Quantcast
Channel: QuranerAlo.com –কুরআনের আলো ইসলামিক ওয়েবসাইট
Viewing all 995 articles
Browse latest View live

বই –বদনজর, জাদু ও জিনের চিকিৎসা

$
0
0

 

লিখেছেনঃ আবু আহমাদ সাইফুদ্দীন বেলাল

প্রচ্ছদ ডিজাইনঃ শাদমান সাকিব

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ বর্তমানে বদনজর, জাদু ও জিনের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ধরণের শিরকি ঝাড়ফুকঁ ও তাবিজের ব্যবসা করছে অনেকে। আর এর দ্বারা মানুষের ঈমান ও অর্থ লুটে নিচ্ছে এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ীরা। এদের খপ্পড় থেকে বাঁচার জন্য “বদনজর, জাদু ও জিনের চিকিৎসা” বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের অলোকে আমাদের এ ছোট প্রয়াস। আশা করি এ থেকে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। ইনশাআল্লাহ্‌।

 

ডাউনলোড 

ডাউনলোড করুন Mediafire থেকে


আইন রচনা ও হালাল-হারাম নির্ধারণের অধিকার দাবি করা

$
0
0
লেখক: সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান | অনুবাদক: মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

Judge-and-Jury

বান্দার ইবাদাত, মোয়ামালাত ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে আইন ও বিধান রচনার অধিকার একমাত্র আল্লাহর - যিনি মানুষের প্রভু ও সৃষ্টি জগতের সৃষ্টিকর্তা। এছাড়া বিবাদ-বিসম্বাদ মিমাংসাকারী ও ঝগড়া-ঝাটি নিষ্পত্তিকারী আইন প্রণয়নের অধিকারও একমাত্র তাঁরই। আল্লাহ বলেন:

أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘জেনে রাখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা ও আদেশ দান করা। আল্লাহ বরকতময়, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।’ [১]

কোন আইন বান্দাদের জন্য উপযোগী। তা তিনিই জানেন। অতঃপর সে মোতাবেক আইন তিনি তাদের জন্য প্রণয়ন করেন। যেহেতু তিনি তাদের সকলের রব, তাই তিনি তাদের জন্য আইন ও যাবতীয় বিধান প্রণয়ন করেন। আর যেহেতু তারা সকলেই তাঁর বান্দা, তাই তারা তাঁর প্রণীত বিধান সমূহ মেনে নেয়। আর এ মেনে নেয়ার যাবতীয় কল্যাণ তাদের দিকেই ফিরে আসে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا 

‘আর কোন বিষয়ে যদি তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকে। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’ [২]

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন:

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبِّي 

‘তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন, উহার মীমাংসা তো আল্লারই নিকট। আর আল্লাহই হচ্ছেন আমার প্রতিপালক’ [৩]

আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কাউকে ও বিধান দাতা হিসাবে গ্রহণ করার প্রতি তিনি কঠোর অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। তিনি বলেন:

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ 

‘এদের কি এমন কতগুলো শরীক আছে, যারা তাদের জন্য ঐ ধর্মের বিধান রয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি’ [৪]

অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়ত ব্যতীত অপর কোন শরীয়ত গ্রহণ করে, সে মূলত: আল্লাহর সাথে শরীক করে থাকে। আর যে সব ইবাদাত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত নয়, তা বিদাআত। আর প্রত্যেক বেদআতই ভ্রষ্টতা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

مَنْ أحْدَثَ فِيْ أمْرِناَ هَذَا مَا لَيْسَ منه فَهُوَ رَدٌّ.

‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু আবিষ্কার করে যা তার অন্তর্গত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত’ [৫]

من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد.

‘কোন ব্যক্তি যদি এমন কাজ করে যার উপর আমাদের নির্দেশ ও বিধান নেই, তাহলে সে কাজ প্রত্যাখ্যাত।’ [৬]

রাজনীতি ও মানুষের মধ্যে বিচার-আচারের ক্ষেত্রে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অনুমোদন করেননি, তা মূলত: তাগুত ও জাহেলিয়াতের বিধান।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

‘তবে কি তারা জাহেলী যুগের বিধান কামনা করে? আর বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধানদানে আল্লাহ অপো কে শ্রেষ্ঠতর’ [৭]

অনুরূপভাবে হালাল-হারাম নির্ধারণ আল্লাহ তাআলারই হক। এতে তাঁর সাথে শরীক হওয়া কারো জন্যই বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

‘যে সব জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় না, সেগুলো থেকে ভণ করো না। তা ভণ করা অবশ্যই পাপ। নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে।’ [৮]

অত্র আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর হারাম করা কোন কিছুকে হালাল করার েেত্র শয়তানগণ ও তাদের বন্ধদের আনুগত্য পোষণ করাকে তাঁর সাথে শিরক বলে সাব্যস্ত করেছেন। অনুরূপভাবে আল্লাহর হালাল করা বস্তুকে হারাম করা কিংবা হারাম করা বস্তুকে হালাল করার েেত্র যে ব্যক্তি আলেমগণ ও শাসকবর্গ এ উভয় প্রকার লোকদের অনুসরণ করে থাকে, সে প্রকৃতপে আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকেও রব বানিয়ে নিল। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ 

‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মরিয়ম তনয় মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদাত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তারা তাঁর যে শরীক সাব্যস্ত করে, তা থেকে তিনি পবিত্র।’ [৯]

তিরমিযী শরীফ ও অন্যান্যের বর্ণনায় এসেছে - নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আয়াতটি আদি বিন হাতেম তাঈ রা. এর সামনে তেলাওয়াত করলে আদী বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো তাদের ইবাদাত করতাম না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তারা যে সব হারাম বস্তুকে হালাল প্রতিপন্ন করতো, তোমরাও কি তাকে হালাল মনে করতে না? আর যে সব হালাল বস্তুকে তারা হারাম সাব্যস্ত করতো, তোমরা কি তাকে হারাম ভাবতে না? উত্তরে আদী বললেন: জী, হ্যাঁ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন: ওটাই তাদের ইবাদাত।

সুতরাং হালাল-হারাম সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আনুগত্য করাই তাদের ইবাদাত, যা মূলত: আল্লাহর সাথে শিরকেরই নামান্তর। আর এটা হচ্ছে বড় শিরক যা পুরোপুরি তাওহীদের পরিপন্থী। কেননা তাওহীদের অর্থ হল - আল্লাহ ছাড়া হক কোন ইলাহ নেই - এ সাক্ষ্য দেয়া। আর এ সাক্ষ্য দেয়ার অর্থই হল হালাল-হারাম নির্ধারণের অধিকার শুধু আল্লাহ তাআলার এ কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করা।
এ অবস্থা যদি সেই লোকদের হয়, যারা আল্লাহর শরীয়তের খেলাপ হালাল- হারাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে উলামা ও আবেদ লোকদের আনুগত্য করে - অথচ এ সকল আলেমগণ অন্যদের চেয়ে দ্বীন ও এলেমের অধিক নিকটবর্তী, পরন্তু তাদের ভুল কখনো ইজতেহাদ ও গবেষণা প্রসূত হতে পারে, যাতে হক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলে ও পুণ্যবান বলে গণ্য হবে। তাহলে সে সব লোকদের কি অবস্থা হবে, যারা কাফির ও নাস্তিকদের রচিত আইন-কানুনের অনুসরণ করে, মুসলিম দেশসমূহে তা আমদানী করে এবং তদনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে শাসনকার্য পরিচালনা করে। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। এরা মূলত: আল্লাহর বদলে কাফিদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে, যারা তাদের জন্য আইন ও বিধান রচনা করে এবং তাদের জন্য হারামকে বৈধ করে মানুষের মধ্যে সে অনুযায়ী শাসন কার্য পরিচালনা করে।

 

সমাপ্ত

 

[১] সূরা আরাফ,৫৪
[২]সুলা নিসা, ৫৯
[৩] সূরা শুরা, ১০
[৪] সুরা শুরা ২১
[৫] বুখারী, মুসলিম
[৬] মুসলিম
[৭] সূরা মায়েদা, ৫০
[৮] সূরা আনআম, ১২১
[৯] সূরা তাওবা, ৩১
[১০] তিরমিযী, ইবনে মাজা, ও আরো অনেকে হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন।
[১১] ফাতহুল মাজীদ,১০৭

উৎস : ইসলাম হাউজ

নারীকে আবেদনময়ী দেখালেই পুরুষ ধর্ষণ করবে?

$
0
0

17656628দিল্লিতে গত ডিসেম্বরে চলন্ত বাসে মেডিকেলের এক শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণ। গত সপ্তাহে মধ্যপ্রদেশে এক সুইস নারীকে গণধর্ষণ। একই সপ্তাহে আগ্রায় হোটেলের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে এক ব্রিটিশ নারীর ধর্ষণ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা। সম্প্রতি ভারতে সংঘটিত আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডের অন্যতম এগুলো।

সরকারি হিসাব মতে, ভারতে প্রতি ২১ মিনিটে একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের ব্যাপারে ভারতীয় পুরুষেরা কী ভাবেন? এ প্রশ্নটি মাথায় রেখে ভারতের গোয়া রাজ্যের কয়েকজন ব্যক্তির মতামত জানতে চেয়েছিল ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ‘অবজারভার’। মতামত দেওয়া ব্যক্তিদের প্রায় সবার বক্তব্য ছিল, মেয়েদের আবেদনময়ী দেখালে ছেলেরা ধর্ষণ করবে—এটাই স্বাভাবিক।

‘ধর্ষণ একটা সমস্যা। এটা নারীদের দিক থেকেই শুরু হয়। ওরাই পুরুষদের উত্তেজিত করে তোলে।’ বলছিলেন ৩২ বছর বয়সী এক পানশালার মালিক পাপি গঞ্জালেস। মাথা নেড়ে তাঁর কথায় সম্মতি দিলেন পানশালার কর্মী রবিন শ্রীঠা। ২১ বছর বয়সী এ তরুণের বক্তব্য, ‘মেয়েদের আবেদনময়ী দেখালে ছেলেরা নিজেদের আর ধরে রাখতে পারে না।’

২৮ বছর বয়সী অভিজিত্ হারমালকার পেশায় গাড়িচালক। ধর্ষণের ব্যাপারে তাঁর মতামত, ‘ধর্ষণের জন্য শুধু পুরুষকে দোষারোপ করা হচ্ছে। অথচ তরুণীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কেউ কথা বলছে না। আমাদের এটা বোঝা উচিত যে, রাতের বেলায় মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া উচিত নয়। আমাদের সংস্কৃতি ভিন্ন।’

হারমালকারের ছোট ভাই অবিনাশের (২৪) ভাষ্য, মা-বাবার উচিত বেশি রাতে মেয়েদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করা। তাহলে এ ধরনের অপরাধ ঘটবে না। ২৬ বছর বয়সী ভিভরেশ বানাওলিকার একটি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমার এক বোন আছে। ও যদি রাতে বাইরে যায়, আমি চিন্তায় পড়ে যাই। সাতটা পেরিয়ে গেলে আমি দুশ্চিন্তায় পড়ি। পুরুষেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও বিশ্বাস করেন, ধর্ষণের দায় শুধুই পুরুষের নয়। চলন্ত বাসে মেডিকেলছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হওয়ার পর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল অনেকে। এ অবস্থার মধ্যেও মেয়েদের সাজগোজ ও পোশাক নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ছেলে এবং পার্লামেন্ট সদস্য অভিজিত্ মুখার্জি। ভারতের ধর্মীয় গুরু আসারাম বাপু বলেছিলেন, ‘ধর্ষণের শিকার নারী নির্দোষ ছিল না। এক হাতে কখনো তালি বাজে?’

গঞ্জালেস বলেন, ‘নারীদের ওপরে যৌন নিপীড়ন ঠেকানোর একটি উপায় হতে পারে মা-বাবার কড়া শাসন, রাতে বাড়ির বাইরে যেতে না দেওয়া। এটা অনেক দিন ধরে প্রচলিত একটি উপায়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে, আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছিল পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে। এ জন্য আমরা মা-বাবাকে সম্মান করতাম। তাঁরা আমাদের যা বলতেন, আমরা তাই করতাম। মা-বাবা চিৎকার করে বলতেন, “এটা কর, ওটা কর”, আমরা করতাম। কিন্তু এখনকার প্রজন্মে ওসব বদলে গেছে।’

হারমালকার বলেন, যে পুরুষেরা বাসে নারীদের ওপরে নিপীড়ন করে, তারা একা থাকে না। তাদের বাঁচানোর জন্য আরও অনেকে থাকে বলেই তারা এমনটা করার সাহস পায়। আবার এমনও হয়, তারা যে ভুল করছে, এটা তারা বোঝে না।

যাঁদের মত নেওয়া হচ্ছিল, তাঁরা কেউ সমাধানের ব্যাপারে একমত হতে পারছিলেন না। বানাওলিকার বলেন, ধর্ষণ বন্ধের একমাত্র উপায় হলো ছেলেদের কাজে ব্যস্ত রাখা এবং পথ থেকে সরিয়ে নেওয়া। তিনি বলেন, ‘আমি যে কাজ করি, তাতে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। ওসব করার সময় আমার নেই। যদি আপনি তাদের (ছেলেদের) ব্যস্ত রাখেন, তবে তাদের সামলাতে পারবেন। বেকার ছেলেরাই ওসব কাজ করে।’

বানাওলিকার বলেন, ‘যদি তারা (ছেলেরা) কাউকে কিছু করতে দেখে, তাহলে নিজেরাও সেটি করতে চায়। মেয়েদের বেলায়ও এমনটি ঘটে। দিনের বেলা সে সুবোধ বালিকা, কিন্তু রাত হলেই সে বুঝে যায় কী করতে হবে। এ জন্য সে তার বন্ধুদের পটায়।’

সবার মত হলো, মা-বাবা ও স্কুলের উচিত ঠিক-বেঠিক শিক্ষা দেওয়া।

ভারতে যাঁরা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য এ আলোচনাটি আশঙ্কাজনক ও ভীতিকর। গত সপ্তাহে দেশটির লোকসভায় ধর্ষণবিরোধী আইন পাস হয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নারীদের হয়রানি বা উত্ত্যক্ত করার জন্যও কড়া শাসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ওই আইনে। তবে গোয়ার সমুদ্রতীরে কিছু ব্যক্তির সঙ্গে অবজারভারের আলাপে এতটুকু বোঝা গেছে, যাঁরা যৌন নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে প্রচার চালাচ্ছেন, তাঁদের জন্য খুব বেশি আশা নেই। অবিনাশ বলেন, ‘কিচ্ছু বদলাবে না। প্রতিদিন এসব হচ্ছে। তবু কিছু হবে না। দুনিয়াটা ধ্বংস হলে যদি কিছু হয়!’

এইটা ছিল অমুসলিম দের সমাধান।(১) 

আসুন এবার দেখী ইসলাম ধর্মে ধর্ষণ বা নারীর উপর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কি কি পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেঃ 

ধর্ষণের বা নারীর প্রতি নিপীড়নের কারন

১। পুরুষের অতিরিক্ত লালসা/ মাত্রাতিরিক্ত যৌন আকাংখাঃ

ধর্ষণের জন্য পুরুষের অতিরিক্ত লালসা/ মাত্রাতিরিক্ত যৌন আকাংখাই দায়ী এটা মানতেই হবে। কিন্তু এটা বর্তমানে ভারতে, বাংলাদেশে এতো বেড়ে গেল কেন। সামাজিক বিশ্লেষণ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এটাই প্রমাণিত হবে যে কথিত পশ্চিমা আধুনিক বস্তুবাদী জড়বাদী ভোগবাদী কালচারই তার পুঁজিবাদী স্বার্থে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীকে পণ্য হিসেবে এবং ভোগের উপচার হিসেবে তুলে ধরে অসংশোধিত পুরুষের যৌন লালসাকে uncontrolled কিরে তাকে নরপশুতে পরিনত করেছে। পুরুষের এই অবাধ কামনা দূর করতে হবে এই কালচারের অপনোদন আগে দরকার। আমাদের দেশের নরপশুদের ধর্ষকামী মানসিকতা আগের চেয়ে বাড়ার কারন এই ভোগবাদী পুঁজিবাদী সংস্কৃতির বিস্তার বেড়ে গেছে। বলিউড কালচার আর হলিউড কালচার , পুঁজিবাদী ভোগবাদী কালচার যেভাবে নারীকে ভোগের উপচার হিসেবে তুলে ধরে তাতে অনেক বখাটে লোকের মাঝে ধর্ষকামী মানসিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটাকে আড়াল করে সমস্যার সমাধান হবে না। আপনি নারীকে সমাজে, সাহিত্তে, বিজ্ঞাপনে, নাটকে, সিনেমায় ভোগের পণ্য হিসেবে তুলে ধরবেন আর বলবেন ধর্ষণ প্রতিরধের কথা তা হবে না।

২। শাস্তি না হওয়াঃ ধর্ষণের শাস্তি না হওয়া এর হার বৃদ্ধি করে এটা সবাই জানে। আর বাংলাদেশের কথা বলতেই লজ্জা পাচ্ছি। এই বাংলাদেশেই জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা যেখানে মৃত্যু দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কথা সেখানে এই দেশের শাসকগোষ্ঠী তাকে উল্টা সরকারী চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করল।

এবার আসুন দেখা যাক ইসলাম ধর্ষণ বা নারীর উপর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কি কি পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছে

ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে নারী ধর্ষণ ও উৎপীড়ন। সাথে সাথে কার্যকর করতে বলেছে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় উভয়ের কঠোরভাবে পালনীয় হিজাব বা পর্দা এবং সাব্যস্ত ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

১. ধর্ষণ ও উৎপীড়নের শেকড় শুদ্ধ নির্মূল করার পরামর্শঃ 

বড় বড় সকল ধর্ম নারী ধর্ষণ ও উৎপীড়ন জঘন্য অপরাধবলে ঘোষণা করে। ইসলামের শিক্ষাও তাই। তাহলে কি পার্থক্য ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের? পার্থক্যের বিষয়টা হলে ইসলাম শুধুমাত্র নারী মর্যাদার ওয়াজই করেনা বা ধর্ষণ ও উৎপীড়ণকে ঘৃনার সাথে জঘন্য অপরাধ হিসেবে পরিত্যাগ করতেই বলে না। সাথে সাথে সুস্পস্ট নির্দেশনাও দেয় কিভাবে সমাজ থেকে এই অপরাধ সম্পূর্ন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

ধর্ষকামী মানসিকতা আসে অতিরিক্ত যৌন লালসা থেকে, আবার তা আসে নারীকে শুধুই ভোগ্যপণ্য মনে করলে। নারীকে মানবিক ভাবে না দেখে কেবলি লালসা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ভাবলেই যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত হতে পারে। এজন্য নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আগে ঠিক করতে হবে।এজন্য ইসলামে মানুষকে সর্বপ্রকার লালসা, লোভ, পরিহার করে সংযমের শিক্ষা দেয়া হয়, কোরআনে বলা হয়েছে, “ওই ব্যক্তিই সফল যে নিজেকে সংশোধিত করতে পেরেছে” ইসলাম একজন মানুষকে(নারী বা পুরুষ) সব রকমের দুনিয়ার মাত্রাতিরত আকর্ষণ (তা অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতার লোভ, অবাধ ভোগবাদ) থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। তাই প্রাথমিকভাবেই ইসলামি শিক্ষায় বা নৈতিকতায় গড়ে একজন নারী/পুরুষ আত্মিক ভাবেই সংশোধিত মানব। তার পক্ষে এসব নারী নিপীড়নে জড়িয়ে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

২.পুরুষের পর্দাঃ 

হিজাব বা পর্দা ইসলামের একটি বিধান। জ্যোতির্ময় কুরআন প্রথম উল্লেখ করেছে পুরুষের পর্দা। তারপরে তা নারীর জন্য।

(হে রাসূল!) মোমেন পুরুষদের বলোঃ তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে চলে। এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহ হেফাজত তরে। এটা তাদের আরো পবিত্র হয়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। (তাদের চরিত্র নির্মাণের জন্য) যা কিছুই তারা করে অবশ্য অবশ্যই আল্লাহ সে সব কিছু সম্পর্কেই খবর রাখবেন। (সূরা নূরঃ ৩০)

যে মুহুর্তে একটি পুরুষ একজন নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলো যদি কোনো ধরনের অশ্লিল চিন্তা মাথায় এসে যায় এই ভয়ে সাথে সাথে তার দৃষ্টি নামিয়ে নেবে।

