সংকলন: শাইখ আব্দুর রহমান বিন নাসের আস-সাদী | অনুবাদক: মোঃ আমিনুল ইসলাম | সম্পাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া ও মোঃ আব্দুল কাদের
পর্ব -১ | পর্ব - ২
৭. জীবন উপকরেণর ক্ষেত্রে নিম্নমানের ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করা: এই বিষয়ে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হল বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিক নির্দেশনার বাস্তবায়ন করা। তিনি বলেন:
« انْظُرُوا إِلَى مَنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ».
“তোমরা তোমাদের চেয়ে নিম্নমানের ব্যক্তির দিকে তাকাও। আর তোমাদের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির দিকে তাকিও না। কারণ, সে উপযুক্ত ও যোগ্যব্যক্তি। আর তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতকে তুচ্ছ মনে করো না।” —(বুখারী ও মুসলিম)
সুতরাং বান্দার কপালে যখন গৌরবময় ভাগ্যরেখা অঙ্কিত হয়, তখন সে নিজেকে সুস্থতা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট আনুসাঙ্গিক বিষয়ে এবং রিজিক ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট আনুসাঙ্গিক বিষয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর সৃষ্ট বান্দাদের অনেকের চেয়ে উন্নত মনে করে। ফলে তার অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা দূর হয় এবং তার আনন্দ ও আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি তার সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যখনই আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, দীনী ও দুনিয়াবী নিয়ামতের প্রতি বান্দার আশা-আকাঙ্খা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে, তখনই সে তার রবকে দেখে যে, তিনি তাকে অনেক কল্যাণ দান করেছেন এবং তারে থেকে বহু অকল্যাণ দূর করেছেন। কোন সন্দেহ নেই যে, তার এই আশা-আকাঙ্খা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনাসমূহ দূর করবে এবং হাসি-খুশি ও আনন্দকে আবশ্যক করে তুলবে।
৮. দুশ্চিন্তার কারণ দূরকরণে ও সুখ-শান্তি অর্জনের উপায় অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়া: দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করার এবং সুখ-শান্তি অর্জন করার অন্যতম উপায় হচ্ছে দুশ্চিন্তার কারণ দূরকরণে ও সুখ-শান্তি অর্জনের উপায় অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়া। আর তা হচ্ছে ব্যক্তি তার অতীতে ঘটে যাওয়া দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাবে, যা তার পক্ষে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব এবং তাকে বুঝতে হবে যে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা অনর্থক কাজ। আর এ ধরনের কাজ আহাম্মকী ও পাগলামী যে, তার মন অতীতে ঘটে যাওয়া দুঃখ-কষ্ট নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে উঠবে এবং ঠিক একইভাবে তার মন ভবিষ্যৎ জীবনের কাল্পনিক অভাব-অনটন, ভয়-ভীতি ইত্যাদি ধরনের দুঃখ-কষ্টের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠবে।
সুতরাং তাকে জানতে হবে যে, ভবিষ্যতকালীন বিষয়াদি অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট; তার মধ্যে ভাল, মন্দ আশা-হতাশা এবং দুঃখ-বেদনা সবই থাকতে পারে। আর তা মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর হাতে। তার কোন কিছুই বান্দাদের হাতে নয়। বান্দা শুধু তা থেকে কল্যাণসমূহ অর্জনে এবং অকল্যাণসমূহ থেকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট থাকবে। আর বন্দাকে আরও জানতে হবে যে, সে যখন ভবিষ্যতকালীন বিষয় নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও চিন্তা-ভাবনা থেকে ফিরে আসবে; তার ভাল-মন্দের ব্যাপারে তার প্রতিপালকের উপর ভরসা করবে এবং এই ব্যাপারে তার প্রতি আস্থাশীল হবে, তখন তার অন্তর শান্তি অনুভব করবে; তার অবস্থার উন্নতি হবে এবং তার সকল দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর হয়ে যাবে।
৯. দীন, দুনিয়া ও আখেরাতকে সুন্দর করার জন্য প্রার্থনা: ভবিষ্যৎ বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার সবচেয়ে উপকারী পন্থা হল এই দো‘আটি যার দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন:
« اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِى دِينِىَ الَّذِى هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِى وَأَصْلِحْ لِى دُنْيَاىَ الَّتِى فِيهَا مَعَاشِى وَأَصْلِحْ لِى آخِرَتِى الَّتِى فِيهَا مَعَادِى وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِى فِى كُلِّ خَيْرٍ وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لِى مِنْ كُلِّ شَرٍّ ».
