‘আলনা লিল মুত্তাকীনা ইমামা।

চাচা দেখুন, আমরা যারা পিতা-মাতা, আমরা কিন্তু দাতা নই, আয়োজক মাত্র। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে খাদ্য-খাবার, পোষাক আশাক যা কিছুই দেই না কেন, আমরা কিন্তু নিছক ব্যবস্থাপক। মুল দাতা হলেন মহান দয়ালু ও রিজিকদাতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। আমরা যদি মুল মালিকের প্রতি তাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে না শিখাই, তাহলে কিভাবে আশা করতে পারি যে, তারা আমাদের প্রতি শেষ পর্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবে?

চাচা এই যে বৃদ্ধ বাবা-মা’র যত্ন না নেওয়া এটা কি মানবতার জন্য একটি বিপর্যয় নয়?

চাচা বললেন, এটা শুধু বিপর্যয় নয়, মহা বিপর্যয়। এটা মানুষত্যের মর্যাদা থেকে মানুষের পশুর পর্যায়ে নেমে যাওয়ার নামান্তর।

এই অসভ্যতা কোত্থেকে আমাদের মুসলিম সমাজে এসেছে জানেন চাচা? এসেছে বস্তুবাদীতা থেকে, পশ্চিমা অসভ্যতা থেকে। মুসলিম দেশে কখনো কোনো মানুষ পালার খোয়াড় ছিলো না। আজ আমরা তাদেরকে আমাদের চরম পরম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমাদের দেশেও এখন এই খোয়াড় ব্যবস্থা এসেছে। গুড়োদের খোয়াড়, বুড়োদের খোয়াড়। বাংলায় বললে কেমন যেন অসভ্যতা নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে যায়। তাই আদুরে নামে এরা ইংলিশে বলে ‘ডে কেয়ার’ বা ‘ওল্ড হোম’।. শিশুকালে আপনি সন্তানকে ডে কেয়ারে রাখবেন, বুড়ো হলে তারা আপনাদেরকে ওল্ড হোমে রেখে আসবে।

দ্বীনদার না হওয়া সত্ত্বেও অনেকে হয়তো মানবিক বোধ থেকে বাবা মা’র খোজ-খবর রাখতে পারেন, দেখা-শোনা করতে পারেন। কিন্তু একজন দ্বীনদার সন্তানের কাছ থেকে বাবা সত্যি কেমন আদর-যত্ন ও সম্মান শ্রদ্ধা পেতে পারেন তা কেবল সেই বাবা-মা’রাই জানেন, যাদের দ্বীনদার সন্তান আছে।

ঢাকায় আমি আমার স্টপেজের কাছে এসে চাচার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, চাচা আপনি মুরব্বী মানুষ, অনেক কথা বলেছি, ভুলত্রুটি মাফ করে দিয়েন। চাচার চোখ আবার ছলছল করে উঠলো। ক্ষণিকের পরিচয়ে মনে হয় অনেক আপন হয়ে পড়েছিলাম। বাস থেকে নেমেও দেখলাম, চাচা তাকিয়ে আছেন জানালা দিয়ে। আবারো হাত নাড়লাম। দোয়া করলাম, হে আল্লাহ! তুমি ভালো রেখো চাচাকে।

এ সমস্যা শুধু বাসে দেখা হওয়া এই চাচারই নয়। তিনি এই সমাজের একটি দর্পনমাত্র। আমি এমন আরো অনেক দেখেছি। আপনিও দেখেছেন নিশ্চয়ই অনেক। আপনার একই বিল্ডিং এ, পাড়ায়, মহল্লায়, আত্মিয় ও বন্ধু বান্ধবের পরিবারে। মাতাল, হিরোইন, গাজা, ডাইল সহ নানা রকম মাদকসেবী সন্তানদের ঘটনা তো অহরহ দেখবেন আপনার চারপাশে। এদের কথা না হয় বাদই দিলাম।

আমার নানা বাড়ি এলাকায় এক উকিল সাহেব ছিলেন। নাম আতাহার আলী। ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায় লেখাপড়া করতে। ছেলেকে টাকা পাঠাতে পাঠাতে তিনি একরকম নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। ওদিকে ছেলে এক সাদা মেয়েকে বিয়ে করে মৌজ মাস্তিতে ব্যাস্ত। বাবা ছেলের দুঃখে কাদতে কাদতে মারা গেছেন। বাবাকে দেখতেও আসেনি সে। অনেক দিন পর তার অ্যামেরিকান বৌ নিয়ে বেড়াতে এসেছিলো মাকে দেখতে। ঘন্টা দুয়েক গ্রামের বাড়িতে থেকে তার সাদা বৌ ক্লান্ত। স্বামীকে ধমক দিয়ে বলেছিলো, ‘ইট ইজ ঠু লেইট, লেটস গো…’

আপনি আপনার সন্তানকে ডাক্তার বানান, ইঞ্জিনিয়ার বানান, প্রফেসর বানান, বিজ্ঞানী বানান—কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সবার আগে যদি ভালো মুসলিম না বানান তাহলে প্রস্তুত থাকুন সে দিনের জন্য যেদিনের কান্নার কোনো শেষ নেই। এ কান্না অনেকের এই চাচার মতো, এই উকিল সাহেবের মতো দুনিয়াতেই শুরু হয়ে যায়। কারো ভাগ্যক্রমে দুনিয়াতে শুরু নাও হতে পারে। কারণ দুনিয়া মুলত সাধারণভাবে শাস্তির জায়গা নয়। শাস্তির জায়গা হলো আখিরাত। দুনিয়াতে কাউকে কাউকে আল্লাহ শাস্তি দিয়ে দেখান, যাতে অন্যরা শিক্ষা গ্রহণ করে। আল্লাহ তা ‘আলা বলেন,

জলেস্থলে যতো বিপর্যয়/অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা মানুষেরই হাতের কামাই। এর উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিছু ফল ভোগ করানো, যাতে তারা ফিরে আসে। [সুরা আর রূম, আয়াত ৪১]

দুনিয়াতে বেচে গেলেও আপনার এই প্রানপ্রিয় সন্তানেরা কিন্তু আখিরাতে আপনারই বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে আল্লাহর দরবারে। কেন আপনি তাদেরকে দ্বীন শিখাননি!

আপনার সন্তান, আপনারই সিদ্ধান্ত। তাদেরকে কি আপনি আপনার দুনিয়ার শান্তি ও জান্নাতের উসিলা বানাবেন, নাকি দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর আখিরাতের শাস্তির কারণ বানাবেন। সেটা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত! হ্যা একান্তই আপনার!!!

Viewing all 995 articles
Browse latest View live