৩. নারীর পর্দাঃ 

কুরআন নারীর পর্দা সম্পর্কে এভাবে বরেছেঃ আর (হে নবী) মোমেন স্ত্রীলোকদের বলুন! তারা যেন নিজেদের চোখ অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের যথাযথ সংরক্ষণ করে। আর যেন প্রদর্শনী না করে তাদের রুপ-সৌন্দর্য ও অলংকারের। তবে এ সবের মধ্যে যা অনিবার্যভাবে প্রকাশ পেয়ে যায়। আর তারা যেন ঝুলিয়ে দেয় তাদের ওড়না তাদের বুকের ওপর। আর তারা প্রকাশ করবে না তাদের রুপ-সৌন্দর্য তাদের স্বামী অথবা তাদের পিতা অথবা তাদের স্বামীদের পিতা (শ্বশুর) অথবা তাদের পুত্র।(সূরা নূরঃ৩১)

বিস্তারিত জানতে এই বইটি পড়ুন -  পর্দা একটি ইবাদাত 

হিজাব উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করে

নারীকে কেন আল্লাহ হিজাব ধারণ করতে বরেছেন কুরআনে তা এভাবে বলা হয়েছে

হে নবী! আপনার স্ত্রীগণ ও কন্যাগণ এবং ঈমান গ্রহণকারী নারীদেরকে বলে দিন তারা যেন ঝুলিয়ে দেয়া তাদের নিজেদের ওপর তাদের বড় চাগর জাতীয় কিছু (যখন বাইরে যাবে)। এটা তাদের পরিচিতির জন্য ন্যুনতম (পোষাক) তাহলে তারা আর উৎপীড়িত হবে না। আর আল্লাহ তো আছেনই ক্ষমা দানকারী দয়াময়। (সূরা আহযাবঃ ৫৯)

কুরআন বলে, নারীকে এই কারণে হিজাব পড়তে বলা হয়েছে যেন তারা রুচিশিলা মহিলা হিসাবে পরিচিত হয়। এটা তাদেরকে উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করবে।

৪. ধর্ষকের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মৃত্যুদন্ড

ইসলাম নরপশুদের সতর্ক করে দিয়েছে যে তারা যদি ধর্ষণ করে তাহলে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। ধর্ষণের জন্য এই কঠোর শাস্তির বিধান হচ্ছে ইসলামের চতুর্থ রক্ষাকবচ। ইসলামের বিধান অনুযায়ী একজন পুরুষ যদি কোনো নারী ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে তার শাস্তি প্রকাশ্য মৃত্যুদন্ড। (২) 

উৎসঃ

১) প্রথম আলো ২৫-০৩-১৩

২) এক ভাইয়ের ব্লগ থেকে 

ইন্টারনেটে ইসলাম বিরোধী লেখা/মন্তব্য অভিযোগের জন্যে ই-মেইল

$
0
0

284696-security-troubleshooting-techniques (1)বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের ফেইসবুক ও ব্লগে ইসলাম বিরোধী লেখা/মন্তব্য বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে ই-মেইল ঠিকানা খুলেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি।

রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে এ সংক্রান্ত কমিটির এক বৈঠকে এই ই-মেইল ঠিকানা (complainmoha@gmail.com) জানানো হয়।

এ ই-মেইল ঠিকানায় যে কেউ এ অভিযোগ পাঠাতে পারবেন।

রোববার সকাল ১১টায় ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে এ কমিটি। ফেইসবুক ও ব্লগে আপত্তিকর মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপায় নির্ধারণ করতে এ সভা আয়োজন করা হয়েছে।

ফেইসবুক ও ব্লগে ইসলাম ও হযরত মুহম্মদ (সা.) কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যকারীদের সনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ১৩ মার্চ নয় সদস্যের কমিটি করে সরকার। কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), আইন ও বিচার বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক এবং পুলিশের (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) অতিরিক্ত ডিআইজিকে রাখা হয়েছে।

কমিটির সদস্য আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব আবু আহমেদ জমাদার বলেন, “প্রচলিত আইন অনুযায়ী দোষী প্রমাণিত হলে আপত্তিকর মন্তব্যকারীদের এক কোটি টাকা জরিমানা এবং ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।” প্রয়োজনে আপত্তিকর মন্তব্যকারী ব্লগার ও ফেইজবুক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে সরকার সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনেও বিচার করতে পারে বলে জানান আবু আহমেদ জমাদার।

আসুন সবাই একসাথে আমরা নাস্তিক ব্লগারদের মুখোশ উন্মোচন করি। শেয়ার করে জানিয়ে দিন সবাইকে। 

এপ্রিলের মিথ্যাচার

$
0
0

লেখক :  মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ | অনুবাদক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ

 

মিথ্যা একটি চারিত্রিক ব্যাধি। যার মধ্যে মনুষ্য রুচিবোধ কিংবা সুস্থ প্রকৃতি বিদ্যমান সে কোনক্রমেই এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করতে পারে না। আর না করাই হচ্ছে স্বাভাবিক মনুষ্য ধর্ম। সকল ধর্মেই এর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে।

‘পক্ষান্তরে সত্য পৃথিবীর স্থায়িত্বের একটি মূল ভিত্তি। প্রশংসাযোগ্য বস্তু, নবুওয়তের অংশ ও তাকওয়ার ফল। এ সত্য না থাকলে শরিয়তের বিধানসমূহ অকেজো হয়ে যেত।  মূলত মিথ্যা বলার দোষে দুষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে মানবতা থেকে বেরিয়ে যাওয়া। কারণ, কথা বলা মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য আর কথা সত্য না হলে তার কোন অর্থই থাকে না।’ (মুহাম্মদ আল-খাদেমি: বারীকাতুন মাহমূদিয়া, ৩/১৮৩)

আমাদের পবিত্র দীনে ইসলামে এর সামান্যতম আশ্রয়-প্রশ্রয় নেই। কুরআন, হাদিস এবং উম্মতের ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত যে এটা হারাম, এটা নিষিদ্ধ ও গর্হিত। যে মিথ্যা বলে তার পরিণাম দুনিয়া ও আখেরাতে খুবই নিন্দনীয়।

নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতীত মিথ্যা বলার কোন অবকাশ নেই। এ মিথ্যার মাধ্যমে কারো অধিকার হরণ করা যাবে না, কাউকে হত্যা করা যাবে না এবং কারো ইজ্জত সম্মানে আঘাত হানা যাবে না। বরং কাউকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কিংবা দু’জনের মধ্যে ছিন্ন সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করার জন্য অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিল-মহব্বত তৈরি করার জন্য এ মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে, অন্যথায় নয়।

ইসলাম ধর্মে এমন একটি মুহূর্ত কিংবা দিন-ক্ষণ নেই যার মধ্যে মিথ্যা বলা বৈধ বা মানুষ যা চায় তা বলার জন্য সে স্বাধীন। পক্ষান্তরে কতক সমাজে প্রচলিত রেওয়াজ যেমন পহেলা এপ্রিল বা এপ্রিল ফুল নামে যে কুসংস্কার চলে আসছে যে, তাতে মিথ্যা বলা বা কাউকে ধোঁকা দেয়া সম্পূর্ণ বৈধ, তার কোন ভিত্তি ইসলাম ধর্মেই নেই। বরং মিথ্যা সবসময়ই মিথ্যা এবং সবসময় তা হারাম।

মিথ্যার ক্ষতিসমূহ :

মিথ্যা বলা হারাম :

১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘মিথ্যা তো তারাই বানায় যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ওপর ঈমান রাখে না। বস্তুত তারাই মিথ্যুক।’ (সূরা নাহাল : ১০৫)

ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, রাসূল সা. মিথ্যা তৈরি করেন না এবং মিথ্যা বলেনও না। কারণ, আল্লাহ এবং তার রাসূলের নামে যারা মিথ্যা রটায় তারা নিকৃষ্ট মাখলুক। তারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ওপর বিশ্বাস রাখে না, তারা কাফের, তারা নাস্তিক; তারা মানুষের নিকট মিথ্যুক হিসেবে পরিচিত। পক্ষান্তরে রাসূল সা. মানুষের মাঝে সব চেয়ে সত্যবাদী হিসেবে, সব চেয়ে সৎকর্মশীল হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কওমের সবাই তাকে বিশ্বস্ত মু‏হাম্মদ বা আল-আমীন মুহাম্মদ বলে ডাকত।’ (ইবনে কাসির : ২/৫৮৮)

২. আবুহুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,

‘মুনাফেকদের নিদর্শন তিনটি : কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, ওয়াদা করে ভঙ্গ করা এবং আমানতের মধ্যে খেয়ানত করা।’ (বুখারি : ৩৩, মুসলিম : ৫৯)

ইমাম নববি রহ. বলেন, অধিকাংশ আলেমে রায় হচ্ছে এগুলো মুনাফেকির আলামত ও স্বভাব। যার মধ্যে এগুলো থাকবে সে এসব স্বভাবে মুনাফেকদের ন্যায় ও তাদের আচরণ গ্রহণকারী।

  • আর সব চেয়ে বড় মিথ্যা :

সব চেয়ে বড় মিথ্যা হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল সা. এর ওপর আরোপ করা। এর শাস্তি ভয়াবহ, কেউ কেউ এ জাতীয় মিথ্যুককে কাফের পর্যন্ত বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।’ (নাহাল : ১১৬)

আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,

‘তোমরা আমার ওপর মিথ্যা বলবে না, যে আমার ওপর মিথ্যা বলবে, সে যেন আগুনে প্রবেশ করে।’ (বুখারি : ১০৬)

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,

‘যে আমার ওপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।’ (বুখারি : ১১০, মুসলিম : ৩)

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন,

‘এর অর্থ হচ্ছে যে রাসূল সা. এর ওপর মিথ্যা বলবে সে যেন নিজ স্থায়ী ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।’ (তারিকুল হিজরাতাইন : ১৬৯)

বেচাকেনায় মিথ্যা বলা :

সাহাবি আবু যর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,

‘কেয়ামতের দিন তিন জন ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না এবং সংশোধন করবেন না, আরও তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আবু যর বলেন, রাসূল সা. একথাগুলো তিনবার বললেন। আবু যর বলেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা ধ্বংস প্রাপ্ত, তাদের পরিচয় কি হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী ব্যক্তি ও মিথ্যা কসমের মাধ্যমে বিক্রয়কারী ব্যক্তি।’ (মুসলিম : ১০৬)

হাকিম ইবন হিযাম থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,

‘ক্রেতা ও বিক্রেতা ইচ্ছাধীন যতক্ষণ না তারা পৃথক হয়। যদি তারা সত্য বলে ও দোষ-গুণ বর্ণনা করে দেয়, তবে তাদের মধ্যে বরকত প্রদান করা হয়। আর যদি তারা গোপন রাখে ও মিথ্যা বলে তবে তাদের বরকত নষ্ট করে দেয়া হয়।’ (বুখারি : ১৯৭৩, মুসলিম : ৫৩২)

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘আল্লাহ সত্য ও স্পষ্ট করে বলার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং মিথ্যা ও গোপন করার জন্য নিষেধ করেছেন, যেসব ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন হয়, সেসব ব্যাপারে। যেমন রাসূল সা. বলেছেন,

‘ক্রেতা ও বিক্রেতা ইচ্ছাধীন যতক্ষণ না তারা পৃথক হয়। যদি তারা সত্য বলে ও দোষ-গুণ বর্ণনা করে দেয়, তবে তাদের মধ্যে বরকত প্রদান করা হয়। আর যদি তারা গোপন রাখে ও মিথ্যা বলে তবে তাদের বরকত নষ্ট করে দেয়া হয়।’

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোন কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর।’ (মায়েদা : ৮)

(মিনহাজুস সুন্নাহ : ১/৬১)

স্বপ্নের ব্যাপারে মিথ্যা বলা হারাম :

কেউ কেউ স্বপ্নে কিছু না দেখেও বলে যে, আমি স্বপ্নে এমন এমন দেখেছি, অতঃপর মানুষের কাছে তা বলে বেড়ায়। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,

‘যে ব্যক্তি স্বপ্ন না দেখেও স্বপ্ন দেখার ভান করবে, তাকে দু’টি গমের মাঝে গিরা দিতে বলা হবে, অথচ তা সে করতে সক্ষম  হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কথা কান পেতে শুনল, অথচ তারা তাকে তা শোনাতে চায় নি, তার কানে কেয়ামতের দিন শিশা ঢালা হবে, যে ব্যক্তি ছবি অঙ্কন করবে কেয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেয়া হবে  এবং তাকে বলা হবে তাতে রুহ সঞ্চার করতে, অথচ তা করতে সে সক্ষম হবে না।’ (বুখারি : ৬৬৩৫)

মুনাবি রহ. বলেন, ‘দু’টি গমের মাঝে তাকে গিরা দিতে বলা হবে’ এর অর্থ হচ্ছে তাকে সর্বদা শাস্তি দেয়া হবে। জাগ্রত অবস্থার চেয়ে ঘুমন্ত অবস্থার মিথ্যা ব্যাপারে কেন এ কঠিন শাস্তি ? অথচ জাগ্রত অবস্থায় মিথ্যা বলে কাউকে তো হত্যা পর্যন্ত করা যায়। এর উত্তর হচ্ছে, ঘুমন্ত অবস্থায় মিথ্যা বলার অর্থ হল আল্লাহর ওপর মিথ্যা বলা। কারণ, স্বপ্ন নবুয়তের একটি অংশ, তাই নবুওয়তের অংশও আল্লাহর পক্ষ থেকেই। সবার নিকট বিদিত যে, মানুষের ওপর মিথ্যা বলার চেয়ে আল্লাহর ওপর মিথ্যা বলার শাস্তি ভয়াবহ ও কঠিন।’ (ফায়জুল কাদির : ৬/৯৯)

সব শোনা কথা বলাও হারাম :

হাফস ইবন আসেম থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেনে,

‘ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বলবে।’ (মুসলিম : ৫)

ইমাম নববি রহ. বলেন, ‘এ সব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যা যা শোনা যায় তার সব কিছু বলা নিষেধ। কারণ, প্রতিনিয়ত সত্য-মিথ্যা অনেক কিছুই শোনা যায়, অতএব যে ব্যক্তি সব কিছু বলে বেড়াবে তার দ্বারা মিথ্যা প্রচারিত হওয়াই স্বাভাবিক, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে না। আর এটাই হচ্ছে মিথ্যা, মিথ্যার জন্য ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দখল নেই। হ্যাঁ, গোনাহগার হওয়ার ইচ্ছা শর্ত।আল্লাই ভাল জানেন।’ (মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থ : ১/৭৫)

সব চেয়ে ঘৃণিত হচ্ছে হাসিতামাশাচ্ছলে মিথ্যা বলা :

অনেকে ধারণা করে যে হাসি-রসিকতায় মিথ্যা বলা বৈধ। আর এ থেকেই বিশ্ব ধোঁকা দিবস বা এপ্রিল ফুলের জন্ম। এটা ভুল ধারণা, এর কোন ভিত্তি নেই ইসলাম ধর্মে। রসিকতা কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় মিথ্যা সর্বাবস্থায় হারাম।

ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,

‘আমি রসিকতা করি ঠিক, তবে সত্য ব্যতীত কখনো মিথ্যা বলি না।’ (তাবরানি ফিল মুজামুল কাবির : ১২/৩৯১, সহিহ আল-জামে : হাদিস নং ২৪৯৪)

আবুহুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম একদা বলল,

হে আল্লাহ রাসূল, আপনি তো আমাদের সঙ্গে রসিকতা করেন। তিনি বললেন, ‘আমি সত্য ভিন্ন কিছু বলি না।’ (তিরমিজি : ১৯৯০)

আব্দুর রহমান ইবনে আবি লায়লা রহ. বলেন, রাসূল সা. এর সাহাবিগণ বলেছেন যে, তারা রাসূল সা. সঙ্গে কোন সফরে ছিল, তাদের একজন ঘুমিয়ে পড়লে অপর কেউ তার তীর নিয়ে নেয়, লোকটি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ভীত হয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে সবাই হেসে দিল। রাসূল সা. বললেন, তোমরা হাসলে কেন? তারা বলল, কিছু হয়নি। তবে আমি তার তীরটি নিয়েছিলাম আর এতেই সে ঘাবড়ে গেছে। রাসূল সা. বললেন,

‘কোন মুসলিমের জন্য অন্য কোন মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।’ (আবুদাউদ : ৫০০৪, আহমদ : ২২৫৫৫, অনুবাদ আহমদ থেকে, সহিহ আল-জামে : ৭৬৫৮)

অপর এক হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন,

‘তোমাদের কেউ কারো আসবাব পত্র ইচ্ছায় বা রসিকতায় ধরবে না, কেউ কারোটা ধরে থাকলে তার উচিত তাকে তা ফেরৎ দেয়া।’ (আবুদাউদ : ৫০০৩, তিরমিজি : ২১৬০, সহিহ আল-জামে : ৭৫৭৮, হাদিসটি হাসান)

বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলাচ্ছলে মিথ্যা বলা :

বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলাতেও মিথ্যা থেকে বিরত থাকা জরুরি। কারণ, এটা বাচ্চাদের অন্তরে গেঁথে যায়। রাসূল সা. এর থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

আমাকে আমার আম্মা একদিন ডাকলেন, তখন রাসূল সা. আমাদের ঘরে বসা ছিলেন, আম্মা বললেন, তুমি আস, আমি তোমাকে দেব। রাসূল সা.  বললেন, তুমি তাকে কি দেয়ার ইচ্ছা করেছ? তিনি বললেন, আমি তাকে খেজুর দেব। রাসূল সা. তাকে বললেন, হ্যাঁ, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে তবে তার সঙ্গে তোমার এটা মিথ্যা বলা হত।’ আবু হুরায়রা রা. বলেন, যে ব্যক্তি কোন বাচ্চাকে বলল, আস আমি তোমাকে দেব, অতঃপর সে যদি না দেয়, তবে তার এটা মিথ্যা কথা হবে। (আবুদাউদ : ৪৯৯১, হাদিসটি সহিহ আল-জামেতে হাসান বলা হয়েছে, হাদিস নং ১৩১৯)

লোক হাসানোর জন্য মিথ্যা বলা :

মুয়াবিয়া ইবন হাইদা বলেন, আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি,

‘ধ্বংস তার জন্য যে, লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং তাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য।’ (তিরমিজি : ২৩৫, তিনি বলেছেন, হাদিসটি হাসান, আবুদাউদ : ৪৯৯০)

মিথ্যার পরিণাম :

মিথ্যা বলার পরিণাম খুবই ধ্বংসাত্মক। এর জন্য দুনিয়াতে রয়েছে ধ্বংস আর আখেরাত রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা। নিম্নে কয়েকটি তুলে ধরা হল :

ক. মিথ্যার কারণে অন্তরে কপটতার সৃষ্টি হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘সুতরাং পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে নিফাক রেখে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা তার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে।’ (তওবা : ৭৭)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন,

‘মুনাফিকদের পরিচয় তিনটি : যখন কথা বলবে মিথ্যা বলবে, আর ওয়াদা করে ভঙ্গ করবে ও আমানত রাখলে খেয়ানত করবে। অতঃপর তিনি দলিল স্বরূপ সুরা তওবার ৭৫-৭৭ পর্যন্ত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা : ৬/১২৫)

খ. মিথ্যা পাপাচার ও জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন,

‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ। আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, একসময় আল্লাহর নিকট সে সিদ্দিক হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে, আল্লাহর নিকট একসময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয়। (বুখারি : ৫৭৪৩, মুসলিম : ২৬০৭)

সানআনি বলেন, ‘হাদিসে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, বান্দা সত্য বললে সত্যবাদিতা তার একটি আলামত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে বান্দা মিথ্যা বললে মিথ্যা বলা তার অভ্যাস ও আলামতে পরিণত হয়। সত্যবাদিতা ব্যক্তিকে জান্নাতে নিয়ে যায় আর মিথ্যা ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অধিকন্তু সত্যবাদীর কথার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে ও তা মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায় আর মিথ্যুকদের কথার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকে না এবং মানুষের নিকট তা গ্রহণযোগ্যতাও পায় না।’ (সুবুলুস্‌সালাম : ২/৬৮৭)

গ. মিথ্যুকদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না।

ইবনুল কাইয়ূম রহ. বলেন,

যেসব কারণে ফতোয়া, সাক্ষ্য ও  বর্ণনা পরিত্যাগ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিথ্যা। মিথ্যা মানুষের মুখের কার্যকারিতাই নষ্ট করে দেয়। যেমনিভাবে অন্ধ ব্যক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং বধির ব্যক্তির শোনার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মুখ একটি অঙ্গের ন্যায় যখন তা মিথ্যা বলা আরম্ভ করবে তখন তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। বরং মানুষের ক্ষতির মূল কারণই হচ্ছে মিথ্যা জবান।’ (আলামুল মুয়াক্কিঈন : ১/৯৫)