“হে আল্লাহ! তুমি আমার দীনকে সংশোধন করে দাও, যা আমার কর্ম-কাণ্ডকে পাপমুক্ত রাখবে; তুমি আমার দুনিয়াকে সংশোধন করে দাও, যার মধ্যে আমার জীবন-জীবিকা রয়েছ এবং তুমি আমার আখেরাতকে সংশোধন করে দাও, যেখানে আমাকে ফিরে যেতে হবে। আর তুমি প্রতিটি কল্যাণের জন্য আমার হায়াতকে বাড়িয়ে দাও এবং খারাপ বা অকল্যাণের চেয়ে আমার জন্য মৃত্যুকে আনন্দদায়ক করে দাও।” —(মুসলিম, যিকির, দো‘আ ও তাওবা, বাব নং- ১৮, হাদিস নং- ৭০৭৮)
অনুরূপভাবে তিনি আরও বলেন:
« اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلاَ تَكِلْنِى إِلَى نَفْسِى طَرْفَةَ عَيْنٍ وَأَصْلِحْ لِى شَأْنِى كُلَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ ».
“হে আল্লাহ! আমি শুধু তোমার রহমতেরই প্রত্যাশা করি, সুতরাং তুমি এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ো না। আর তুমি আমার সকল বিষয় সংশোধন করে দাও; তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই।” —(আবু দাউদ, আদব, বাব নং- ১১০, হাদিস নং- ৫০৯২; আলবানী হাদিসটির সনদকে হাসান বলেছেন)
সুতরাং বান্দা যখন এই দো‘আটি বিশুদ্ধ নিয়তে মনোযোগ দিয়ে তার বাস্তব দিক নিয়ে চিন্তা-গবেষণাসহ পাঠ করবে, যার মধ্যে তার দীনী ও দুনিয়াবী ভবিষ্যৎ কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তখন আল্লাহ তার প্রার্থনা, প্রত্যাশা ও সে জন্য তার কাজ করাকে বাস্তবে রূপ দেবেন এবং তার দুশ্চিন্তাকে খুশি ও আনন্দে রূপান্তরিত করবেন।
১০. বিপদ-মুসিবত লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করা: বান্দা যখন দুর্ঘটনা কবলিত হয়, তখন তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম কার্যকারী উপায় হল তা লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করা এবং তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়া। সুতরাং সে যখন এ জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে, তখন তার কর্তব্য হল সম্ভাব্যতার আলোকে যতটুকু লাঘব করা সম্ভব ততটুকু লাঘবের জন্য চেষ্টা-সাধনা করা। অতএব তার এই প্রস্তুতি ও ফলপ্রসু চেষ্টা-সাধনার দ্বারা তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তাসমূহ দূর হবে। আর এই চেষ্টা-সাধনার বিনিময়ে বান্দর জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা আসবে এবং বহু ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিরোধে হবে।
সুতরাং যখন তাকে ভয়-ভীতি, রোগ-ব্যাধি, অভাব-অনটন ও বিভিন্ন প্রকার পছন্দনীয় বস্তুর ঘাটতির কারণসমূহ আচ্ছন্ন করে ফেলবে, তখন সে যেন এতেই প্রশান্তি লাভ করে এবং নিজের জন্য এই পরিবেশকে অথবা তার চেয়ে আরও কঠিন পরিবেশকে বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ, দুঃখ-কষ্টের সম্ভাবনাময় পরিবেশে কোন ব্যক্তি বসবাস করলে তার জন্য তা থেকে উত্তরণ সহজ হয় এবং তার ভয়াবহতা দূর হতে থাকে। বিশেষ করে যখন সে নিজেকে তার সাধ্যানুযায়ী দুঃখ-কষ্ট প্রতিরোধে ব্যস্ত রাখে, তখন সে বিপদ-মুসিবত দূর করার জন্য ফলপ্রসু চেষ্টা-সাধনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বসবাস করতে থাকে এবং দুঃখ-কষ্ট মূলোৎপাটনে আল্লাহর উপর ভরসা ও সুন্দর আস্থা রেখে নতুন নতুন শক্তি ও কৌশল প্রয়োগে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। কোন সন্দেহ নেই যে, বান্দার ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন প্রতিদান লাভের আশা-আকাঙ্খার সাথে সাথে সুখ-শান্তি ও হৃদয়ের প্রসারতা ও উদারতার গুণ অর্জনে এসব কর্ম-কাণ্ডের বিরাট উপকারিতা রয়েছে। আর এটা অভিজ্ঞতালব্ধ দৃশ্য বা দৃষ্টান্ত, যা সংঘটিত হয় অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষ থেকে।