ঘ. মিথ্যার কারণে দুনিয়া আখেরাত উভয় জাগতেই চেহারা বিবর্ণ ও মলিন হয়ে যায়

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কিয়ামতের দিন তুমি তাদের চেহারাগুলো কালো দেখতে পাবে।’ (জুমার : ৬০)

আল্লাহ এবং তার রাসূলের ওপর মিথ্যা বলার শাস্তি হচ্ছে চেহারা কালো হয়ে যাওয়া।

ঙ. হাদিস দ্বারা প্রমাণিত মিথ্যুকের চোয়াল চিরে গর্দান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।

সামুরা ইবন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই বলতেন,

“তোমাদের কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছে?” তখন আল্লাহ যা মঞ্জুর করেন, তা কেউ কেউ বর্ণনা করতেন। একদিন প্রত্যুষে তিনি বললেন, আমার কাছে রাতে (স্বপ্নে) দু জন আগন্তুক এসেছিল। তারা আমাকে উঠালো এবং বলল, আমাদের সাথে চলুন। আমরা গেলাম, তখন এমন এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম, যে তার পিঠের উপরে শুয়ে ছিল আর অন্য একজন লোহার কাঁচি নিয়ে তার উপরে দণ্ডায়মান ছিল। সে তার চেহারার এক পার্শ্বে এসে তার চোয়াল চিরে গর্দান পর্যন্ত, তার নাসিকা চিরে গর্দান পর্যন্ত এবং তার চক্ষু চিরে গর্দান পর্যন্ত কেটে নিয়ে যাচ্ছিল। …. অতঃপর অপর চেহারার অপর পার্শ্বে গিয়ে এ পার্শ্বে যা করেছিল তাই করল। এক পার্শ্ব শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আবার তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেত। ফলে সে অপর পার্শ্বে গিয়ে পুনরায় একই কাজ করত।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ!! এই দু জন কারা? তারা আমাকে বলল, সামনে এগিয়ে যান, সামনে এগিয়ে যান।” (অতঃপর ফেরেশতা দু জন তিনি যা দেখেছেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলল:) “আপনি যে লোককে দেখেছেন তার চোয়াল গর্দান পর্যন্ত, তার নাসিকা চিরে গর্দান পর্যন্ত এবং তার চক্ষু গর্দান পর্যন্ত চিরে নেওয়া হচ্ছিল, সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে তার ঘর থেকে সকালে বের হয়ে এমন এক মিথ্যা কথা বলে, যা দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে।” (বুখারি : ৫৭৪৫)

মিথ্যা সম্পর্কে মনীষীদের উক্তি:

আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

‘কোনো মানুষ সত্য বলবে এবং সত্য বলার প্রচেষ্টায় থাকবে, অবশেষে তার অন্তরে সুঁই পরিমাণ স্থান থাকবে না মিথ্যার জন্য। আবার, কোনো মানুষ মিথ্যা বলবে এবং মিথ্যা বলতে চেষ্টা করবে, অবশেষে তার অন্তরে সুঁই পরিমাণ স্থানও অবশিষ্ট থাকবে না সত্যের জন্য।’

আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন:

‘রসিকতা কিংবা একান্তভাবে— কখনোই মিথ্যা বলবে না।’

অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন:

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্‌র তাক্ওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” [সূরা আত-তাওবা: ১১৯]

আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

‘তোমরা মিথ্যা থেকে সাবধান থাক! কেননা, মিথ্যা ঈমানের পরিপন্থী।’

সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

‘একজন মুমিন ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যা ও বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত সকল চরিত্রই থাকতে পারে।’

উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

‘কখনওই সত্যিকারের ঈমানে পৌঁছতে পারবে না, যতক্ষণ না ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা ত্যাগ না করতে পার।’

(মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বা: ৫/২৩৫, ২৩৬)

যেসব কারণে মিথ্যা বলা যায় :

তিন জায়গায় মিথ্যা বলা বৈধ।

  • ১. যুদ্ধে মিথ্যা বলা বৈধ।
  • ২. দু’গ্রুপের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ।
  • স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল-মহব্বত সৃষ্টি করার জন্যও মিথ্যা বলা বৈধ।

উম্মে-কুলসুম রা. বলেন, আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি :

‘যে ব্যক্তি দু’জনে মাঝে সমঝোতা করার জন্য ভালো কথার আদান-প্রদানকালে মিথ্যা বলে সে মিথ্যুক নয়।’ (বুখারি : ২৫৪৬, মুসলিম : ২৬০৫)

আসমা বিনতে ইয়াজিদ বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, ‘

তিন জায়গা ব্যতীত মিথ্যা বলা বৈধ নয়। স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা বলা, যুদ্ধে মিথ্যা বলা এবং দু’জনের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ। তিরমিজি : ১৯৩৯, সহিহ আল-জামে : ৭৭২৩)

এপ্রিল ফুল (APRIL FOOL) বা এপ্রিলের বোকা :

এপ্রিল ফুল সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি, তবে এ সম্পর্কে অনেক বর্ণনা ও মতামত পাওয়া যায়। এপ্রিল ফুল নিয়ে কারও কারও বক্তব্য হচ্ছে :

আমরা অনেকেই এপ্রিল ফুল বা ‘বিশ্ব বোকা দিবস’ উদযাপন করে থাকি। অথচ এ দিবসের জন্ম রহস্য বা এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। প্রায় হাজার বছর পূর্বে মুসলিমরা যখন স্পেন শাসন করছিল, মুসলিমদের শক্তি অপ্রতিরোধ্য ছিল এবং খ্রিষ্ট-জগৎ বিশ্ব থেকে মুসলামনদের নিশ্চি‎হ্ন করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল, যে ব্যাপারে তারা এক ধরণের সফলতাও পায়, সে সময়ের ঘটনা এটি। স্পেন থেকে মুসলিমদের উৎখাত করার জন্য খ্রিষ্ট-জগৎ অনেকবারই চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। তাই তারা মুসলিমদের এ অপ্রতিরোধ্য শক্তি রহস্য জানার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করল। গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্ট দিল যে, মুসলিমদের আত্মিক শক্তির মূল রহস্য হচ্ছে তাকওয়া। তারা একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে বলেই অন্য কাউকে ভয় পায় না।

যখন তাদের নিকট মুসলিমদের শক্তির রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে গেল, তখন তারা এর মূলে আঘাত হানার জন্য মদ এবং নেশাজাতীয় সামগ্রী স্পেনে রফতানি আরম্ভ করল। তাদের এ কৌশল কার্যকর প্রমাণ হলো। ধীরে ধীরে মুসলিমদের ঈমান দুর্বল হতে লাগল। এক সময় পাশ্চাত্যের ক্যাথলিক খৃস্টানরা স্পেনের সকল যুবকদের কাবু করে ফেলল। প্রায় আট শ বছর যাবৎ মুসলিমদের যে রাজত্ব চলে আসছিল তার সর্ব শেষ ঘাঁটি গ্রানাডার পতন ঘটে পহেলা এপ্রিল। আর এজন্য একে এপ্রিলের বোকা বা ধোঁকা বলা হয়।

তখন থেকেই তারা এর দিবসটি পালন করে আসছে। মুসলিমদের বোকা বানানোর সে দিনটিকেই তারা এভাবে উদযাপন করে এপ্রিল ফুল নামে।

তারা এ বোকামি ও ধোঁকাবাজি শুধু গ্রানাডার বাহিনীর জন্য মনে করছে না বরং এ ধোঁকা তারা সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য মনে করছে এবং সবার ওপরই একে চাপিয়ে দিচ্ছে। আমরা যদি এ সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি বা অন্ধদের ন্যায় এর অনুকরণ করি তবে এটা আমাদের জ্ঞানের দীনতা ভিন্ন বলার কিছু নেই। আমরা যদি এর মূল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হই তবে আমাদের পরাজয়ের দিনে আমাদের উৎসব পালন করা কখনই সম্ভব হত না। বরং স্পেন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের কর্তব হচ্ছে এসব অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করা এবং সত্যিকার ইসলামকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করা। আর কোনভাবেই আমাদের ঈমানে দুর্বলতা আসে এমনসব জীবন গ্রহণ না করা।

এদিন মানুষ বিভিন্ন ধরণের মিথ্যা বলে থাকে। যেমন : কারো সন্তান, স্ত্রী বা ঘনিষ্ঠ কারও মৃত্যুর সংবাদ দেয়, ফলে সংবাদ গ্রহীতা এর দুঃখ সইতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যু বরণ করে। আবার কারো চাকুরী চলে যাওয়া, কারো স্ত্রীর ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, কারো আগুনে পুড়ে যাওয়া বা অসুখ ইত্যাদির ব্যাপারে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে। কারণে হত্যা, তালাক ও অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে- যা কখনোই কাম্য নয়।

তাই আমাদের ইসলাম ধর্ম এ ধরনের মিথ্যা, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণাকে হারাম ঘোষণা করেছে।

(মূল থেকে সামান্য সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে)

সমাপ্ত

সূত্রঃ ইসলাম হাউজ

ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা

$
0
0

লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান | ওয়েব সম্পাদনাঃ শাবাব শাহরিয়ার খান

জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে মানুষকে উপার্জনের নানাবিধ পথ বেছে নিতে হয়। ইসলামের দিকনির্দেশনা হ’ল হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করা। হারাম পথে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগী করলে তা আল্লাহ্র নিকট গৃহীত হবে না। কারণ ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল হালাল উপার্জন। [১] ক্বিয়ামতের ময়দানে বনু আদমকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে এবং এর যথাযথ উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোন মানুষ সামান্য পরিমাণ সামনে অগ্রসর হ’তে পারবে না। তান্মধ্যে একটি হ’ল ‘সে কোন পথে অর্থ উপার্জন করেছে’। [২] বুঝা গেল, অর্থ-সম্পদ হালাল পথে উপার্জন করতে হবে, অন্যথা ক্বিয়ামতের ভয়াবহ দিনে মুক্তির কোন পথ খোলা থাকবে না। আর হালাল পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম হ’ল সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করা। রাসূলুল­াহ (ছাঃ)-কে সর্বোত্তম উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,

 أَطْيَبُ الْكَسْبِ عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ، وَ كُلُّ بَيْعٍ مَبْرُوْرٍ 

‘নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তা-ই সর্বোত্তম’। [৩]

ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের গুরুত্ব ইসলামে অনস্বীকার্য। সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে বৈধ পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতে ইসলাম বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহ বলেন,

 يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلاَّ أَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ’ (নিসা ২৯)

আল্ল­াহ আরো বলেন,

 فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ 

‘যখন ছালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর’ (জুম‘আ ১০)

সুতরাং জীবিকা উপার্জনের উত্তম পেশা হিসাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। উল্লিখিত আয়াতে ছালাতের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের পরই ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে পরকালীন জীবন কল্যাণময় হবে মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

التَّاجِرُ الصَّدُوْقُ الْأَمِيْنُ مَعَ النَّبِيِّيْنَ والصِّدِّقِيْنَ وَ الشُّهَدَاءِ،

‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী ক্বিয়ামতের দিন নবী, ছিদ্দীক্ব এবং শহীদগণের সাথে থাকবে’ [৪]

ব্যবসা-বাণিজ্য জীবিকা উপার্জনের সর্বোত্তম পেশা হওয়ায় মহানবী (ছাঃ), খুলাফায়ে রাশেদীনসহ অধিকাংশ ছাহাবী এর মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কুরআনের বাণী এবং মহানবী (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ছাহাবীগণ জীবন-জীবিকার সন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ঐ সকল ব্যবসায়ী ছাহাবীর মাধ্যমেই অবিমিশ্র-নির্ভেজাল ইসলামের আগমন ঘটে। মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ইত্যাদির উপস্থিতি অতীব যরূরী।

সততার সাথে হালাল উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহিত করে মহান আল্লাহ বলেন,

 وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا،

 ‘আল্ল­াহ ব্যবসাকে হালাল এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২৭৫)

এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইসলাম উপার্জনের পেশা হিসাবে হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি অবৈধ পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতেও নিষেধ করেছে। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন করে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও এর শেষ পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই অন্যায়, যুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, মওজুদদারী ইত্যাদি অবৈধ ও ইসলাম বিরোধী কার্যাবলী পরিহার করে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। রাসূলুল­াহ (ছাঃ) বললেন,

 إِنَّ التُّجَّارَ يُبْعَثُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فُجَّارًا إِلاَّ مَنِ اتَّقَى اللهَ وَبَرَّ وَصَدَقَ 

‘ক্বিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসাবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্ল­াহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’। [৫]

ক্বিয়ামতের ময়দানে কঠিন শাস্তি হ’তে মুক্তি পেতে হ’লে আল্ল­াহভীতি সহকারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। কাউকে সামান্যতম ঠকানোর মানসিকতা অন্তরে পোষণ করা যাবে না। তাছাড়া মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মওজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

 مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ 

‘যে মওজুদদারী করে সে পাপী’ [৬]

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যবসায়ীদেরকে মিথ্যা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশিষ্ট ছাহাবী ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ) আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন,

 يَا مَعْشَرَ التُّجَّارِ إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ

 ‘হে বণিক দল! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে’। [৭]

পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সকল ব্যবসায়ীকে মিথ্যা কসম বর্জন করতে হবে। কারণ তা ইসলামে নিষিদ্ধ। আবু কাতাদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَلِفِ فِى الْبَيْعِ فَإِنَّهُ يُنَفِّقُ ثُمَّ يَمْحَقُ

 ‘ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হ’তে বিরত থেকো। এর দ্বারা মাল বেশী বিক্রি হয়, কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়’ [৮]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,

‘অধিক কসম খাওয়ার প্রবণতা ব্যবসায়ের কাটতি বাড়ায়, কিন্তু বরকত দূর করে দেয়’। [৯]

মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ীদের কঠোর পরিণতি সম্পর্কে অন্য আরেকটি হাদীছে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ، قَالَ أَبُوْ ذَرٍّ خَابُوْا وَخَسِرُوْا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ

 ‘তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্ল­াহ কিবয়ামতের দিন কথা বলবেন না ও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও  করবেন না।  তাদের  জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

আবূ যার বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! কারা নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত?

তিনি বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ঐ ব্যবসায়ী যে মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে’। [১০]

মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ী এতই ঘৃণিত যে, ক্বিয়ামতের দিন আল্ল­াহ তার দিকে ফিরেও তাকাবেন না। প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,

জনৈক বেদুঈন একটি ছাগী নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ছাগীটি তিন দিরহামে বিক্রি করবে? লোকটি বলল, আল্লাহ্র কসম! বিক্রি করব না। কিন্তু সে পরে সেই মূল্যেই ছাগীটি বিক্রি করে দিল। আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্র (ছাঃ)-এর কাছে এসে উল্লে­খ করলাম। তিনি আমার কথাগুলো শুনে বললেন,

بَاعَ آخِرَتَهُ بِدُنْيَاهُ 

‘লোকটি  দুনিয়ার বিনিময়ে তার পরকালকে বিক্রি করে দিয়েছে’ [১১]

ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। দ্রব্যের কোন দোষ-ত্রুটি থাকলে ক্রেতার সম্মুখে তা প্রকাশ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। কোন প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না।  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পণ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,

أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيْهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ، قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّىْ

 ‘একদা নবী করীম (ছাঃ) কোন এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তার হাত ভিজে গেছে। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! বৃষ্টিতে উহা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘তাহ’লে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়’। [১২]

রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ) আরো বলেন,

اَلْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُوْرِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا

 ‘ক্রেতা বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার ঐচ্ছিকতা থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহ’লে তাদের পারস্পরিক এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং পণ্যের দোষ গোপন করে তাহ’লে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত শেষ হয়ে যাবে’ [১৩]

প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ক্রয়ের ইচ্ছা না থাকলে কেবলমাত্র আসল ক্রেতাকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী করে দেওয়া ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 لاَ تَنَاجَشُوْا 

 ‘তোমরা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে ক্রেতার মূল্যের উপর মূল্য বৃদ্ধি করে ক্রেতাকে ধোঁকা দিয়ো না’। [১৪]

কারণ তা ধোঁকাবাজির অন্তর্ভুক্ত, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি যত সামান্যই হোক ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তা বর্জন করা উচিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় একটি মহৎ পেশায় নিয়োজিত লোকদের বৈশিষ্ট্য তেমন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে হাসান বিন ছালিহর ক্রীতদাসী বিক্রয়ের ঘটনাটি একটি অনন্য উদাহরণ।

হাসান বিন ছালিহ একটি ক্রীতদাসী বিক্রয় করলেন। ক্রেতাকে বললেন, মেয়েটি একবার থুথুর সাথে রক্ত ফেলেছিল। তা ছিল মাত্র একবারের ঘটনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ঈমানী হৃদয় তা উল্লে­খ না করে চুপ থাকতে পারল না, যদিও তাতে মূল্য কম হওয়ার আশংকা ছিল। [১৫]

সুতরাং ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহ’লে ইহ-পরকালে কল্যাণ ও মুক্তিলাভ সম্ভব হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওযন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া এবং দেওয়ার সময় কম দেওয়া ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের ধ্বংস অনিবার্য। মহান আল্লাহ বলেন,

وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِيْنَ، اَلَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ، أَلاَ يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوْثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ، يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ

‘যারা ওযনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরাপুরি নেয়। আর যখন তাদের মেপে বা ওযন করে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সকল মানুষ স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হবে’ (মুতাফ্ফিফীন ১-৫)

 আল্ল­াহ অনত্র বলেন,

 وَأَقِيْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلاَ تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ

‘তোমরা ন্যায্য ওযন কায়েম কর এবং ওযনে কম দিয়ো না’ (আর-রহমান ৯)

 বুঝা গেল যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ওযনে কম-বেশী করা গুরুতর অপরাধ। এতে এক শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এক শ্রেণীর মানুষ সাময়িকভাবে লাভবান হয়, যা ইসলামে কাম্য নয়।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীকে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে, অবৈধ উপার্জন ও লোভ-লালসাকে সংবরণ করতে হবে। আর এটাই ইসলামের দাবী। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ইহকালে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন ও পরকালে মুক্তি লাভের তাওফীক দান করুন। আমীন!!

 . মুসলিম; মিশকাত হা/২৭৬০ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।
 . তিরমিযী, হা/২৪১৬, হাদীছ ছহীহ।
 . আহমাদ, মিশকাত হা/২৭৮৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬০৭।
 . তিরমিযী, হা/১২০৯; হাদীছ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৮২।
 .  তিরমিযী, হা/১২১০; ইবনু মাজাহ হা/২১৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৫৮।
 . মুসলিম হা/৪২০৬।
 . ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৯৩।
 . মুসলিম, মিশকাত হা/১৬০৭, ২৭৯৩।
 . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৭৯৪।
 ১০. মুসলিম, হা/১০৫; মিশকাত হা/২৭৯৫।
 ১১. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬৪।
 ১২. মুসলিম; মিশকাত হা/২৮৬০।
 ১৩. বুখারী, হা/২০৭৯; মুসলিম হা/১৫৩২।
 ১৪. বুখারী, মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/১৫৮১।
 ১৫. ইসলামে হালাল হারামের বিধান, পৃঃ ৩৪০।

সিরিয়ায় এক মাসে ৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত

$
0
0

syria_by_ahmad8m-d4wbj6aসিরিয়ায় গত এক মাসে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সহিংসতায় ৬ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ব্রিটেনভিত্তিক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এ তথ্য জানিয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একাটি মানকবাধিকার সংগঠনের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, মার্চ মাসে দেশটিতে ৬ হাজার ৫ জন নিহত হন।

নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ৪শ' ৬৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও দেড় হাজার সরকার বিরোধী বিদ্রোহী ।

এছাড়া, গত মাসে নারী ও শিশুসহ মারা যায় প্রায় ৬'শ বেসামরিক নাগরিক। বাকীদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া জানা যায়নি।

জাতিসংঘের হিসেব মতে, সিরিয়ায় দু’বছরের বেশি সময় ধরে চলমান সহিংসতায় ৭০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে সরকার বিরোধীদের অভিযোগ, সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজারেরও অধিক।

নির্মমভাবে আমাদের মুসলিম ভাই বোনদের এভাবে হত্যা করা হচ্ছে। আমাদের মন কি কাঁদে তাদের জন্য?  আমাদের দু'আতে কি তাদের জন্য কোন অংশ থাকে?

নু’মান ইবনে বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মু’মিনদের আপোসের মধ্যে একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ (একটি) দেহের মত। যখন দেহের কোন অঙ্গ পীড়িত হয়, তখন তার জন্য সারা দেহ অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।” [সহীহ বুখারী ৬০১১; সহীহ মুসলিম ২৫৮৬]

আল্লাহ্‌ তা'আলা সিরিয়ায় নিহত সকল ভাই বোনদেরকে ক্ষমা করে দিন, এবং তাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নাসীব করুন। আমীন

সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান।

 

বাংলাদেশে বসে আমরা হয়ত কিছুই করতে পারব না, কিন্তু অন্তত তাদের জন্য দুয়া তহ আমরা করতে পারি?

ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে প্রত্যাখ্যান করে

$
0
0

 

সংকলক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা : মো: আবদুল কাদের

ইসলাম যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে ধর্মের নামেই রয়েছে শান্তির সুবাস, যে ধর্মের নবীকেই প্রেরণ করা হয়েছে জগতবাসীর জন্য শান্তি ও রহমত স্বরূপ [ . পবিত্র কুরআনের সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭। ], সে ধর্ম সম্পর্কে এমন অপপ্রচার একান্তই বিদ্বেষপ্রসূত। ইসলাম বিদ্বেষী ভাইদের অপপ্রচারে যাতে সরলমনা মুসলিম ভাই-বোনেরা বিভ্রান্ত না হন, তাই আজ পবিত্র কুরআনে এদু’টি শব্দ কতভাবে এসেছে তা আলোচনা করে এ ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস পাব এ নিবন্ধে ইনশাআল্লাহ।

অনেক রাজনৈতিক নেতা ও চিন্তাবিদই আরবী ‘উনুফ’ বা ‘সহিংসতা’ (Violence) শব্দ ও ‘ইর‘আব’ বা ‘আতঙ্কসৃষ্টি’ (Terrorism) শব্দের মধ্যে, তেমনি ‘উনুফ’ বা ‘সহিংসতা’ ও ‘আল-ইর‘আব আল-উদওয়ানী’ বা ‘আগ্রাসন’ শব্দের মধ্যে এবং ‘উনুফ’ বা ‘সহিংসতা’ ও ‘আল-ইর‘আব আয-যরুরী’ বা ‘ত্রাস’ শব্দের মধ্যে পার্থক্য করেন না।

বস্তুত বিদেশি শব্দ সন্ত্রাস বা Terrorism-এর আরবী প্রতিশব্দ ‘ইরহাব’ নয়; ‘ইর‘আব’ . কেননা (‘ইরহাব’ শব্দের ধাতুমূল তথা) ‘রাহ্ব’ (الرهب) শব্দ ও তা থেকে নির্গত শব্দাবলি পবিত্র কুরআনে ত্রাস নয় বরং সাধারণ ভীতি-সঞ্চার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাতে একটি নির্দিষ্ট বস্তুর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অর্থ মিশে থাকে। অন্যের বেলায় মানুষ শব্দটি ব্যবহার তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাবার জন্য [ সূরা তাওবা : ৩৪; নাহল : ৫১; আম্বিয়া : ৯০; কাসাস : ৩২; হাদীদ : ২৭; হাশর : ১৩। ]। আর এ শব্দ কিন্তু ‘র‘ব’ (الرعب) শব্দ থেকে ভিন্ন অর্থ বহন করে। কেননা ‘র‘ব’ শব্দের অর্থ তীব্র ভীতি-সঞ্চার অর্থাৎ ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা[ . সূরা আলে-ইমরান : ১৫১; আনফাল : ১২; আহযাব : ২৬; হাশর : ২। ] । মানুষ এ শব্দটিকে ব্যবহার করে অন্যকে শায়েস্তা করা এবং তাদের ওপর জুলুম চালানোর জন্য। আবার এর কতক সংঘটিত হয় উদ্দেশ্যহীন, অনির্দিষ্ট ও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে[ইবন মানযুর, আল-বুসতানী। ] ।

তবে এতদসত্ত্বেও ‘ইরহাব’ ও ইর‘আব’ শব্দ আরবী ভাষায় ধাতুগতভাবে শুধু মন্দ বা শুধু ভালোর জন্য ব্যবহৃত হয় না। এদুটি এমন মাধ্যম যা ভালো বা মন্দের পক্ষাবলম্বন করে না। উভয় শব্দ সত্য প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় প্রতিরোধ এবং নিপীড়িতের সাহায্যার্থে ব্যবহৃত হয়। তেমনি শব্দদুটিকে নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষের ওপর অত্যাচার, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ও অধিকার হরণ এবং তাদের ভূমি দখলের জন্যও ব্যবহৃত হয়।

তবে ‘উনুফ’‘ইরহাব’ শব্দের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। ‘উনুফ’ অর্থ চিন্তা, মতবাদ, দর্শন কিংবা সাধারণ বা বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে সহিংস মাধ্যম বা উপায় অবলম্বন করা। যেমন : আঘাত, শারীরিক নির্যাতন বা অস্ত্র ব্যবহার। পক্ষান্তরে ‘ইরহাব’ ও ‘ইর‘আব’ শব্দদুটি এর চেয়ে ব্যাপক অর্থ বহন করে। কারণ তা হতে পারে সহিংস উপায়ে আবার হতে পারে অহিংস উপায়ে। যেমন :

আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে ভয় দেখানো। (তাকে এভাবে ইঙ্গিতে জবাই করার ভয় দেখানো।) অথবা কথার দ্বারা ভয় দেখানো। যেমন : অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের হুমকি, কঠোরতা আরোপের হুমকি, না খেয়ে মারার হুমকি কিংবা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি ইত্যাদি। ‘ইরহাব’ ও ‘ইর‘আব’ শব্দদুটি ভেটোর ক্ষমতা প্রয়োগ অথবা জালেমের নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করে। অসত্য অভিযোগ প্রচারের মাধ্যমেও ‘ইরহাব’ ও ‘ইর‘আব’ সংঘটিত হতে পারে। যেমন : টার্গেট গোষ্ঠীর সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বা তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে অপপ্রচার ও প্রচলিত মিডিয়া যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করা।

এই ‘ইরহাব’ ও ‘ইর‘আব’ কখনো হামলার শিকার ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক হত্যা করে না। বরং তাকে দীর্ঘ শাস্তি ও ধারাবাহিক নির্যাতন করে ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে মারে। অর্থাৎ এ দুটি কখনো তৎক্ষণাৎ না মেরে ধীরে ধীরে মৃত্যু ডেকে আনে। এটি করা হয় তাকে গৃহহীন অবস্থা ও ক্ষুধার মুখে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে।

আমাদের চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ব্যাপকার্থে যারা ‘ইরহাব’ ও ‘ইর‘আব’ করছে- যার মধ্যে রয়েছে সত্য প্রতিষ্ঠা করা ও নির্যাতন প্রতিরোধ করা অথবা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া ও অত্যাচারীকে আশ্রয় দেয়া- এরা প্রধানত তিন দলে বিভক্ত। যথা :

১. যারা নীতি-নৈতিকতার বাইরে গিয়ে শব্দদুটিকে ব্যবহার করে তাদের নির্যাতন বা অন্যায়কে বৈধতা দেবার জন্য। আখিরাতে বিশ্বাসী হোক বা না হোক- এরা মানবস্বভাব ও ঐশী শিক্ষার বিরোধী। যার মধ্যে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শও রয়েছে।

২. যারা যথাসাধ্য প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে থেকে শব্দদুটি ব্যবহার করে আত্মরক্ষা কিংবা অক্ষম ও নিরপরাধ লোকদের থেকে জুলুম প্রতিরোধের উদ্দেশে। তারা আখিরাত বা শাশ্বত জীবনে বিশ্বাস রাখে না। তারা এসব করে আল্লাহ প্রদত্ত সুস্থ বিবেকের তাড়নায়।

৩. যারা শব্দদুটি ব্যবহার করে আত্মরক্ষা বা অক্ষম ও নিরপরাধ লোকদের ওপর জুলুম প্রতিরোধে যথাসম্ভব শরীয়ত ও প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে থেকে। তারা বিশ্বাস করে এজন্য তারা আখিরাত বা শাশ্বত জীবনে বিশাল প্রতিদান লাভ করবে। অতএব, তারা এসব করে সুস্থ বিবেক ও অনন্ত জীবনের বিশাল প্রতিদানের প্রত্যাশায়।

এ জন্যই দেখা যায় শেষোক্ত দলটি আত্মোৎসর্গ ও আত্ম নিবেদনে সবচে বেশি আগ্রহী ও সাহসী হয়। কেননা ,তার দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন কেবল উসিলা বা বিধেয় মাত্র; মাকসাদ বা উদ্দেশ্য নয়। সম্ভবত এটিই মানুষকে নিজেদের সম্মানিত স্থান, নিজেদের মাতৃভূমি ও নিপীড়িত স্বজনদের রক্ষায় প্রাণোৎসর্গমূলক জিহাদী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।

সাধারণভাবে আত্মঘাতমূলক তৎপরতার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের আইন ব্যাখ্যাকারী তথা ফিকহবিদদের মতভিন্নতা হেতু বিভিন্ন হয়। তাদের অনেকে কাজটিকে বৈধ বলেন এবং এ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধও করেন। যতক্ষণ তা হয় আত্মরক্ষার্থে এবং অন্যায়ভাবে অন্যের ওপর সীমালঙ্ঘনের ইচ্ছে ছাড়া। উপরন্তু তা নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধেও পরিচালিত না হয়, যাদের ওপর ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যন্ত হামলার অনুমতি দেয় না। যেমন : নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও নিরস্ত্র ব্যক্তি। অনুরূপভাবে সব রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই মানবরচিত আইন সেনাদেরকে নিজের দৃষ্টিতে বৈধ যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিতে এমনকি জীবন উৎসর্গ করতে পর্যন্ত উৎসাহিত করে। পক্ষান্তরে অনেক শরীয়তবিদ কাজটিকে আত্মহত্যার সঙ্গে তুলনা করে হারাম বলে অভিহিত করেন। তাদের মতে, জীবনের ঝুঁকি নেয়া ভিন্ন জিনিস। কারণ সেখানে জীবন রক্ষার সম্ভাবনাই প্রবল। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝুঁকি গ্রহণকারীর মৃত্যুর কোনো অভিপ্রায়ই থাকে না।

আসমানী রিসালত বা ঐশী বার্তাপ্রাপ্ত ধর্ম পালনকারী ব্যক্তিমাত্রেই জানেন, দুনিয়ার এ জীবন মূলত একটি পরীক্ষাতুল্য। এর মাধ্যমে চিরস্থায়ী জীবনে পুরস্কারযোগ্য সৎকর্মশীল এবং অনন্ত জীবনে তিরস্কারযোগ্য অসৎ ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য রচনা করা হয়। আর সত্যপন্থী ও মিথ্যাপন্থীর সংঘাত এবং নিপীড়ক ও নিপীড়িতের দ্বন্দ্ব এ পরীক্ষার একটি অংশ মাত্র। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40)

 

‘আর আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে বিধস্ত হয়ে যেত খৃস্টান সন্ন্যাসীদের আশ্রম, গির্জা, ইয়াহূদীদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ- যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়।’[হজ : ৪০।]

 

‘ইরহাব’ ও ‘ইর‘আব’ কখনো সংঘটনের ইচ্ছা ছাড়া সংঘটিত হতে পারে। ভুলক্রমেও হতে পারে কখনো। তবে এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক করার পরও যদি সে এমন কাজ থেকে নিবৃত না হয়, যা ‘ইরহাব’ বা ‘ইর‘আব’-এর কারণ হয়, তখন তা ইচ্ছাকৃত ‘ইরহাব’ বা ‘ইর‘আব’ বলেই গণ্য হবে।

ইসলাম যেহেতু মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতের ব্যাপক শান্তি কিংবা অন্তত নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে শুধু দুনিয়ার শান্তির প্রতি আহ্বান জানায়। তাই এ ধর্ম অন্যের ওপর অত্যাচার বা সীমালঙ্ঘনমূলক ‘ইরহাব’‘ইর‘আব’ সংঘটনকে কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করে। তীব্রভাবে একে প্রত্যাখান করে এবং সীমালঙ্ঘন বা উৎপীড়নমূলক ‘ইরহাব’ ‘ইর‘আব’ এর জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে।

হ্যা, ইসলাম এতদুভয়ের অনুমতি দেয় ঠিক; তবে তা শাস্তিকে অপরাধী পর্যন্ত সীমিত রাখা এবং অনুমোদিত ক্ষেত্র অতিক্রম না করার শর্তে। অনুমোদিত ক্ষেত্র হলো, আত্মরক্ষা, শত্রু দমন ও নির্যাতিতের সাহায্যের জন্য। বিশেষত জুলুম প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতাই সেসব দুর্বল ও অক্ষম ব্যক্তির নেই। একেই ইসলামে ‘জিহাদ’[যিনিই আরবী ‘জিহাদ’ শব্দ ও এর ধাতুমূল নিয়ে চিন্তা করবেন, দেখবেন তাতে পূর্বে সংঘটিত কোনো কিছুর প্রতিরোধ অর্থ লেপ্টে আছে। কোনো হামলার সূচনার অর্থ নেই তাতে। যেমন দেখতে পারেন, ইবনুল কায়্যিম : ৩/৫-৯।] অথবা ‘কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ’ বলা হয়। যার উদ্দেশ্য কেবল নিরস্ত্র, অক্ষম ও দুর্বলদের থেকে জুলুম তুলে দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَل لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَل لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا (75)

 

‘আর তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে’ যার অধিবাসীরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।’[নিসা : ৭৫।]

 

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنِّى حَرَّمْتُ عَلَى نَفْسِى الظُّلْمَ وَعَلَى عِبَادِى فَلاَ تَظَالَمُوا.

 

‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’[মুসলিম : ৬৭৪০।]

 

এ কারণেই মুসলমানদের ক্ষেত্রে এমন বিচিত্র নয় যে তারা তাদের প্রজা সাধারণ (যিম্মী) বা সংখ্যালঘুদের বাঁচাতেও জিহাদ করছে।[ইবন কুদামা মুকাদ্দেসী; ইবন তাইমিয়া হাররানী, আশ-শিরাজী; আল-হানাফী।] এককথায়, কারও ওপর জুলুম চালানোর জন্য নয়; ইসলামে ‘জিহাদ’ নামক বিধান রাখা হয়েছে বৈধ প্রতিরোধের জন্য। আর নির্যাতন প্রতিরোধের পদক্ষেপকে গণতান্ত্রিক ও অন্যান্য দেশের মানব রচিত সকল ব্যবস্থাই সমর্থন করে। এ উদ্দেশ্যেই তো সকল রাষ্ট্র শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করে। নিজেকে সুসজ্জিত করে বিধ্বংসী সব অস্ত্র দিয়ে।

আত্মরক্ষামূলক এবং আক্রমণাত্মক ভীতিপ্রদর্শনের মধ্যে পার্থক্য করবো কিভাবে
ইতোমধ্যে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে, ভীতিপ্রদর্শন ও ভয় দেখানো শব্দটিকে সন্ত্রাসী (জালেম) ও সন্ত্রাসের শিকার (মাজলুম) উভয়েই ব্যবহার করে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা এদুয়ের মধ্যে জালেম ও মজলুমকে পার্থক্য করবো কিভাবে?

আত্মরক্ষার্থে ভীতিপ্রদর্শন আর সন্ত্রাসমূলক ভীতিপ্রদর্শনের মধ্যে মোটাদাগে পার্থক্য এই :

অন্যের বিরুদ্ধে কে প্রথমে ত্রাস বা সন্ত্রাসের সূচনা করেছে? যে সূচনা করেছে সে চর্চা করছে আক্রমণাত্মক ভীতিপ্রদর্শন আর যিনি প্রতিরোধ করছেন তিনি হলেন আত্মরক্ষাকারী। একইভাবে যিনি জালেমকে বস্তুগত বা নৈতিকভাবে সমর্থন করবেন তিনি আক্রমণাত্মক ভীতিপ্রদর্শনকারীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবেন। পক্ষান্তরে যিনি মজলুমকে সাহায্য করবেন তিনি আত্মরক্ষাকারী বলে গণ্য হবেন।
এটা ঠিক সচরাচর সহজে সূচনাকারী শনাক্ত করা যায় না। কারণ, জালেম পক্ষের গরিমা ও অহঙ্কার বেশি হয়। নিপীড়কের শক্তি হয় পর্বতপ্রমাণ। এমনকি মজলুমের চেয়ে জালেমের প্রমাণও হয় দৃঢ়তর। তথাপি বিষয়টি অন্যভাবে খোলাসা করা সম্ভব।
তবে সূচনাকারী শনাক্ত করা মুশকিল হলে অন্যভাবে তা চি‎হ্নিত করা যায়। যেমন আমরা উভয় পক্ষের মধ্যে মিমাংসার চেষ্টা করে দেখবো। যে পক্ষ ইনসাফভিত্তিক সালিশের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাবে সে-ই জালেম, হোক সে মুসলিম। কারণ আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ (9)

 

‘আর যদি মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দলটি বাড়াবাড়ি করবে, তার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি দলটি ফিরে আসে তাহলে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে মীমাংসা কর এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন।’[সূরা আল-হুযরাত, আয়াত : ০৯।]

 

সন্ত্রাস ও আগ্রাসী হামলা কখনো ভিন্ন রূপ ধারণ করে। তা হলো, অভিযোগ প্রমাণ না করেই কোনো মানুষকে শাস্তি দেয়া। কিংবা কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ওপর নির্ভর করে একটি জাতিকে বা পুরো মানব সমাজকে শাস্তি দেয়া। এ কাজ ইসলাম কিছুতেই সমর্থন করে না। শাস্তি দিলে তা অবশ্যই অনুমোদিত সীমা অতিক্রম না করতে হবে। অভিযোগ প্রমাণের পরও শাস্তি থাকতে হবে যুক্তিগ্রাহ্য সীমারেখার ভেতর। পরন্তু শাস্তির প্রকৃতিও হওয়া চাই অভিন্ন। অত্যাচারী বা জালেমের ভিন্নতায় তা যেন ভিন্ন ভিন্ন না হয়। অতএব যালেম দুর্বল হলে বা মিত্র না হলে তার শাস্তি কঠোর হবে না। তেমনি যালেম শক্তিধর, মিত্র বা তার কাছে কোনো স্বার্থ থাকলে তার শাস্তি লঘু করা হবে না। সর্বদা শাস্তি হবে ইনসাফের আলোয় উদ্ভাসিত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সর্বাবস্থায় ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (8)

 

‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোন কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’[সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৮।]

 

তবে ইসলামের এসব সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকার পরও মুসলিম নামধারী অনেকে ইসলামের মহান আদর্শকে উপেক্ষা করে। আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ অমান্য করে তারা সন্ত্রাস ও আগ্রাসনের পথ বেছে নেয়। এটা স্বাভাবিক যে প্রতিটি রাষ্ট্রই তার নাগরিকদের সঠিক আচরণ শিক্ষা দেয়। তারপরও তো প্রতিটি দেশেই অপরাধীতে পূর্ণ অনেক কয়েদখানা থাকে। তাই বলে কি আমরা বলবো যে অমুক জাতি পুরোটাই অপরাধী? কিংবা অমুক জাতি তার সদস্যদের অপরাধ শিক্ষা দেয়? আমেরিকার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৮২-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৫টি অন্যায় হামলা বা সন্ত্রাস সংঘটিত হয়েছে। এর অধিকাংশ সংঘটিত হয়েছে খ্রিস্টান দ্বারা, তারপর ইহুদিদের দ্বারা। তাই বলে কি আমরা বলবো সকল খ্রিস্টান বা সব ইহুদিই সন্ত্রাসী বা আগ্রাসী? অবশ্যই না।

অতএব আজ যারা ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের সম্পর্ক আবিষ্কার করতে চান, কুরআনের ভেতর অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে মানবাধিকার পরিপন্থী কথা তালাশ করে হয়রান হন, তারা হয়তো অমুসলিমদের প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে কিংবা ইসলাম বিরুদ্ধ শক্তির প্রভাবে এমনটি করে থাকেন। ইদানীং মুসলিম নামধারী অনেককেও দেখা যায় ইসলাম-আরাতীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাতে। তাদের সুরে কথা বলতে। বরং ইসলামের অনিষ্ট চিন্তায় অমুসলিমদের চেয়ে এসব মুসলিম নামধারীরাই একধাপ এগিয়ে। তাদের জন্য থাকছে আমাদের বুকভরা ভালোবাসা, একরাশ করুণা আর অনন্ত শুভ কামনা। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এবং সকল মুসলিমকে হেদায়াত দিন। সবাইকে ইসলাম বিরোধী শক্তির অপ্রচারের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার তাওফীক দিন। আমীন।

কৃতজ্ঞতা-স্বীকার : ড. সাঈদ ইসমাঈল চীনী, তাসাউলাত জাদালিয়্যাহ হাওলাল ইসলাম ও তালীকাত।


জুম’আর দিনের ফযীলত

$
0
0

উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য জুম’আর দিনের ফযীলত সমূহ

১) সূর্য উদিত হয় এমন দিনগুলোর মধ্যে জুম’আর দিন হল সর্বোত্তম দিন। এ দিনে যা কিছু ঘটেছিল তা হলঃ