১১. মনোবল বৃদ্ধি এবং কল্পনাপ্রসূত অস্বস্তি ও আবেগ-উত্তেজনা বর্জন করা: মানসিক ও শারীরিক রোগ চিকিৎসার অন্যতম উপায় হচ্ছে মনোবল বৃদ্ধি এবং কল্পনাপ্রসূত অস্বস্তি ও আবেগ-উত্তেজনা বর্জন করা, যা দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার জন্ম দেয়। কারণ, মানুষ যখন কল্পনার নিকট আত্মসমর্পন করে এবং তার মন যখন রোগ-ব্যাধি, ক্রোধ, বেদনাদায়ক কারণে বিশৃঙ্খলা, দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হওয়া ইত্যাদির প্রভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠে, এসব তখন তাকে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, মানসিক ও শারীরিক রোগ এবং স্নায়ুবিক দুর্বলতার দিকে ঠেলে দেয়; তার এমন অনেক কুপ্রভাব রয়েছে, যার বহু ক্ষতিকারক দিক সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করে।
১২. আল্লাহর উপর ভরসা করা: যখন বন্দার অন্তর আল্লাহ নির্ভরশীল হয়, সে নিজেও তার (আল্লাহর) উপর ভরসা করে, আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার নিকট আত্মসমর্পন না করে, দুশ্চিন্তা ও খারাপ কল্পনার অধিকারী না হয়, আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয় এবং তার অনুগ্রহের আশা-আকাঙ্খা পোষণ করে, এসব দ্বারা তখন তার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনাসমূহ প্রতিরোধ হবে এবং তার মানসিক ও শারীরিক রোগসমূহ দূর হয়ে যাবে। আর মানসিক শক্তি, উদারতা ও প্রফুল্লতা অর্জিত হবে। সুতরাং অনেক হাসপাতাল ভরপুর হয়েছে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনাগ্রস্ত মানসিক রোগীদের দ্বারা। আর এসবের কারণে দুর্বল ব্যক্তি ছাড়াও অনেক শক্তিশালী লোকের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে এবং আহাম্মক ও পাগলে পরিণত করেছে। তার প্রভাব থেকে শুধু ঐ ব্যক্তিই বেঁচে গেছে, যাকে আল্লাহ ক্ষমা করেছেন এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি ও মনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার ফলপ্রসু উপায় অবলম্বনের যথাযথ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করার তাওফিক দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُ ﴾ [الطلاق:3]
“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।” —(সূরা আত-তালাক: ৩)
সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসাকারী ব্যক্তি মানসিকভাবে শক্তিশালী, যাকে কোন কুধারনা ও দুশ্চিন্তা- দুর্ভাবনা প্রভাবিত করতে পারে না। আর তাকে কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা বিরক্ত করতে পারে না তার এই জ্ঞান থাকার কারণে যে, নিশ্চয় এটা মানসিক দুর্বলতা এবং অবাস্তব ভয়-ভীতির কারণে সংঘটিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও সে জানে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনি তার সকল দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে সে আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয় এবং তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। এতে তার দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর হয়; দুঃখ সুখে পরিণত হয়; দুঃখ-কষ্ট আনন্দে রূপান্তর হয় এবং ভয়-ভীতি পরিণত হয় নিরাপত্তায়। সুতরাং আমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুস্থতা কামনা করছি এবং আরও প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদের উপর অনুগ্রহ করেন মানসিক শক্তি ও তাঁর উপর পূর্ণ ভরসায় অটল থাকার দ্বারা, যে ভরসার কারণে আল্লাহ তার সকল কল্যাণের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং সকল অকল্যাণ ও ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিরোধ করবেন।
১৩. মন্দ আচরণের পরিবর্তে ইহসান করা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
« لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ ».