(ক) এই দিনে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছিল,

(খ) এই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল,

(গ) একই দিনে তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল [মুসলিমঃ৮৫৪],

(ঘ) একই দিনে তাঁকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছিল,

(ঙ) এই দিনেই তাঁর তওবা কবুল করা হয়েছিল,

(চ) এই দিনেই তাঁর রূহ কবজ করা হয়েছিল [আবু দাউদঃ১০৪৬],

(ছ) এই দিনে শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে,

(জ) এই দিনেই কিয়ামত হবে,

(ঝ) এই দিনেই সকলেই বেহুঁশ হয়ে যাবে [আবু দাউদঃ১০৪৭],

(ঞ) প্রত্যেক নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা, আকাশ, পৃথিবী, বাতাস, পর্বত ও সমুদ্র এই দিনটিকে ভয় করে। [ইবনে মাজাহঃ১০৮৪, ১০৮৫; মুয়াত্তাঃ৩৬৪]।

 

২) উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এটি একটি মহান দিন। এ জুম'আর দিনটিকে সম্মান করার জন্য ইহুদী-নাসারাদের উপর ফরজ করা হয়েছিল; কিন্তু তারা মতবিরোধ করে এই দিনটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অতঃপর ইহুদীরা শনিবারকে আর খ্রিষ্টানরা রবিবারকে তাদের ইবাদতের দিন বানিয়েছিল। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের জন্য শুক্রবারকে মহান দিবস ও ফযীলতের দিন হিসেবে দান করেছেন। আর উম্মতে মুহাম্মদী তা গ্রহন করে নিল। [বুখারী ৮৭৬, ইফা ৮৩২, আধুনিক ৮২৫; মুসলিমঃ ৮৫৫]

 

৩) জুম’আর দিন হল সাপ্তাহিক ঈদের দিন। [ইবনে মাজাহঃ ১০৯৮]

 

৪) জুম’আর দিনটি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনটি আল্লাহর কাছে অতি মর্যাদা সম্পন্ন। (মুসনাদে আহমদঃ৩/৪৩০; ইবনে মাজাহঃ১০৮৪)

 

৫) জুম’আর দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে যা চায়, তা-ই তাকে দেওয়া হয়। আর এ সময়টি হল জুম’আর দিন আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। [বুখারীঃ৯৩৫, ইফা ৮৮৮, আধুনিক ৮৮২; মুসলিমঃ৮৫২]

 

৬) জুম’আর রাতে বা দিনে যে ব্যক্তি মারা যায় আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের ফিতনা থেকে রক্ষা করবেন। [তিরমিযীঃ১০৭৮]

 

৭) জান্নাতে প্রতি জুম’আর দিনে জান্নাতীদের হাট বসবে। জান্নাতী লোকেরা সেখানে প্রতি সপ্তাহে একত্রিত হবেন। তখন সেখানে এমন মনমুগ্ধকর হাওয়া বইবে, যে হাওয়ায় জান্নাতীদের সৌন্দর্য অনেক গুণে বেড়ে যাবে এবং তাদের স্ত্রীরা তা দেখে অভিভূত হবে। অনুরূপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি স্ত্রীদের বেলায়ও হবে। [মুসলিমঃ২৮৩৩, ৭১/৭৫৩]

 

৮) যে ব্যক্তি জুম’আর দিনে সুরা কাহফ পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য দুই জুম’আর মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেবেন। [জামেউস সাগীরঃ৬৪৭০]

 

৯) যে ব্যক্তি জুম’আর দিনে সুরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত পড়বে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। [মুসলিম]

 

১০) প্রত্যেক সপ্তাহে জুম’আর দিন আল্লাহ তায়ালা বেহেশতী বান্দাদের দর্শন দেবেন। [সহীহুত তারগীব]

 

১১) এই দিনে দান খয়রাত করার সওয়াব অন্য দিনের চেয়ে বেশী হয়। ইবনুল কায়্যিম বলেছেন, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসের দানের সওয়াব যেমন বেশী তেমনি শুক্রবারের দান খয়রাত অন্য দিনের তুলনায় বেশী। [যাদুল মা’আদ]

 

১২) ইবনুল কায়্যিম আরও বলেছেন যে, অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসের মর্যাদা যেমন, সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুম’আ বারের মর্যাদা ঠিক তেমন। তাছাড়া রমজানের কদরের রাতে যেমন ভাবে দোয়া কবুল হয়, ঠিক তেমনি শুক্রবারের সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও দোয়া কবুল হয়। [যাদুল মা’আদঃ১/৩৯৮]

 

সূত্রঃ বই-প্রশ্নোত্তরে জুমুআ ও খুৎবা (লেখকঃ অধ্যাপক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম; পরিমার্জনেঃ ডঃ মোহাম্মদ মনজুরে ইলাহী, ডঃ আবু বকর মুহাম্মদ জাকারিয়া মজুমদার, ডঃ মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ।)

সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী আল্লাহ্‌

$
0
0

অনুবাদ এবং ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার  

কোরআন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন:

“বস্তুতঃ তোমরা এমন বিষয়কে অপছন্দ করছো যা তোমাদের পক্ষে বাস্তবিকই মঙ্গলজনক। পক্ষান্তরে, তোমরা এমন বিষয়কে পছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য বাস্তবিকই অনিষ্টকর এবং আল্লাহ্‌ই অবগত আছেন আর তোমরা অবগত নও।” [সূরা বাকারাহ্‌; ২:২১৬]

 

আমরা উল্লিখিত আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করব যা আমাদের সকলেরই উপকারে আসবে, ইনশাআল্লাহ্‌।

 

আপনি আল্লাহ্‌র পরিকল্পনার বাইরে নন:

“অবস্থা দৃষ্টে ঘটনা একরকম মনে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে তার উল্টোটা। মুসাকে (আ) নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যে তাঁর মাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল; ইউসুফকে (আ) মেরে ফেলার জন্যে কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল; ঈসার (আ) মা মারইয়াম কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই অলৌকিকভাবে সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন; আয়েশাকে (রা) মিথ্যা কলঙ্কে অভিযুক্ত করা হয়েছিল; ইউনুসকে (আ) তিমি মাছ গিলে ফেলেছিল; ইব্রাহীমকে (আ) আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল; মুহাম্মাদ (সা) এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজার (রা)মৃত্যু বরণ করা; সালামাহ্‌ (রা) ভেবেছিলেন যে, আবু সালামাহ্‌ (রা) থেকে উত্তম আর কেউ হতে পারবে না; একবার ভেবে দেখুন তো, এই ঘটনাগুলো ঘটার সময় লোকেরা কী ভেবেছিল আর পরবর্তীতে ঘটনাগুলো কোন দিকে মোড় নিয়েছিল!!

 

অতএব, দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার জন্যও রয়েছে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের পরিকল্পনা। [উৎস: অজ্ঞাত]

 

আমরা তা-ই  চাই, যা আমরা  পছন্দ করি। কিন্তু আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তা-ই ঘটান যা তিনি ইচ্ছা করেন।

 

অনেকদিন আগের এক ঘটনা। ইসরাইলের এক সাবেক রাজার বেশ কয়েকজন ছেলে ছিল। ছেলেদের কেউ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই নিজেকে মোটা কাপড়ের তৈরি পোশাকে জড়িয়ে চলে যেত পাহাড়ের গুহায় ইবাদতে মগ্ন লোকদের দলে যোগ দেয়ার জন্য। যতদিন বেঁচে থাকত এভাবেই ইবাদত বন্দেগী করতে থাকত তারা। রাজা তার ছেলেদেরকে কখনোই এভাবে পাহাড়ে যেতে বাঁধা দেননি। কারন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, আল্লাহ্‌ই তার ছেলেদের সত্যের পথে পরিচালিত করছেন। তাদের হৃদয়কে বদলানোর ক্ষমতা তার নেই।

কিন্তু বৃদ্ধবয়সে উপনীত রাজা তার সর্বশেষ ছেলের পাহাড়ে যাওয়ার ব্যাপারে মত পরিবর্তন করলেন। তিনি সকল মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের নিয়ে জরুরী বৈঠক ডাকলেন এবং বললেন, “আমি আমার এই ছেলেকে অন্য ছেলেদের থেকে অনেক বেশী ভালোবাসি। আমার মনে হচ্ছে আমি আর বেশীদিন বাঁচব না। আমার ভয় হচ্ছে, সে যদি তার ভাইদের সাথে গিয়ে যোগ দেয়, তাহলে আমার পরিবারের বাইরের লোকে আমার এই রাজত্ব দখল করার চেষ্টা করবে। কাজেই বয়স অল্প থাকতেই তাকে নিয়ে যাও। তার মনে দুনিয়ার ভালোবাসা, সুখ, আহ্লাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করো। এতে করে সে হয়তো আমার মৃত্যুর পর তোমাদের রাজা হতে চাইবে।”

রাজার উপদেষ্টামণ্ডলী সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন কী করা যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বিশাল একটি এলাকা খুঁজে বের করলেন এবং তার পুরোটাই প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেয়া হলো। অতঃপর সেই শিশু রাজকুমারকে তারা প্রাচীর ঘেরা এলাকায় রেখে তার সবরকম বিনোদন আর বিলাসিতার ব্যবস্থা করলেন। রাজকুমার সাবালক না হওয়া পর্যন্ত চার দেয়ালের ভিতরেই জীবন কাটাতে লাগল। একদিন সে চারিদিকে একনজর তাকিয়ে বলল: “আমার ধারণা এই চার দেয়ালের বাইরেও একটি পৃথিবী আছে। আমাকে বাইরে নিয়ে চলো। আমি জ্ঞান অর্জন  করতে চাই।” 

তত্ত্বাবধায়কেরা বলল, “বাইরের জগতের সাথে এখানকার কোন পার্থক্য নেই।” রাজকুমার তর্ক না করে আরেক বছর পার করলো। এতোদিন সে চার দেয়ালের ভিতরেই ঘোড়ায় চড়ে সময় কাটিয়েছে। একবছর পরে স্বাভাবিকভাবেই সে আবার তার তত্ত্বাবধায়কদের একই অনুরোধ করল। আর তারাও গত বছরের ন্যয় একই উত্তর দিলো।

কিন্তু এবার রাজকুমার জোরালো কণ্ঠে বলল: “আমাকে যেতেই হবে।” তত্ত্বাবধায়কেরা তাকে থামিয়ে রাখতেও পারে না আবার ছেড়ে দিতেও পারে না। ফলে বিষয়টি তাড়াতাড়ি করে রাজাকে জানানো হলো। রাজা ছেলেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে বললেন, “আমরা তা-ই চাই যা আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু আল্লাহ্‌ তা-ই ঘটান যা তিনি ইচ্ছা করেন।”

এবার লোকেরা রাজকুমারের নিকট ফিরে আসলো এবং তার জন্য নির্মিত সেই প্রাচীর বেষ্টিত অভয়ারণ্যের দরজা খুলে দিলো। রাজকুমার জীবনে প্রথমবার বাইরের জগতে পা রেখে অবাক বিস্ময়ে চারপাশে তাকাতে থাকলো। তাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলেও তার দেখাশোনা করার জন্য সাথে ছিল তত্ত্বাবধায়ক বাহিনী। শিশুকাল থেকে চার দেয়ালের ভিতর বিলাসীতায় জীবন কেটেছে তার। এখন বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। কাজেই রাজার উপদেষ্টারা রাজকুমারের সাথে নিরাপত্তা রক্ষীদের থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। সাথের লোকজনের সকলেই তার নতুন পৃথিবী দেখার প্রতিক্রিয়াকে খেয়াল করতে থাকলো। লোকেরা তখনও আশাবাদী এই রাজকুমারই একদিন তাদের রাজা হবেন।

 

কিছুদূর হাটার পর তারা ভীষণ রোগাক্রান্ত এক ব্যক্তিকে দেখতে পেল। রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে তার?”

উপদেষ্টারা জবাবে বলল: “সে ভীষণ অসুস্থ।”

দুনিয়াদারীর জ্ঞানশুন্য, অনভিজ্ঞ রাজপুত্র জানতে চাইলো, “এই লোকের রোগ কি সব মানুষেরই হয় নাকি হাতে গোনা কিছুলোক রোগাক্রান্ত হয়?”

লোকেরা জবাব দিলো, “আল্লাহ্‌ যার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন তারই রোগ হয়।”

রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা! ঐসব লোকেরা তাহলে আগে থেকেই জানতে পারে এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তা-ই না? নাকি এ ব্যাপারে কোনো সতর্কবাণী আসে না। ফলে সবাই রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত থাকে?”

তারা বলল, “আসলে সবাই রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত থাকে।”

“এতো ক্ষমতাধর রাজকুমার হওয়ার পরও আমিও কি অন্যসব মানুষের মতোই?”

তারা বলল, “জী, তা সত্ত্বেও আপনিও তাদের মতোই।”

রাজপুত্র বলল, “তাহলে তো তোমাদের এই জীবনও নিরাপত্তাহীন এবং ঝুঁকিপূর্ণ!”

 

তারা হাঁটতে থাকলো। কিছুদূর যেতেই এক জরাগ্রস্ত দুর্বল বৃদ্ধের দেখা মিললো। শক্তিহীন সেই বৃদ্ধ বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে। মুখের লালা ঝরে বুকে গড়িয়ে পড়ছে। এতো বৃদ্ধ মানুষ রাজপুত্র এর আগে আর কখনো দেখেনি। অবাক বিস্ময়ে সে জিজ্ঞেস করল, “তার কেন এই অবস্থা?”

তারা বলল, “বার্ধক্যের কারণে মানুষ এমন হয়ে যায়।”

রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “সব মানুষেরই কি এমন অবস্থা হয় নাকি অল্পকিছু মানুষের এমন হয়ে থাকে?”

তারা বলল, “আসলে সব মানুষই এই পরিণতির ভয়ে আতঙ্কিত থাকে।”

রাজপুত্র বলল, “তাহলে তোমাদের জীবন তো নিরাপত্তাহীন এবং ঝুঁকিপূর্ণ।”

 

তারা আবার হাটা শুরু করল। কিছু দূর যেতেই দেখল বেশকিছু লোক একটি লাশ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু সম্পর্কে রাজপুত্রের কোনো জ্ঞান না থাকায় সে অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইলো, “কি হয়েছে তার?”

জবাবে তারা বলল, “লোকটি মারা গেছে।”

রাজপুত্র বলল, “তাকে উঠে বসতে বলো, কথা বলতে বলো।”

তারা বলল, “তার জন্য উঠে বসা বা কথা বলা আর সম্ভব নয়।”

রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল, “সব মানুষই কি মারা যায় নাকি অল্পকিছু লোক এভাবে মারা যায়?”

তারা বলল, “কেউ ভয় করুক আর না করুক, প্রত্যেকেরই শেষ পরিনতি মৃত্যু।”

রাজপুত্র বলল, “তোমরা কি তাহলে এ সবকিছুই এতোদিন যাবৎ আমার কাছে লুকাচ্ছিলে?”

“কেউ যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, এই শেষ পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।”

 

মর্মাহত রাজপুত্র বলল, “তোমরা এতোদিন আমার সাথে প্রতারণা করেছ। আজ যদি আমি সেই চার দেয়ালের বাইরে না আসতাম তাহলে হঠাৎ কবে মারা যেতাম। অথচ বুঝতেও পারতাম না যে, আমি মারা যাচ্ছি। আজ আমি তোমাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত।”

সে তাদের সঙ্গ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হলো। সাথের লোকেরা সংখ্যায় অধিক হওয়ায় সবাই তাকে ঘিরে ধরলো।

তারা বলল, “আপনার পিতার নিকট ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা আপনার সাথেই থাকছি। অবশেষে, সবাই প্রাসাদে ফিরে আসলো এবং লোকেরা রাজার কাছে সবকিছু খুলে বলল।”

নিরাশ হয়ে রাজা বললেন, “আমি কি তোমাদের বলিনি, আমরা তা-ই চাই যা আমরা পছন্দ করি কিন্তু আল্লাহ্‌ তা-ই ঘটান যা তিনি ইচ্ছা করেন। তাকে যেতে দাও। আজ থেকে তার ওপর তোমাদের আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই।”

 

_________________

 

 

স্থায়ী দাম্পত্যের জন্য বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করুন

$
0
0

মূল : আমাল কিল্লাওয়ি | ভাষান্তর ও সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

প্রকাশনায় : PureMatrimony Bangladesh

muslim-man-putting-shoes-on-woman

সম্প্রতি এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে মানুষের দাম্পত্য নিয়ে নানা সমস্যার কথা শুনলাম। অতিথিরা যখন নেচে গেয়ে অনুষ্ঠান মাত করছিল, হলের একদম পেছনের দিকে বসে বসে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন আর অপূর্ণ প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের কথা হচ্ছিল। গানবাজনার উচ্চ শব্দের কারণে পরস্পরের কথা শোনার জন্য মাঝে মাঝে আমাদেরকে চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছিল। একজন কমবয়সী নারী বললেন, তার স্বামী তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেবেন না। উপস্থিত আরেক বান্ধবী শশুরবাড়ির লোকজনের সাথে কীভাবে চলতে হবে সেই বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। এক মা কাঁদতে কাঁদতে তার মেয়ের সম্ভব্য বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বললেন। তালাকপ্রাপ্তা মেয়ে কীভাবে ঘরে তুলতে কেমন লাগবে সেই অনুভূতির কথাও বললেন।

অন্যরকম একটা রাত! নবদম্পতির জন্য অনেক অনেক দো‘আ আর শুভকামনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের ইতি হলো। মনে আছে, বর-কনে, উভয়ের জন্য আমি আরও বেশি দো‘আ করেছিলাম : ‘হে আল্লাহ! ওদের তুমি একটা স্থায়ী এবং সুস্থ-সুন্দর সম্পর্ক দিয়ে ধন্য করো। আমীন।’ অনুষ্ঠান থেকে গভীর চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ফলে ঘুমিয়ে পড়তে বেশ সমস্যা হলো। ওইরাতে অভিজ্ঞতার পরিহাস আমাকে ভালো মতোই নাড়া দিল।

গত কয়েকমাসের মধ্যেই আমার আশেপাশের অনেক কয়টা সংসার ভেঙ্গে গেছে। আমার জানা মতে, এমন আরও অনেক দম্পতি চূড়ান্ত বিচ্ছদের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বিবাহ বিচ্ছেদ একটি সঠিক এবং অনেক ক্ষেত্রে একটা অপরিহার্য পছন্দ। কিন্তু কী কারনে এত বিপুল সংখ্যক দাম্পত্য জীবনের এত দ্রুত অবসান ঘটছে? প্রতিশ্রুতি এবং দায়িত্ববোধের একটি সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য কী ধরণের পরিবর্তন দরকার?

সেদিন রাতে যতগুলো ঘটনা আমি শুনেছিলাম, তার সবগুলোর সারকথা ছিল একটাই : বিয়ের আগে ওইসব দম্পতির কেউই বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করেননি। তাদের কেউই বিয়ের মতো জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি এবং তাদের অধিকাংশ সমস্যাগুলো এমন সব বিষয় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, বিয়ের পূর্বে যেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। মুসলিম সমাজগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদের উপর একটি সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে, গবেষণায় অংশ নেওয়া তালাকপ্রাপ্ত নারী-পুরুষদের কেউই মসজিদের ইমামের সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ছাড়া, অন্যকোনো বিবাহপূর্ব পরামর্শই গ্রহন করেননি। তাদের অনেকেই বলেছেন, আরও ব্যাপক বিবাহপূর্ব পরামর্শ পেলে এবং বিয়ের পরে সমস্যায় পড়ার সাথে সাথে এধরনের সহজ পরামর্শ পেলে তারা অনেক উপকৃত হতেন। আমাদের সমাজগুলোতে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের অভাব একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।

যখনই কোনো দম্পতির বাগদানের খবর শুনি, আমরা অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের জন্য দৌড়ে যায়। কখনও কি আমরা সময় করে ভেবেছি, সারাজীবনের জন্য একটি সিদ্ধান্ত নিতে ওই নবদম্পতির কী পরিমাণ প্রস্তুতি এবং সহযোগিতার প্রয়োজন? বিয়ের অনুষ্ঠানে হাসিখুশি চেহারায় ছবি তুলতে ব্যস্ত কয়জন নবদম্পতি আসলেই জানে, তারা কোন পথে পা বাড়াচ্ছে? নতুন সম্পর্কের প্রেমোত্তেজনা তাদেরকে প্রায়ই এই বাস্তবতা উপলব্ধিতে অন্ধ করে দেয় যে, তাদের বিয়ে হলো স্রষ্টার সাথে একটি পবিত্র অঙ্গীকার। এই আত্মিক সম্পর্কের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা কি তাৎপর্যপূর্ণ নয়?

বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমরা কত সময়, শ্রম আর অর্থ ব্যয় করি! অথচ খোদ বিয়ের জন্যই কিছু করি না। এমন কেন হয়? বিয়ে অনুষ্ঠানের সামান্য বিষয়টা নিয়েও আমাদের জল্পনা-কল্পনার কমতি থাকে না। অথচ সেই অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের অপরিহার্য উদ্দেশ্য, অন্য একজন মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার “অঙ্গীকার”কে আমরা উপেক্ষা করে যায়। একজন মহিলা আমাকে বলেছিলেন, ‘বিয়ে নিয়ে ভাবার জন্য দু’মাস মাত্র সময় পেয়েছিলাম। প্রেমে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম, তাই অন্যকিছু নিয়ে ভাববার সময় পায়নি।’

অনেক যুগল ভূলবশত মনে করেন, বিয়ের আগে তাদের কোন পরামর্শ গ্রহনের প্রয়োজন নেই, দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে পারলেই সব ঠিক থাকবে। তবে কথা হলো, একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত দ্বন্দ্ব থাকা সুস্থ দাম্পত্যের জন্য জরুরি এবং বিবাহপূর্ব পরামর্শ সম্ভব্য সমস্যা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দেয়।

বিয়ের ব্যাপারে পাকাকথা দেওয়ার আগেই বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করুন।

পরিবার ও বিবাহ বিষয়ক গবেষক, লিসা কিফ্‌ট এর মতে, বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ আপনাকে নিন্মোক্ত ক্ষেত্রে সাহায্য করবে:

১) পারস্পরিক ভূমিকার ব্যাপারে প্রত্যাশাগুলো কেমন, তা আলোচনা করা। একটি দাম্পত্য সম্পর্কে প্রত্যেকের নিজনিজ দায়িত্ব এবং কর্তব্যগুলো নিয়ে কথা বলা জরুরি। যেমন : কে আর্থিক দিকটা সামলাবেন আবার কে বাড়ির কাজগুলো দেখাশোনা করবেন ইত্যাদি। আগেভাগেই প্রত্যেকের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা হলে, পরস্পরের কাছে ভবিষ্যত প্রত্যাশাগুলো সচ্ছ এবং পরিষ্কার হয়ে যায়।

২) পরস্পরের ব্যক্তিগত এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া। গানবাজনা, হিজাব, জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া, কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা ইত্যাদি বিষয়ে দুজনের কার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা জেনে নিন। সময় থাকতেই এসব বিষয়ে আলোচনা করলে আপনারা পরস্পরের জন্য কতটুকু মানানসই, তা বুঝতে পারবেন। এতে করে কীভাবে ভিন্ন মতের মানুষের সাথে মানিয়ে চলতে হবে তা জানা যাবে।

৩) পরস্পরের বংশ এবং পরিবার সম্পর্কে কথা বলা। একটি সম্পর্কের সাথে যতগুলো বিষয় জড়িত থাকে, তার অধিকাংশ সম্পর্কে আমরা আমাদের বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যদের থেকে শিখে থাকি। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রভাবগুলো চিহ্নিত করলে এবং সেসব থেকে অর্জিত আচার-ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করলে বুঝা যায়, দাম্পত্য জীবনে সেগুলো কোন ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে।

৪) পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ান। যে দম্পতির মাঝে যত উন্নতমানের বোঝাপড়া বিদ্যমান, তারা তত কার্যকরভাবে নিজেদের সমস্যার নিরসন করতে পারেন। এতে করে খুব সামান্য সময়ই আপনি তর্কে জড়াবেন এবং অধিকাংশ সময় পরস্পরকে বুঝতে পারবেন।

৫) ব্যাক্তি জীনবের জন্য, দাম্পত্য জীবনের জন্য এবং পারিবারিক জীবনের জন্য লক্ষ্য স্থির করুন। মনে রাখবেন, আপনি অন্য একটা মানুষের সাথে নিজের জীবনটাকে ভাগাভাগি করার অঙ্গীকার করতে যাচ্ছেন। একসাথে থাকা অবস্থায় নিজেদের ভবিষ্যতটা কেমন দেখতে চান, তা আলোচনা করা কি জরুরি নয়? বিয়ে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? কয়টি সন্তান প্রত্যাশা করেন? ভবিষ্যত জীবনের একটা রূপরেখা তৈরি করা পরস্পরকে বুঝার একটা অসাধারণ উপায়। এতে পারস্পরিক অঙ্গীকারগুলো আরও দৃঢ় হয়ে যায়।

বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে দম্পতিরা অনেক মানসিক যন্ত্রণা এবং দ্বন্দ্ব সংঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারেন। সমস্যার সমাধান খোঁজার চেয়ে সমস্যা যেন তৈরিই না হয়, তা নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম মূল বিষয়। কাজেই আমাদের ইমামগণ এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিবাহপূর্ব পরামর্শ এবং শিক্ষা দানের জন্য প্রশিক্ষন গ্রহণ করা দরকার। এটি হবে সুখী দম্পতি এবং সুস্থ দাম্পত্যের ক্ষেত্রে একটি নিশ্চিত লাভজনক বিনিয়োগ।

আপনার অভিমত জানান :

১) আপনি কি সম্ভব্য পাত্র-পাত্রীদের জন্য বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করাকে উপকারী বলে মনে করেন?

২) বিবাহপূর্ব পরামর্শ দানের ক্ষেত্রে আর কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?

৩) কীভাবে সম্ভব্য পাত্র-পাত্রীদেরকে বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যায়?

আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানিয়ে মন্তব্য করুন।

 

Join Pure Matrimony!

শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চাকারী অবিবাহিত মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে আল্লাহ্‌ভীরু জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পেতে সহায়তা করাই “পিওর ম্যাট্রিমনি” ওয়েবসাইটের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন  - http://www.quraneralo.com/purematrimony/

Facebook: http://www.facebook.com/purematrimonybd

মানুষ কষ্ট দিলে মনের ক্ষত সারাবেন যেভাবে

$
0
0

colorful-flowers-wallpaper_422_84115

মূল প্রবন্ধ : ইয়াসমিন মোজাহেদ | ভাষান্তর : মোঃ মুনিমুল হক |  সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

যখন ছোট ছিলাম, পৃথিবীটাকে মনে হতো একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এবং খুব পরিপাটি একটা জায়গা। কিন্তু বড় হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। ভাবতাম সবকিছুই ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ আমার মনে হতো, কারও প্রতি কখনো কোনোরূপ অন্যায় করা যাবে না। কোনো অন্যায় যদি হয়েই যায়, তাহলে সকল ক্ষেত্রেই সুবিচারের জয় হবে। নিজের এই নীতিবোধ অনুযায়ী, সবকিছু যেমনটি হওয়া উচিত তেমনটি ঠিক রাখার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি জীবনে। কিন্তু এই সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের একটি মৌলিক সত্যকে উপেক্ষা করছিলাম আমি। আমার শিশুসুলভ আদর্শবাদের কারণে আমি বুঝতেই পারিনি, সৃষ্টিগতভাবেই এই পার্থিব জগতটা ত্রুটিযুক্ত। ঠিক যেভাবে আমরা মানুষরা সৃষ্টিগতভাবে অপূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত। সবসময় অঘটন আর ঝামেলা লেগেই থাকে আমাদের জীবনে। এসব ঝামেলাই জড়িয়ে, জেনেই হোক, না-জেনেই হোক, ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় হোক, অনিবার্যভাবেই আমরা মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলি। বাস্তব হলো, পৃথিবীটা সবসময় ন্যায়নীতি দিয়ে চলে না।

তার মানে কি এই যে, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই থামিয়ে দেবো, সত্যের পক্ষে হাল ছেড়ে দেবো? অবশ্যই না। এর মানে হলো, আমরা অবশ্যই এই পৃথিবী এবং আর সবকিছুকে কোনো কাল্পনিক বা অবাস্তব মানদণ্ডে বিচার করতে যাবো না। তবে এমনটি না-করাও সহজ না। কীভাবে আমরা এতো ত্রুটিময় এই পৃথিবীতে টিকে থাকবো, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত পরস্পরকে হতাশায় ডুবাচ্ছে, এমনকি নিজ পরিবারের লোকেরাই মনে আঘাত দিয়ে মনটা ভেঙ্গে দিচ্ছে? সবচেয়ে কঠিন বিষয়টি হলো, আমাদের প্রতি কেউ অন্যায় করলে কীভাবে আমরা সেই অপরাধকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে আমরা নিষ্ঠুর না হয়েও দৃঢ় হতে পারি? অথবা কীভাবে দুর্বল না হয়েও মনের কোমলতাকে বজায় রাখতে পারি? কখন আমরা কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে রাখবো? আর কখন সেটিকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবো? কখন বেশি বেশি যত্ন দেখালে তা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়? কারও প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা বলে কি কোনো জিনিস আছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রথমে নিজেরদের জীবনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, আমরাই প্রথম বা শেষ কিনা, যারা কষ্ট এবং অন্যায়ের শিকার। যে মানুষগুলো আমাদের আগে পৃথিবীতে ছিল তাদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তাদের সংগ্রাম এবং তাদের বিজয় নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, কষ্ট ছাড়া কখনোই কোনো অগ্রগতি আসেনি এবং সাফল্যের একমাত্র পথ হলো সংগ্রাম। উপলব্ধি করতে হবে, জীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কষ্টভোগ করা এবং অন্যদের দেওয়া দুঃখকষ্ট এবং ক্ষতিকে জয় করা।

আমাদের নবীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ স্মরণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, দুঃখকষ্ট ভোগ করা শুধু আমাদের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে রাখবেন, নূহ (আ) তাঁর জাতির লোকদের দ্বারা ৯৫০ বছর ধরে অত্যাচারীত হয়েছিলেন। কুরআন আমাদের বলে :

“তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার করেছিল। তারা আমার বান্দাকে অস্বীকার করেছিল এবং এবং বলেছিল, ‘পাগল।’ আর তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।”
[সূরা আল-কামার; ৫৪ : ৯]

নূহের (আ) উপর এত বেশী অত্যাচার করা হয়েছিল যে:

“তিনি তার পালনকর্তাকে ডেকে বললেনঃ আমি পরাভূত, অতএব, তুমি সাহায্য করো।” [আল-কামার; ৫৪ : ১০]

নবীর (সা) কথাই মনে করে দেখুন, কীভাবে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কীভাবে তাঁর সাহাবীদের প্রহার করা হয়েছিল। কীভাবে তারা অনাহারে দিন পার করেছিলেন। অন্য মানুষরাই তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিয়েছিল। এমনকি আমরা অস্তিত্বে আসার পূর্বেই ফেরেশতারা মানুষের এই ধরণের চারিত্রিক দিকটি বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ্‌ যখন বললেন যে, তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, তখন ফেরেশতারা প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিল তা ছিল মানুষের ক্ষতিকর সম্ভাবনা সম্পর্কে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :

“আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেন : ‘নিশ্চয়ই আমি যমিনে একজন খলিফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ্‌ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি যা তোমরা জানো না।’ ” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ৩০]

মানুষ জাতির একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণিত অপরাধ সংঘটনের এই প্রবণতা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। তবে আমাদের অনেকেই অনেক সৌভাগ্যবান। আমাদের অধিকাংশকেই কখনো এমন কোনো দুঃখকষ্টের শিকার হতে হয়নি অন্যরা প্রতিনিয়তই যার শিকার হচ্ছে। আমাদেরকে অনেককেই কোনোদিন নিজের চোখে দেখতে হবে না যে, আমাদের পরিবার পরিজনের কাউকে নির্যাতন করে খুন করা হচ্ছে। তারপরও এমন মানুষ খুব কমই আছে, যারা বলতে পারে, তারা কোনোদিনও কোনোভাবে অন্য কারও দ্বারা কষ্ট পায়নি। সুতরাং, যদিও আমাদের অনেকেই কোনোদিন জানবে না অনাহারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরার কষ্টটা কী; নিজের চোখের সামনে নিজের বাড়িঘর ধ্বংস করতে দেখার অনুভূতিটা কেমন, তথাপি আমার অনেকেই জানি আহত হৃদয়ের কান্নার অনুভূতিটা কেমন।

আচ্ছা, এসব কি এড়ানো সম্ভব? আমার মনে হয়, কিছুটা হলেও সম্ভব। আমরা কখনোই সকল দুঃখকষ্টকে এড়াতে পারব না। তবে আমদের প্রত্যাশা, আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের মনোযোগকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে অনেক ধ্বংসযজ্ঞই এড়ানো সম্ভব।

উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, আমদের আশা, ভরসা, বিশ্বাস — সবকিছুকে অন্য একজন মানুষের উপর সমর্পণ করাটা একেবারেই অবস্তবিক এবং ডাহা বোকামি। আমদের মনে রাখতে হবে, ভুল করা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। তাই আমাদের চূড়ান্ত বিশ্বাস, আস্থা, এবং প্রত্যাশা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পণ করা উচিত। আল্লাহ্‌ বলেন :

“যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ২৫৬]

“আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান এমন মজবুত এক রশি যা ছিন্ন হবার নয়।” — শুধু এই কথাটি যদি আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

একথা বলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, আমরা ভালোবাসবো না বা ভালোবাসলেও কম করে বাসবো। তবে কীভাবে ভালোবাসবো সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকেই বা কোনো কিছুকেই সর্বোচ্চ ভালোবাসা যাবে না। অন্তরে আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কোনো কিছুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। আর আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোনো কিছুকেই এত বেশী ভালোবাসা যাবে না যাতে করে ওই বস্তু ছাড়া জীবন চলা আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ধরনের “ভালোবাসা” ভালোবাসাই নয়। এটা এক ধরনের পূজা করা। এই ভালোবাসায় কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই।

তারপরও যদি কেউ এমন করে ভালোবাসে এবং অন্যের দ্বারা আঘাত বা কষ্ট পায়, তাহলে অনিবার্য পরিণতিটা কী দাঁড়ায়? সবচেয়ে কঠিন কাজটা আমরা কীভাবে করতে পারি? কীভাবে আমরা অন্যকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে মনের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলে, তাদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখব যারা নিজেরাই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না?

আবূ বাক্‌র (রা) এর ঘটনাটি ঠিক এমন পরিস্থিতির একটি চমৎকার উদাহরণ। যখন তাঁর মেয়ে, ‘আয়েশা (রা) সম্পর্কে জঘন্যতম অপবাদ রটানো হলো, তিনি জানতে পারলেন, এই অপবাদটা রটিয়েছিল মিস্‌তাহ্‌ নামে তারই এক চাচাতো ভাই যাকে তিনি বহুদিন ধরে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছিলেন। সঙ্গত কারণেই আবূ বাক্‌র অপবাদ আরোপকারীর সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। সামান্য সময় পরেই আল্লাহ্‌ নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

“আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহ্‌র পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষক্রটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ্‌ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [আন-নূর; ২৪:২২]

এই আয়াত শুনেই আবূ বাক্‌র (রা) বুঝতে পারলেন যে, তিনি নিজেই আল্লাহ্‌র ক্ষমা চান। তাই তিনি শুধু সেই লোককে সাহায্য দেওয়া চালুই করলেন না, এখন আগের চেয়ে বেশি করে দিতে লাগলেন।

মু’মিন হওয়ার মূলেই হলো এইভাবে ক্ষমা করে দেওয়া। এই ধরণের মু’মিনদের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেন :

“আর যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।” [আশ-শূরা; ৪২:৩৭]

‘আমি নিজেও  ভুল করি, অন্যদের কষ্ট দেয়’ — নিজের সম্পর্কে এই ধরণের সচেতনতা বোধ দ্বারা অন্যকে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতাটা উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বিষয়টির মাধ্যমেই আমাদের বিনম্রতা উজ্জীবিত হওয়া উচিত যে, আমারা প্রতিদিন পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি অন্যায় করছি। আল্লাহ্‌র সাথে তুলনা করলে মানুষ তো কিছুই না। তারপরও বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমা করে দিচ্ছেন। তাহলে ক্ষমা না করে মানুষকে বেঁধে রাখার আমরা কে? নিজেরা যদি আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশা করি, তাহলে আমরা অন্যদেরকে ক্ষমা করতে পারি না কেন? আর এ কারণেই নবী (সা) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন :

“যারা অন্যের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ্‌ও তাদের প্রতি দয়া করবেন না।” [মুসলিম; অধ্যায় ৩০, হাদীস নং ৫৭৩৭]

আল্লাহ্‌র দয়া লাভের আশা যেন আমাদের অন্যদের প্রতি দয়া করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং একদিন সেই দুনিয়ার নিয়ে যায় যা বাস্তবিক অর্থেই নিখুঁত, ত্রুটিহীন, পরিপূর্ণ, অনুপম, অতুলনীয়।

দৃষ্টি সংযত রাখার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা

$
0
0

myosotis

ভাষান্তর : হামিদা মুবাশ্‌শিরা | সম্পাদনাআব্‌দ আল-আহাদ

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন,

(হে নবী) আপনি  মু'মিন পুরুষদের বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের  লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্‌  সম্যক অবহিত

(সূরা আন-নূর; ২৪ : ৩০)

অতএব, আল্লাহ্‌ পবিত্রতা ও আত্মিক উন্নয়নকে দৃষ্টি সংযত রাখার এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করার প্রতিদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ নিষিদ্ধ বস্তু থেকে নিজের দৃষ্টি সংযত করার ফলে তিনটি উপকার হয় যেগুলো ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত মূল্যবান।

প্রথমত : ঈমানের মধুরতা আস্বাদন করা

যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র ভয়ে দৃষ্টি সংযত রাখে, তার কাছে ঈমানের সুমিষ্ট মাধুর্য এবং তা থেকে পাওয়া আনন্দ, নিষিদ্ধ বস্তু দেখে পাওয়া আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি মনোহর। বস্তুত, “কেউ যদি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য কোনোকিছু পরিত্যাগ করে, তবে আল্লাহ্‌ আরও উত্তম কিছুর দ্বারা সেটির প্রতিস্থাপন করেন।”

প্রবৃত্তি হলো নিষিদ্ধকাজে প্রলুব্ধকারী এবং সুন্দর অবয়ব দেখতে ভালোবাসে। আর চোখ হলো হৃদয়ের দিশারী। হৃদয় তার দিশারীকে কোথায় কি আছে, তা খুঁজে দেখার দায়িত্ব দিয়ে বলে, ‘যাও! দেখো, কোথায় কী আছে।’ চোখ যখন সুন্দর কোনো দৃশ্যের খবর দেয়, হৃদয়ে তখন তা পাওয়ার জন্য ভালোবাসার শিহরণ এবং আকাঙ্ক্ষা জাগে। হৃদয় এবং চোখের এই অভ্যন্তরীণ দোলাচল উভয়কেই অনবরত ক্লান্ত করে থাকে। যেমনটি বলা হয়েছে :

চোখকে যেদিন দিশারী বানিয়ে করালে সন্ধান

তোমার চোখের লক্ষ্যবস্তু তোমায় করল হয়রান,

এমন কিছু দেখেলে যাতে ছিল না নিয়ন্ত্রণ,

আংশিকও নয়, নয় পুরোপুরিও;

বরং তোমার জন্য উত্তম ছিল ধৈর্যধারণ।

 কাজেই দৃষ্টিকে যখন কোনোকিছু দেখা এবং নিরীক্ষণ করা থেকে সংযত রাখা হয়, হৃদয়ও তখন নিরর্থক অনুসন্ধান আর কামনার মতো ক্লান্তিকর কাজ থেকে বিশ্রাম পায়।

যে ব্যক্তি নিজের দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণের সুযোগ দেবেন, তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে অবিরাম ক্ষতি এবং নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার মাঝে আবিষ্কার করবেন। কারণ দৃষ্টিপাত থেকেই ভালোবাসার (মুহাব্বাহ্‌) জন্ম হয়, যার সূচনা হয় চোখ যা দেখেছে তার প্রতি মোহাবিষ্ট ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ার মাধ্যমে। এই ভালোবাসা ক্রমেই আকুল আকাঙ্ক্ষায় (সাবাবাহ্‌) পরিণত হয়, যার দ্বারা হৃদয় তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অসংশোধনীয় মাত্রায় মোহাবিষ্ট এবং নির্ভরশীল হয়ে যায়। এর মাত্রা বেড়ে ‘আসক্তি’র (গারামাহ্‌) রূপ নেয়। এই আসক্তি এমন এক শক্তি যা আসক্ত ব্যক্তির পেছনে তেমনিভাবে লেগে থাকে, যেভাবে কোনো পাওয়াদার ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণীর পেছনে লেগে থাকে। এই আসক্তি আরও বাড়তে থাকে এবং ‘প্রেমাসক্তি’র (ইশ্‌ক) রূপ নেয় যা সকল প্রকার সীমা ছাড়িয়ে যায়। সবশেষে এর মাত্রা বেড়ে ‘প্রেমোন্মাদনা’র (শাগাফা) জন্ম হয় যা হৃদয়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও বেষ্টন করে ফেলে। এই প্রেমোন্মাদনা ক্রমেই ‘আনুগত্যের ভালোবাসা’য় (তাতাইয়্যুমা) রূপ নেয়। তাতাইয়্যুমা’র অর্থই হলো ইবাদত। যখন বলা হয়, ‘তাইয়্যামা আল্লাহ্‌’, তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, ‘সে আল্লাহ্‌র ইবাদত করেছে।’