“কোন মুমিন বান্দা কোন মুমিন বান্দীকে ঘৃণা করবে না। তার কোন আচরণকে সে অপছন্দ করলেও তার কোন কোন আচরণকে সে পছন্দ করবে।” —(মুসলিম, রিদা‘, বাব-১৮, হাদিস নং- ৩৭২১)—এর মধ্যে দুইটি বড় ফায়দা রয়েছে:
ফায়দা-১: স্ত্রী, নিকটাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও কর্মচারীর সাথে আচার-ব্যবহারের দিকনির্দেশনা; এদের প্রত্যেকের সাথে তোমার একটা ভাল সম্পর্ক রয়েছে। আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য এমন হওয়া উচিত যে, ব্যক্তির মধ্যে দোষ-ত্রুটি অথবা এমন কোন বিষয় রয়েছে যা আপনি অপছন্দ করেন; সুতরাং আপনি যখন তাকে এই অবস্থায় পাবেন, তখন আপনি বর্তমান পরিস্থিতি ও আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে তুলনামূলক পর্যালোচনা করুন। আপনার উচিৎ হবে তার মধ্যকার ভাল দিকগুলো ও বিশেষ ও সাধারণ উদ্দেশ্যসমূহের উল্লেখ করে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা এবং ভালবাসাকে স্থায়ী রূপ দেয়া। আর এভাবে মন্দ দিকগুলোকে উপেক্ষা করে এবং ভাল দিকগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক অব্যাহত রাখা এবং তার জন্য শান্তি ও আনন্দকে পরিপূর্ণ করা।
ফায়দা-২: দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করা; হৃদ্যতা বজায় রাখা; ওয়াজিব ও মুস্তাহাব অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা অব্যহত রাখা এবং উভয় দিক তথা ইহকালীন ও পরকালীন জগতে শান্তি অর্জন করা। আর যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, তা পথনির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করে না; বরং তার বিপরীত বিষয়কে পথনির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করে; অতঃপর খারাপ ও মন্দসমূহের দিকে দৃষ্টি দেয় এবং উত্তম ও সুন্দর বিষয়ের ক্ষেত্রে অন্ধের ভূমিকা পালন করে। ফলে সে নিশ্চিতভাবে অস্থিরতা অনুভব করে; তার মধ্যে ও যিনি তার সাথে ভালবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চান, তাদের উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় এবং তাদের উপর পরস্পরের অধিকার সংরক্ষণের যে দায়িত্ব রয়েছে, তার সিংহভাগ দায়িত্ব পালন সঙ্কোচিত হয়ে যায়।
চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেই বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ ও বিপদ-মুসিবতের সময় নিজেদেরকে ধৈর্যধারণ ও শান্ত থাকার প্রবোধ দিয়ে থাকে; কিন্তু তারাই আবার অনেক তুচ্ছ বিষয়ে অস্থির হয়ে উঠে এবং পরিচ্ছন্নতাকে পঙ্কিলতায় পরিণত করে। এর একমাত্র কারণ হল, তারা বড় বড় বিষয়ের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে দায়িত্ববান মনে করে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের ক্ষেত্রে তেমন দায়িত্ববান মনে করে না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটে। সুতরাং বুদ্ধিমান লোক নিজেকে ছোট ও বড় সকল বিষয়েই দায়িত্ববান মনে করে এবং এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করে। এক মুহূর্তের জন্যও সে নিজেকে দায়িত্বহীন মনে করে না। ফলে তার নিকট ছোট-বড় সকল সমস্যাই সহজ হয়ে যায় এবং প্রশান্ত হৃদয়ে বহাল তবিয়তে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে থাকে।