 

এভাবেই হৃদয় এমন কিছুর উপাসনা করা শুরু করে, যার উপাসনা করা সমীচীন নয়। আর এসব কিছুর পেছনে একমাত্র কারণ একটি নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত। যে হৃদয় পূর্বে ছিল মনিব, তা এখন শিকলাবদ্ধ; যা ছিল মুক্ত ও স্বাধীন, তা এখন কারারুদ্ধ। এই হৃদয় চোখের দ্বারা নির্যাতিত এবং চোখের আছে অভিযোগ করলে, চোখ এখন বলে : ‘আমি তোমার দিশারী এবং আজ্ঞাবাহক। প্রথমে তুমিই আমাকে পাঠিয়েছিলে।’ এখানে যাকিছু বলা হলো, তার সবই এমন সব হৃদয়ের জন্যই সত্য, যেসব হৃদয় আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা ও একনিষ্ঠতাকে পরিত্যাগ করেছে। কারণ ভালোবাসার জন্য হৃদয়ের এমনকিছু চায়, যার প্রতি হৃদয় নিজেকে নিবেদিত রাখতে পারে। সে কারণেই, হৃদয় যখন শুধুমাত্র আল্লাহ্‌কে ভালোবাসে না এবং শুধু তাঁকেই উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে না, তখন নিশ্চিতভাবে সে অন্যকিছুর উপাসনায় লিপ্ত থাকে। আল্লাহ্‌ ইউসুফ (আ) সম্পর্কে বলেন :

এভাবেই যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট অশ্লীলতা দুর করে দেই। নিশ্চয়ই সে আমার নিষ্ঠাবান বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত

(সূরা ইউসূফ; ১২ : ২৪)

আযীযের স্ত্রী একজন বিবাহতা নারী হওয়া সত্ত্বেও তার হৃদয়ে প্রেমাসক্তি প্রবেশ করেছিল। কারণ সে ছিল মুশরিকা। অন্যদিকে, ইউসুফ (আ) যুবক, অবিবাহিত এবং চাকর হওয়া সত্ত্বেও সেই অপকর্ম থেকে তাঁকে রক্ষা করা হয়েছিল। কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহ্‌র একনিষ্ঠ গোলাম।

দ্বিতীয়ত : আলোকিত হৃদয়, স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি

ইবনু সুজা‘আ আল-কিরমানি বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের বাহ্যিক অবয়বকে সুন্নাহ্‌র আদলে এবং অভ্যন্তরীণ সত্ত্বাকে সর্বদা আল্লাহ্‌র চিন্তা-গবেষণা এবং তাঁর সচেতনতার আলোকে গড়ে তোলে, নিজের আত্মাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা থেকে এবং নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখে, সর্বদা হালাল রুজি ভক্ষণ করে, সেইব্যক্তির উপলব্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টি কখনোই ভুল হবে না।”

আল্লাহ্‌ লূতের (আ) সম্প্রদায়কে কীভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন, সে কথা উল্লেখ করে বলেছেন :

“নিশ্চয়ই এতে ‘মুতাওয়াস্‌সিমীন’দের (স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন) জন্য রয়েছে নিদর্শনমালা

(সূরা আল হিজ্‌র; ১৫:৭৫)

মুতাওয়াস্‌সিমীন হলেন তারাই যারা স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। তারা হারাম বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না এবং অশ্লীল কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকেন।

দৃষ্টি সংযত করা সম্পর্কিত আয়াতের পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ্‌ বলেছেন:

আল্লাহ্‌ আসমানসমুহ যমীনের নূ।...” (সূরা আন-নূর; ২৪:৩৫)

এর কারণ হলো, কর্ম যেমন, কর্মের প্রতিদানও তেমন হয়। অতএব, যে কেউ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখবে, আল্লাহ্‌, আযযা ওয়া জাল্লা, সেইব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ বস্তুকে অনুরূপ অথচ তার চেয়ে অধিক উত্তম বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপন করবেন। তাই বান্দা যেহেতু তার চোখের আলোকে নিষিদ্ধ বস্তুর উপর পড়তে দেয়নি, আল্লাহ্‌ সেই বান্দার দৃষ্টি এবং অন্তরের আলোকে অনুগ্রহ দান করেন। ফলে ব্যক্তি সেইসব বিষয় বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, দৃষ্টি সংযত না করলে যেগুলো বুঝা এবং উপলব্ধি করা তার জন্য সম্ভব হতো না।

ব্যক্তি নিজের মধ্যে এই বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ হৃদয় একটা আয়নার মতো এবং পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো সেই আয়নার উপর মরিচার মতো। এই আয়না যখন সচ্ছ এবং পরিষ্কার থাকে, তখন তাতে বাস্তবতার (হাকাইক) আক্ষরিক প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু যদি তাতে মরিচা পড়ে থাকে, তাহলে তাতে সুষম প্রতিফলন তৈরি হয় না। ফলে হৃদয়ে অনুমান এবং সন্দেহ নির্ভর জ্ঞান ও অভিব্যক্তির উন্মেষ ঘটবে।

তৃতীয়ত : হৃদয় হবে শক্তিশালী, দৃঢ় এবং সাহসী

 

দৃষ্টির আলোর জন্য আল্লাহ্‌ যেভাবে চোখকে সুস্পষ্ট প্রমাণের সহায়ক শক্তি দিয়েছেন, হৃদয়ের দৃঢ়তার জন্যও তিনি হৃদয়কে সহায়ক শক্তি দান করবেন। এভাবে হৃদয়ে দুধরণের উপাদনের সমন্বয় ঘটবে। ফলে হৃদয় থেকে শয়তান বিতাড়িত হবে। হাদীসে উল্লেখ আছে, “কেউ যদি নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির বিরোধিতা করে, ভয়ে শয়তান তার ছায়া থেকেও পালিয়ে বেড়ায়।”

একারণেই যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে নিজের মাঝে গ্লানিময় আত্মাকে খুঁজে পায় — যে আত্মা দুর্বল, শক্তিহীন, ঘৃণার যোগ্য। বস্তুত, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে মান্য করেন, আল্লাহ্‌ তার জন্য উচ্চমর্যাদা নির্ধারণ করেন। আর তাঁকে অমান্যকারীর জন্য আল্লাহ্‌ লাঞ্ছনা নির্ধারণ করেন:

“আর তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত  হয়ো না, আর তোমরা বিজয়ী হবে, যদি মু’মিন হয়ে থাকো

(সূরা আল–ইমরান; ৩:১৩৯)

“কেউ যদি সম্মান চায় (তবে তা যেন আল্লাহ্‌র কাছেই চায়), কেননা সকল সম্মান আল্লাহ্‌রই।”

(সূরা ফাতির; ৩৫:১০)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র (আয্‌যা ওয়া জাল্লা) চেয়ে অবাধ্যতা এবং পাপকর্মকেই বেশি প্রাধান্য দেবে, আল্লাহ্‌ সেই বিরুদ্ধাচরণকারীকে লাঞ্ছিত করবেন। সালাফদের অনেকেই বলেছেন, “সম্মানের খোঁজে মানুষ রাজাদের দ্বারে যায়। অথচ আল্লাহ্‌র আনুগত্য ছাড়া কোনো সম্মান নেই।” কারণ যারা আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে, তারা আল্লাহ্‌কে নিজেদের বন্ধু এবং রক্ষাকারী হিসেবে গ্রহণ করে। আর যারা আল্লাহ্‌কে তাদের রব এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহ্‌ কখনোই তাদেরকে অসম্মানিত করেন না। একটি দো‘আ কুনূতে এ কথাগুলোই বলা হয়েছে: “যাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে অপমানিত হয় না আর যাকে আপনি শত্রু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে সম্মানিত হয় না।”

(সূত্র : শায়েখ ইবনুল কায়্যিম, আল-মুন্‌তাকা মিন ইক্‌হাসাতুল লুফ্‌হান ফী মাসায়্যিদ আশ-শায়তান, পৃষ্ঠা ১০২-১০৫। পরিমার্জন : আলি হাসান।)

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবদান

$
0
0

hands

অনুবাদঃ ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী | সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ভূমিকা:

মানবাধিকার বলতে বুঝায় মহান আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত মানুষের সহজাত অধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যদিও মানবাধিকারের মানদন্ড, সমাজভেদে এর সংজ্ঞা, প্রয়োগ ও সীমারেখা নিয়ে তৈরী হচ্ছে নানা বিতর্ক। প্রাসঙ্গিকভাবেই জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকারের বিষয়টিও সে সব আলোচনা সমালোচনায় উঠে আসছে। মানবাধিকার রক্ষায় বিশ্বের শক্তিধর রাষ্টসমূহের গৃহীত পদক্ষেপ মানুষের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক নাকি অধিকার হরণের কৌশল তা নিয়েও বিশ্বব্যাপী চলছে ব্যাপক আলোচনা।

এমনি প্রেক্ষাপটে আমরা যদি সপ্তম ঈসায়ী শতাব্দির শুরুতে ফিরে যাই, তাহলে দেখা পাব এক অনুপম মহামানবের, যিনি নর-নারী তথা সকল মানবের প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্ববাসীর সামনে হাযির করেছিলেন মানবাধিকারের সার্বজনীন রূপরেখা। তিনি হলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তিনি হলেন জগতের সবার জন্য Role-Model ও উসওয়ায়ে হাসানাহ। Practical Teachings এর মাধ্যমে তিনি সর্বক্ষেত্রে চমৎকার সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, তাঁর দেয়া ফর্মুলাই জগতকে দিতে পারে শান্তি, সফলতা ও মুক্তি। তাঁর পূর্বযুগে যত অজ্ঞতা ছিল, বর্বরতা ছিল, যত নির্যাতন ও শোষণ ছিল, সন্ত্রাস, ভয়-ভীতি ও সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণী বিদ্বেষ ছিল, সবই তাঁর মহান আদর্শের পরশ পাথরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।

সমকালীন বিশ্বে মানুষের সার্বজনীন অধিকার প্রতিষ্ঠায় ওহীর নির্দেশনায় তাঁর প্রবর্তিত নীতি-দর্শন ও দিক-নির্দেশনার প্রয়োগ কেবল গ্রহণযোগ্য বা প্রয়োগ উপযোগীই নয়, বরং তা একান্ত আবশ্যক। এ প্রবন্ধে আমরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এ মহামানবের অবদানের প্রধানতম দিকগুলো তুলে ধরব।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির অনেক আগ থেকে তাঁর উত্তম চরিত্র ও মানবিক গুণাবলীর জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকরা যে সময়কে ‘জাহেলিয়াতের বা অন্ধকার যুগ’ বলেছেন সেই সময়ে জন্মলাভ করেও ঝগড়া-বিবাদ, নরহত্যা, সম্পদ লুন্ঠন, ব্যভিচার ইত্যাদি অকল্যাণকর, মানবতার জন্যে চরম অবমাননাকর কাণ্ডে তিনি কখনো জড়িত হন নি। অথচ তখনকার সমাজে যে কোনো যুবকের জন্যে তা ছিল স্বাভাবিক। বরং তিনি ছিলেন এতিম, অসহায়, নির্যাতিতদের একমাত্র সহায়, সান্ত্বনাদানকারী, ধন-সম্পদের আমানত রক্ষাকারী এবং অনেকের আশ্রয়দাতা। চুরি-ডাকাতির ভয়ে ভীত, আতঙ্কিত মানুষ তাঁর কাছে হাজির হয়ে তাদের মূল্যবান সম্পদ আমানত রেখে যেত, আর তিনি সেই আমানতের যথাযত হেফাযত করতেন এবং যথারীতি তা ফেরত দিতেন। এভাবে নবুওয়ত লাভের অনেক আগেই আরববাসী তাকে ‘আল-আমীন’ বা ‘পরম বিশ্বস্ত’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। নবুওয়াতের পাঁচ বছর আগে পবিত্র কাবা শরীফ মেরামতকালে সেখানকার কালো পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্বস্থানে তুলে নেয়ার ব্যাপারে কলহ-দ্বন্দের সূত্রপাত হয় এবং প্রত্যেক গোত্রই এই কাজ করে মর্যাদা লাভের প্রতিযোগিতায় যুদ্ধোন্মুখ হয়ে পড়ে, তখন সেই গুরুতর সমস্যার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এমন একটি সমাধান দেন; যাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মর্যাদাই রক্ষিত হয়েছিল। সকলেই সন্তুষ্টচিত্তে সে ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল, আর তা ছিল একটি চাদরের মাঝখানে পাথরটি রেখে গোত্রপতিদের দিয়ে চাদরটি ধরে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া ও সবশেষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজ হাতে সেটিকে প্রতিস্থাপন করা।

সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার এই উদাহরণ তাঁর জীবনের শুরু থেকেই আজীবন নানাভাবে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন তিনি গোটা আরব জাহানের নেতা হয়ে উঠলেন তখন তিনি কি সমাজ জীবনে, কি পারিবারিক জীবনে, কি রাষ্ট্রীয় তথা নাগরিক জীবনে, কি বিশ্ব নাগরিক হিসাবে, সর্বক্ষেত্রে মানুষের মূল্য-মর্যাদা ও মানবাধিকারের যে সার্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল, অভূতপূর্ব। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি-দর্শনের কয়েকটি দিকের উপর আলোকপাত করেলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

মানুষের বেঁচে থাকার ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের জীবনের অধিকার ও জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। নরহত্যা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল সেখানে নরহত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন,

সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বানানো এবং মানুষকে হত্যা করা…..।[1]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

কোনো মু‘আহাদকে (মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানরত চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে) হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। যদিও জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছর দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়।[2]

বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে (যাকে মানবাধিকারের আদি সনদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষকে সম্বোধন করে বলেছেন,

নিশ্চয়ই তোমাদের পরস্পরের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম তোমাদের (অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে) পবিত্র, যেরূপ তোমাদের এই দিন পবিত্র তোমাদের এ মাসে তোমাদের এ শহরে।[3]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং আত্মহত্যাকারী তার নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেওয়ার শাস্তি হিসেবে আখেরাতে আত্মহত্যার অনুরূপ পন্থায় শাস্তিভোগ করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।[4]

জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগে, বিশেষত আরবদের নবজাতক বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্মলাভের পরপরই দারিদ্রের ভয়ে হত্যা বা জীবন্ত প্রোথিত করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসলামী সমাজে শিশু হত্যার এ জঘন্য প্রবণতাকে দণ্ডযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে পবিত্র কুরআনের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে[5] শিশুদের জীবনের অধিকার ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা হয়।

বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন দর্শনে সমাজের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তিকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। ইসলামে বিবাহ সমভাবে একটি অধিকার ও ধর্মীয় দায়িত্ব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আর আমি নারীদের বিবাহ করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাহ্ থেকে বিমুখ হল সে আমার আদর্শভুক্ত নয়।[6]

প্রকৃতপক্ষে ইসলামে ‘বিবাহ’ কেবলমাত্র জৈবিক চাহিদা পূরণের পন্থাই নয়, বরং পারস্পরিক ভালবাসা, সমঝোতা, সমবেদনা ও নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত বিবাহ ব্যবস্থা এমন একটি সামাজিক চুক্তি যাতে নারী ও পুরুষ উভয়ের সম্মত বা অসম্মত হবার সমান অধিকার স্বীকৃত। বিবাহের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনকে ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেহেতু স্বামী-স্ত্রীই হল পরিবারের মূল ভিত্তি এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের উপরই প্রাথমিকভাবে পারিবারিক জীবনের শান্তি ও সুখ নির্ভর করে, তাই পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে, এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে  কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে:

তাঁরা (স্ত্রীগণ) হবে তোমাদের (স্বামীদের) ভূষণ আর তোমরা (স্বামীগণ) তাদের (স্ত্রীদের) ভূষণ।[7]

সম্পত্তির মালিকানার অধিকার

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তিত ইসলামী অর্থব্যবস্থা সমাজতন্ত্রবাদ বা পুঁজিবাদ কোনটিকেই পুরোপুরি সমর্থন করে না বরং তা একটি কল্যাণ রাষ্ট্রীয় ধারণাকে সমর্থন করে। এখানে ব্যক্তির জন্য সম্পত্তির অপ্রকৃত মালিকানা স্বীকৃত। তবে তা এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে, ব্যক্তি এখানে সম্পদ উপর্জনের লাগামহীন স্বাধীনতা লাভ করে না। ইসলামী সমাজের সকল সম্পদের প্রকৃত মালিকানা আল্লাহর। মানুষ দায়িত্বপ্রাপ্ত (trustee) হিসাবে এর অর্জন, ভোগ ও বণ্টনের অধিকার লাভ করে। আল-কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে,

তাদের সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।[8]

দান, খয়রাত, সদকা, যাকাত, ফিতরা প্রভৃতির মাধ্যমে বর্ধিত সম্পদের বিলি-বন্টন করে ইসলামে একটি ভারসাম্যপূর্ণ  অর্থনৈতিক অবস্থার কথাই কেবল বলা হয় নি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে কার্যকরভাবে তা প্রতিষ্ঠাও করেছেন।

স্বাধীনভাবে চলাচল, বসবাস, রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব লাভের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে স্বাধীনভাবে চলাচল ও বসবাসের অধিকার প্রদান করে। একই ভাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বাইরে যাওয়া ও অন্য রাষ্ট্রে বসবাসের অধিকারও প্রতিটি ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে একটি ‘বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা’ ধারণায় বিশ্বাসী ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী সমগ্র বিশ্ব আল্লাহর রাজত্বস্বরূপ- যা তিনি সকল মানুষের চলাচল ও বসবাসের জন্যে অবারিত করে দিয়েছেন।

নিপীড়ন-নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তি লাভের অধিকার

শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক-মানসিক শাস্তিদান বা তাকে কষ্ট দেওয়াকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন,

প্রকৃত মুসলিম হচ্ছে সে ব্যক্তি, যার কথা বা হাত (কাজের নিপীড়ন) থেকে মুসলিমগণ নিরাপদে থাকেন।[9]

এমনকি এক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত দৃঢ় ভাষায় তিনি বলেছেন,

যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের উপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার উপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিযিয়া বা প্রতিরক্ষা কর) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষাবলম্বন করব।’’[10]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো অপরাধের জন্য অন্যকে দণ্ড দেওয়ার যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রেওয়াজও চিরতরে রহিত করে দেন। বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক অভিভাষণে তিনি বলেন,

জেনে রাখ, কারো অপরাধের জন্য তারা নিজেকেই দণ্ড বহন করতে হবে। সুতরাং পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধে জন্য পিতাকে দায়ী করা যাবে না।[11]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষণার মূলে ছিল কুরআনের সেই বাণী,

প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী।[12]

প্রতিটি ব্যক্তি যা অর্জন করে তা শুধু তারই উপর বর্তায়, আর কেউ অন্যের বোঝা বহন করে না।[13]

অবাধ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে ন্যায়বিচার লাভের অধিকার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক-সামাজিক পেশাগত মর্যাদা নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করে। মূলত ন্যায়বিচার ধারণার উপর ইসলামে এতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, কুরআনে প্রায় ষাটটি আয়াতে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন একটি আয়াতে বলা হয়েছে,

হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে, যদিও তা তোমাদের নিজদের  কিংবা পিতা-মাতার অথবা নিকট আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।[14]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খিলাফতের শাসনামলে ইসলামে বিচার ব্যবস্থা যা শাসক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপমুক্ত, স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে, তা ছিল মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানবতাবোধ ও মানবাধিকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত।

শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায়

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট ভাষায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন যে,

আমি তোমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্যে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।[15]

কুরআনের এ বাণী পরিপূর্ণভাবে সত্যে পরিণত করেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র মানব জাতির ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অনন্য সাধারণ উদাহরণ রেখে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজো অদ্বিতীয় এবং সর্বজনস্বীকৃত অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পরিগণিত। কেননা তিনি কেবল মুসলিমদের আদর্শ ছিলেন না, ছিলেন গোটা মানব জাতির আদর্শ। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এই মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন,

বলুন (হে নবী), হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসূল।[16]

দয়া, ক্ষমা ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায়

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, ক্ষমাশীল ও কোমল। দয়া, ক্ষমা, শান্তি ও সাম্যের প্রতিরূপ এই মহামানব স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন,

যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দয়া করেন না।[17]

এখানে কেবল মুসলিমদের কথাই নয় বরং গোটা মানব জাতির কথা বলা হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। অন্য একটি হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

যমীনে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া করা, তাহলে উর্ধ্বালোকে যিনি আছেন তিনি তোমার প্রতি সদয় হবেন।[18]

অন্যদিকে শ্রমিক অধীনস্থ কর্মচারী ও চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা, তাদেরকে নিজেদের অনুরূপ খাওয়া-দাওয়া প্রদান, পোশাক-আশাক দেওয়া ও বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেও তিনি বারংবার তাগিদ দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমিকদের সব প্রকার বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন আর গ্লানির অবসান করে এমন সব শ্রমনীতির প্রবর্তন করে গেছেন যার সিকি শতাংশও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আই.এল.ও) বিগত ১১৮ বছর ধরে মে দিবস উদযাপনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি।

তাঁর এই গুণাবলী ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মুগ্ধ বিখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যিক জর্জ বার্ণাড শ’ তাই বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি,

“If all the world was united under one leader, Mohammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness.”