১৪. বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানেন যে, তার সঠিক জীবনটাই সৌভাগ্যময় ও শান্তিময় জীবন। আর এটা খুবই সংক্ষিপ্ত। সুতরাং তার জন্য উচিত হবে না যে, দুশ্চিন্তা ও পাপ-পঙ্কিলতায় জড়িয়ে সে জীবনকে নষ্ট করা। অপরদিকে সঠিক জীবনের বিপরীত জীবনব্যবস্থা তার হায়াতকে সঙ্কুচিত করে দেয় এইভাবে যে, দুশ্চিন্তা ও পাপ-পঙ্কিলতার প্রস্তুতির কারণেই তার জীবন থেকে বহু সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। আর এ ক্ষেত্রে পুণ্যবান ও পাপীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু এই গুণটি (সৎগুণটি) প্রতিষ্ঠিত থাকার করণে মুমিন ব্যক্তির জন্য ইহকালে ও পরকালে পরিপূর্ণ ও উপকারী অংশ বরাদ্ধ রয়েছে।
১৫. বুদ্ধিমান ব্যক্তির আরও কর্তব্য হল, যখন সে দুঃখ-কষ্ট পাবে অথবা ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করবে, তখন সে দীনী ও দুনিয়াবী অর্জিত অপরাপর নিয়ামতসমূহ ও আক্রান্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করবে। অতঃপর পর্যালোচনার সময় তার নিকট এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, দুঃখ-কষ্টের চেয়ে নিয়ামত অনেক বেশি।
অনুরূপভাবে সে তার ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার বহু সম্ভাব্যতার তুলনামূলক পর্যালোচনা করবে; তখন তার নিকট ক্ষতির আশঙ্কার দুর্বল দিকটির চেয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার সম্ভাব্যতার শক্তিশালী দিকটিই প্রাধান্য পাবে। আর এর মাধ্যমে তার দুশ্চিন্তা ও ভয়-ভীতির আশঙ্কা দূর হয়ে যাবে এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে যা সংঘটিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে, তা প্রতিরোধের জন্য অথবা তা থেকে কিছুটা লাগব করার জন্য সে চেষ্টা-সাধনা করবে।
১৬. উপকারী বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তুমি জেনে রাখবে যে, মানুষ যদি তোমাকে কষ্ট দেয়, বিশেষ করে মন্দ কথার দ্বারা, তবে তাতে তোমার ক্ষতি হবে না; বরং তাদেরই ক্ষতি হবে। কিন্তু তুমি যদি সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত করে তোল, তখন তা তোমাকে ক্ষতি করবে, যেমনিভাবে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সুতরাং তুমি যদি তাতে কোন পরোয়া না কর, তবে তা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
১৭. আর তুমি জেনে রাখ যে, তোমার জীবন তোমার চিন্তা-চেতনার অনুসারী। সুতরাং তোমার চিন্তা-চেতনা যদি তোমার দীন ও দুনিয়ার জন্য উপকারী বিষয়ে হয়ে থাকে, তবে তোমার জীবন হবে সুন্দর, সৌভাগ্যময়। আর যদি তা না হয়, তবে ব্যাপারটি হবে তার বিপরীত। অর্থাৎ তখন তোমার জীবন হবে অসুন্দর ও দুর্ভাগ্যময়।
১৮. দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম উপকারী উপায় হল, তুমি মনকে এই কথার উপর স্থির করবে যে, তুমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট থেকে তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হউক তা দাবি করবে না। সুতরাং তুমি যখন তোমার উপর যার অধিকার আছে অথবা যার অধিকার নেই এমন ব্যক্তির উপর ইহসান করবে, তখন তুমি জেনে রাখবে যে, তোমার এই আচরণ আল্লাহর সাথে হয়েছে। আতএব তুমি যার উপর করুনা করেছ, তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরোয়া করবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির বিশেষ অধিকার প্রসঙ্গে বলেন:
﴿ إِنَّمَا نُطۡعِمُكُمۡ لِوَجۡهِ ٱللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمۡ جَزَآءٗ وَلَا شُكُورًا ٩﴾ [الإنسان:9]
“কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি, আমরা তেমাদের নিকট থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।” —(সূরা আল-ইনসান: ৯)
এই আয়াতটি পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্তুতির সাথে আচার-আচরণ ও লেন-দেনের ক্ষেত্রে এবং তাদের সাথে তোমার সম্পর্ক শক্তিশালী করার ব্যাপারে জোর দিয়েছে। সুতরাং যখন তোমার হৃদয় তাদের থেকে অনিষ্ট দূর করতে প্রস্তুত হয়, তখন তোমার অন্তর সুখ ও শান্তি অনুভব করে।
আর সুখ-শান্তির অন্যতম দাবি হল মান-মর্যাদা অর্জন ও তার জন্য কোন রকম অস্থিরতা ছাড়াই মনের দাবি অনুযায়ী কাজ করা; মান-মর্যাদা অর্জনের ব্যর্থতার ধাপগুলো সফলতায় রূপ দিতে ধীরনীতি অবলম্বন করা, আর এটাই বুদ্ধিদীপ্ত কাজ এবং মন্দ কাজের পরিবর্তে পরিচ্ছন্ন কর্মসুচী গ্রহণ করা। আর এর দ্বারা প্রকৃত হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং মনের পঙ্কিলতা দূর হবে।
১৯. ফলপ্রসু কার্যাবলীকে তোমার দু’চোখের নিশানা হিসেবে ঠিক কর এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ কর। ক্ষতিকারক কোন কর্মের প্রতি দৃষ্টি দেবে না, যাতে তুমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-কষ্ট আনয়নকারী উপায়-উপকরণসমূহ ভুলে থাকতে পার। আর আনন্দের সাথে ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রতি মনোযোগসহ সাহায্য কামনা কর।
২০. আর ফলপ্রসু কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে কর্মসমূহ সম্পাদন করা এবং ভবিষ্যতকে কর্মমুক্ত রাখা। কারণ, কর্মসমূহ যখন যথাসময়ে সম্পাদন হবে না, তখন তোমার নিকট পূর্বের কাজসমূহ অবশিষ্ট থেকে যাবে এবং তার সাথে নিয়মিত কর্মসমূহ যোগ হবে; ফলে কাজের চাপ বেড়ে যাবে। সুতরাং তুমি যখন প্রতিটি কাজ যথাসময়ে সম্পাদন করবে, তখন তুমি ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে ভালভাবে চিন্তা-গবেষণা করে কাজ করতে সক্ষম হবে।
২১. আর তোমার উচিত হবে উপকারী কর্মসমূহ থেকে গুরুত্বের আলোকে একটার পর একটা বাছাই করা এবং যে কাজে তোমার ঝুঁক ও আগ্রহ বেশি, তা নির্ণয় করা। সুতরাং তার ব্যতিক্রম হলে অস্বস্তি ও বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর এ ব্যাপারে বিশুদ্ধ চিন্তা ও সঠিক পরামর্শের মাধ্যমে সহযোগিতা নেবে। কারণ, যে ব্যক্তি পরামর্শ নিয়ে কাজ করে, সে লজ্জিত হয় না। আর যে কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, তা নিখুঁতভাবে পর্যালোচনার পর সম্পন্ন করবে। সুতরাং যখন কল্যাণকর কাজটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবে। আর আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে ভালোবাসেন।
আর সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব এক আল্লাহর জন্য নিবেদিত।
وصلى الله على سيدنا محمد و على آله و صحبه و سلم.
(আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীবৃন্দের প্রতি)।