নারী অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়

নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। নারী মুক্তির প্রবক্তা হিসাবে আমরা হয়ত কেট মিলে (Kate Millet), জার্মেন গ্রীয়ার (Germaine Greer) বা অ্যানী নূরাকীন (Anee Nurakin) প্রমুখের নাম জানি; এক্ষেত্রে আরো উল্লেখ করা হয় মেরী উলস্টন, অ্যানী বেসামন্ত, মার্গারেট সাঙ্গাঁর, সুলতানা রাজিয়া, বেগম সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ মহিলাদের সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য যে ব্যক্তি প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠেন, নারীকে সংসার ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অংশ হিসাবে যে ব্যক্তি প্রথম স্বীকৃতি দেন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অধিকার পরিপূর্ণ আকারে যে ব্যক্তি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন, সত্যিকার অর্থে যিনি নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির প্রবক্তা, তিনি হচ্ছেন ‘একজন পুরুষ’ এবং তিনি আর কেউ নন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একথা আদৌ অত্যুক্তি হবে না যে, জীবনে অন্য কিছু না করলেও শুধুমাত্র নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানই বিশ্ব মনীষায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুউচ্চ আসনে সুদৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠিত করবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম পদক্ষেপ ছিল কন্যা শিশু হত্যা বন্ধ করা। তিনি বরং কন্যা শিশুর লালন-পালনকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং নিজেও তাঁর কন্যাদের লালন-পালন কালে সেটা করে দেখিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন,

(পুরুষদের জন্যে) দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামত হচ্ছে উত্তম স্ত্রী।’’[19]

অন্যদিকে নারীকে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মর্যাদার অধিকারী করেছেন। হাদীসে এসেছে,

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের মধ্যে কে আমার কাছে সর্বোত্তম সম্মান, মর্যাদা ও সদ্ব্যবহার পাবার যোগ্য? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী আবারো জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার বাবা।[20]

নারী মুক্তির দিশারী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে শুধু বাঁচিয়ে রেখে মর্যাদা দিয়েই ক্ষান্ত হন নি, তিনি নারীকে যথাযথ অধিকার দিয়ে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারীকে তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, আইনগত এবং ধর্মীয় সব দিক দিয়ে তার অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তসমূহকে সংক্ষেপে এভাবে উল্লেখ করা যায় :

  • ক. নারীকে পিতার সম্পত্তিতে, স্বামী, সন্তান ও মায়ের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী ধার্য করা হয়েছে।
  • খ. বিয়ের সময় নারীকে মোহরানা বা দেনমোহর প্রাপ্তি আবশ্যিক করেছেন এবং তা আদায় না করার বা তা থেকে জোর করে ব্যয় করার অধিকার স্বামী, পিতা বা ভাই কাউকে দেওয়া হয় নি।
  • গ. নারীকে স্বামী নির্বাচনের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোথাও বিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে একজন অকর্মন্য, অত্যাচারী স্বামী থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের পূর্ণ অধিকার নারীকে দেওয়া হয়েছে। একই সাথে বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা নারীকে ২য় বিবাহের বা পুনঃবিবাহের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
  • ঘ. দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি তিনি।
  • ঙ. বিদ্যাশিক্ষা করা বা জ্ঞানার্জন করার ব্যাপারে নারীকে পুরুষের মতই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম (নরনারী) এর উপর ফরয বা অবশ্য কর্তব্য’’।
  • চ. অত্যাচার, অপমান, অশালীনতা ও অবমাননা থেকে নারীকে রক্ষার জন্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের পোশাক পরিধানে ও জনসমক্ষে চলাফেরার সময় একটি অনুসরণীয় পোষাক-বিধি (Dress Code) মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।

উপসংহার

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জীবনদর্শন, মানবিক মর্যাদার রূপরেখা, মানবাধিকারের পরিধি ও সীমা নির্দিষ্ট করেছেন তা মহান আল্লাহ তা‘আলারই অনুমোদিত জীবন বিধান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই জীবন বিধান যা মানবাধিকারের প্রথম মৌলিক এবং পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা হিসাবে স্বীকৃত তা কেবল কোনো দলীল লিখিত নয়, কোনো স্বাক্ষরিত চুক্তি নয়, কোনো অনুকল্প নয় (hypothesis) , বরং তা হচ্ছে কঠোর বাস্তবতা। নিজের শৈশব থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ৬৩ বছরের প্রত্যক্ষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত রেখে নিজের জীবদ্দশাতেই একটি ধ্বংসস্তুপ থেকে, একটি পুঁতিগন্ধময় অন্ধকার আস্তাকুড় থেকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবিক মুল্যবোধকে তুলে এনে এক সুষম, অনুসরণযোগ্য, সার্বজনীন কল্যাণকর সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন – মানবাধিকার, মানুষের মর্যাদা ও আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যই ছিল যার ভিত্তি।

মানবতার মুক্তিদূত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে এই অর্জন, এই স্পষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য কল্যাণকর জীবন বিধান বিশ্বের অনেক গবেষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। মাইকেল হার্ট ‘দ্য হানড্রেড’ গ্রন্থে একশ জন ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্বের ক্রম-বিন্যাস করেছেন। তালিকার প্রথমেই (অর্থাৎ ১ নম্বরে) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দ্বিধায় দাঁড় করিয়ে তিনি লিখেছেন:

“My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some readers and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both religious and secular levels.”[21]

নির্দ্বিধায় তাই বলা যায়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।


[1] আল্-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৮৭১।

[2] আল্-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৬৬।

[3] আল্-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৭, ১০৫, ১৭৩৯।

[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৫১-১২৫৩।

[5] কুরআনে বলা হয়েছে, ‘‘দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানকে হত্যা করো না, তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা এ জঘন্য অপরাধ’’। সূরা আল-ইসরা/বনী ইসরাইল: ৩১।

[6] আল হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৬৩।

[7]  সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৭।

[8] সূরা আল-মা’আরিজ: ২৪-২৫।

[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪৮৪।

[10] আল-বায়হাকী, মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং ৫৭৫০।

[11] আল-হাদীস, সুনান ইবনু মাজা, হাদীস নং ২৬৬৯ ও সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২১৫৯।

[12] সূরা আত-তূর: ২১।

[13] সূরা আল-আন‘আম : ১৬৪।

[14] সূরা আন-নিসা: ১৩৫।

[15] সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭।

[16] সূরা আল-‘আরাফ: ১৫৮।

[17] হাদীস নং ৭৩৭৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬১৭২।

[18] সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ৪৯৪৩, সুনান আত-তিরমিযি, হাদীস নং ১৯২৪।
[19] মুসলিম, ১৪৬৭।
[20] আল-হাদীস, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৯৭১।

[21] প্রাগুক্ত, পৃ.৫৫।

ইসলামের দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ

$
0
0

লেখক : ইঞ্জিনিয়ার মো: এনামুল হক | সম্পাদক : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া - মো: আব্দুল কাদের

ভূমিকা

নববর্ষ বা New Year’s day – এই শব্দগুলো নতুন বছরের আগমন এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব-অনুষ্ঠানাদিকে ইঙ্গিত করে। এতদুপলক্ষে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, হাসিঠাট্টা ও আনন্দ উপভোগ, সাজগোজ করে নারীদের অবাধ বিচরণ ও সৌন্দর্যের প্রদর্শনী, রাতে অভিজাত এলাকার ক্লাব ইত্যাদিতে মদ্যপান তথা নাচানাচি, পটকা ফুটানো – এই সবকিছু কতটা ইসলাম সম্মত? ৮৭ ভাগ মুসলিম যে আল্লাহতে বিশ্বাসী, সেই আল্লাহ কি মুসলিমদের এইসকল আচরণে আনন্দ-আপ্লুত হন, না ক্রোধান্বিত হন ? নববর্ষকে সামনে রেখে এই নিবন্ধে এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে ।

 

ইসলাম ধর্মে উৎসবের রূপরেখা

অনেকে উপলব্ধি না করলেও, উৎসব সাধারণত একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়। উৎসবের উপলক্ষগুলো খোঁজ করলে পাওয়া যাবে উৎসব পালনকারী জাতির ধমনীতে প্রবাহিত ধর্মীয় অনুভূতি, সংস্কার ও ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া। উদাহরণস্বরূপ, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন তাদের বিশ্বাসমতে স্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন।

মধ্যযুগে ইউরোপীয় দেশগুলোতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হত ২৫শে মার্চ, এবং তা পালনের উপলক্ষ ছিল এই যে, ঐ দিন খ্রীস্টীয় মতবাদ অনুযায়ী মাতা মেরীর নিকট ঐশী বাণী প্রেরিত হয় এই মর্মে যে, মেরী ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সূচনার পর রোমক ক্যাথলিক দেশগুলো পয়লা জানুয়ারী নববর্ষ উদযাপন করা আরম্ভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এই দিনটি একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হত। ইহুদীদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদীদের ধর্মীয় পবিত্র দিন সাবাত হিসেবে পালিত হয়। এমনিভাবে প্রায় সকল জাতির উৎসব-উপলক্ষের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তা-ধারা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এজন্যই ইসলাম ধর্মে নবী মুহাম্মাদ (সা.) পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের উৎসবকে নির্ধারণ করেছেন, ফলে অন্যদের উৎসব মুসলিমদের সংস্কৃতিতে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

“প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।” [বুখারী, মুসলিম]

বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইমাম ইবনে তাইমিয়া এ সম্পর্কে বলেন:

“উৎসব-অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধান, সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই একটি অংশ, যা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ [আল-মায়িদাহ :৪৮]

‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি ধর্মীয় উপলক্ষ নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যা তাদেরকে পালন করতে হয়।’ [আল-হাজ্জ্ব :৬৭]

যেমনটি কিবলাহ, সালাত এবং সাওম ইত্যাদি। সেজন্য তাদের [অমুসলিমদের] উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া আর তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই উৎসব-অনুষ্ঠানের সাথে একমত পোষণ করা অর্থ কুফরের সাথে একমত পোষণ করা। আর এসবের একাংশের সাথে একমত পোষণ করা অর্থ কুফরের শাখাবিশেষের সাথে একমত হওয়া। উৎসব-অনুষ্ঠানাদি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যার দ্বারা ধর্মগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়।…নিঃসন্দেহে তাদের সাথে এসব অনুষ্ঠান পালনে যোগ দেয়া একজনকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর বাহ্যিকভাবে এগুলোতে অংশ নেয়া নিঃসন্দেহে পাপ। উৎসব অনুষ্ঠান যে প্রতিটি জাতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, এর প্রতি রাসূলুল্লাহ(সা.) ইঙ্গিত করেছেন, যখন তিনি বলেন:

‘প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।’ [বুখারী, মুসলিম]

এছাড়া আনাস ইবনে মালিক(রা.) বর্ণিত:

 

“রাসূলুল্লাহ(সা.) যখন [মদীনায়] আসলেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি(সা.) বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কি?’ তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূলুল্লাহ(সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে এদের পরিবর্তে উত্তম কিছু দিয়েছেন: ইয়াওমুদ্দুহা ও ইয়াওমুল ফিতর ।’ ” [সূনান আবু দাউদ]

এ হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম আগমনের পর ইসলাম বহির্ভূত সকল উৎসবকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য দুটো দিনকে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে অমুসলিমদের অনুসরণে যাবতীয় উৎসব পালনের পথকে বন্ধ করা হয়েছে।

ইসলামের এই যে উৎসব – ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা – এগুলো থেকে মুসলিম ও অমুসলিমদের উৎসবের মূলনীতিগত একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য স্পষ্ট হয়, এবং এই বিষয়টি আমাদের খুব গুরুত্বসহকারে লক্ষ্য করা উচিৎ, যা হচ্ছে:

অমুসলিম, কাফির কিংবা মুশরিকদের উৎসবের দিনগুলো হচ্ছে তাদের জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দিন, এদিনে তারা নৈতিকতার সকল বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, আর এই কর্মকান্ডের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান ও ব্যভিচার। এমনকি খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের বহুলোক তাদের পবিত্র বড়দিনেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে মদ্যপ হয়ে ওঠে, এবং পশ্চিমা বিশ্বে এই রাত্রিতে কিছু লোক নিহত হয় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ী চালানোর কারণে।

অপরদিকে মুসলিমদের উৎসব হচ্ছে ইবাদতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই বিষয়টি বুঝতে হলে ইসলামের সার্বিকতাকে বুঝতে হবে। ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং তা মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী হয়। তাই একজন মুসলিমের জন্য জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত, যেমনটি কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন:


“আমি জ্বিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোন কারণে সৃষ্টি করিনি।” [সূরা যারিয়াত:৫৬]

 

সেজন্য মুসলিম জীবনের আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়, বরং তা নিহিত হচ্ছে আল্লাহর দেয়া আদেশ পালন করতে পারার মাঝে, কেননা মুসলিমের ভোগবিলাসের স্থান ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী নয়, বরং চিরস্থায়ী জান্নাত। তাই মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের ঈমান, আখিরাতের প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালবাসা ।

তাইতো দেখা যায় যে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা – এ দুটো উৎসবই নির্ধারণ করা হয়েছে ইসলামের দুটি স্তম্ভ পালন সম্পন্ন করার প্রাক্কালে। ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ সাওম পালনের পর পরই মুসলিমরা পালন করে ঈদুল ফিতর, কেননা এই দিনটি আল্লাহর আদেশ পালনের পর আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার ও ক্ষমার ঘোষণা পাওয়ার দিন বিধায় এটি সাওম পালনকারীর জন্য বাস্তবিকই উৎসবের দিন – এদিন এজন্য উৎসবের নয় যে এদিনে আল্লাহর দেয়া আদেশ নিষেধ কিছুটা শিথিল হতে পারে, যেমনটি বহু মুসলিমদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা এই দিনে আল্লাহর আদেশ নিষেধ ভুলে গিয়ে অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, বরং মুসলিমের জীবনে এমন একটি মুহূর্তও নেই, যে মুহূর্তে তার ওপর আল্লাহর আদেশ নিষেধ শিথিলযোগ্য। তেমনিভাবে ঈদুল আযহা পালিত হয় ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হাজ্জ পালনের প্রাক্কালে। কেননা ৯ই জিলহজ্জ হচ্ছে ইয়াওমুল আরাফা, এদিনটি আরাফাতের ময়দানে হাজীদের ক্ষমা লাভের দিন, আর তাই ১০ই জিলহজ্জ হচ্ছে আনন্দের দিন – ঈদুল আযহা। এমনিভাবে মুসলিমদের উৎসবের এ দুটো দিন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করার দিন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন এবং শরীয়তসম্মত বৈধ আনন্দ উপভোগের দিন – এই উৎসব মুসলিমদের ঈমানের চেতনার সাথে একই সূত্রে গাঁথা।

 

নতুন বছরের সাথে মানুষের কল্যাণের সম্পর্ক

নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি – এধরনের কোন তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পুজারী মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোন স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখন্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের প্রথম দিনের কোন বিশেষ তাৎপর্য নেই। আর তাই তো ইসলামে হিজরী নববর্ষ পালনের কোন প্রকার নির্দেশ দেয়া হয়নি। না কুরআনে এর কোন নির্দেশ এসেছে, না হাদীসে এর প্রতি কোন উৎসাহ দেয়া হয়েছে, না সাহাবীগণ এরূপ কোন উপলক্ষ পালন করেছেন। এমনকি পয়লা মু্হাররামকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবীজীর(সা.) মৃত্যুর বহু পরে, উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা.) আমলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, নববর্ষ ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যহীন, এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই, আর সেক্ষেত্রে ইংরেজি বা অন্য কোন নববর্ষের কিই বা তাৎপর্য থাকতে পারে ইসলামে?

কেউ যদি এই ধারণা পোষণ করে যে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোন সম্পর্ক রয়েছে, তবে সে শিরকে লিপ্ত হল, অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করল। যদি সে মনে করে যে আল্লাহ এই উপলক্ষের দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন, তবে সে ছোট শিরকে লিপ্ত হল। আর কেউ যদি মনে করে যে নববর্ষের আগমনের এই ক্ষণটি নিজে থেকেই কোন কল্যাণের অধিকারী, তবে সে বড় শিরকে লিপ্ত হল, যা তাকে ইসলামের গন্ডীর বাইরে নিয়ে গেল। আর এই শিরক এমন অপরাধ যে, শিরকের ওপর কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে চিরতরে হারাম করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন:

“নিশ্চয়ই যে কেউই আল্লাহর অংশীদার স্থির করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, আর তার বাসস্থান হবে অগ্নি। এবং যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” [সূরা মায়িদাহ :৭২]

নববর্ষ উদযাপনের সাথে মঙ্গলময়তার এই ধারণার সম্পর্ক রয়েছে বলে কোন কোন সূত্রে দাবী করা হয় , যা কিনা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। মুসলিমদেরকে এ ধরনের কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে ইসলামের যে মূলতত্ত্ব: সেই তাওহীদ বা একত্ববাদের ওপর পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

নববর্ষের অনুষ্ঠানাদি: শয়তানের পুরোনো কূটচালের নবায়ন

আমাদের সমাজে নববর্ষ যারা পালন করে, তারা কি ধরনের অনুষ্ঠান সেখানে পালন করে, আর সেগুলো সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য কি? নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে: পটকা ফুটিয়ে বা আতশবাজি পুড়িয়ে রাত ১২টায় হৈ হুল্লোড় করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের শান্তি বিনষ্ট করে নববর্ষকে স্বাগত জানানো, ব্যান্ড সঙ্গীত বা অন্যান্য গান-বাজনার ব্যবস্থা, সম্ভ্রান্ত পল্লীর বাড়ীতে বা ক্লাবে গান-বাজনা, মদ্যপান ও পান শেষে ব্যভিচারের আয়োজন ইত্যাদি – এছাড়া রেডিও টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান ও পত্রপত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র ও “রাশিফল” প্রকাশ।

এবারে এ সকল অনুষ্ঠানাদিতে অনুষ্ঠিত মূল কর্মকান্ড এবং ইসলামে এগুলোর অবস্থান সম্পর্কে পর্যালোচনা করা যাক:

নতুন দিন তথা সূর্যকে স্বাগত জানানো:

এ ধরনের কর্মকান্ড মূলত সূর্য-পূজারী ও প্রকৃতি-পূজারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুকরণ মাত্র, যা আধুনিক মানুষের দৃষ্টিতে পুনরায় শোভনীয় হয়ে উঠেছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকেরই ধর্মের নাম শোনামাত্র গাত্রদাহ সৃষ্টি হলেও প্রকৃতি-পূজারী আদিম ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নকল করতে তাদের অন্তরে অসাধারণ পুলক অনুভূত হয়। সূর্য ও প্রকৃতির পূজা বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন জাতির লোকেরা করে এসেছে। যেমন খ্রীস্টপূর্ব ১৪ শতকে মিশরীয় “অ্যাটোনিসম” মতবাদে সূর্যের উপাসনা চলত। এমনি ভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় এবং মেসো-আমেরিকান সংস্কৃতিতে সূর্য পূজারীদেরকে পাওয়া যাবে। খ্রীস্টান সম্প্রদায় কর্তৃক পালিত যীশু খ্রীস্টের তথাকথিত জন্মদিন ২৫শে ডিসেম্বরও মূলত এসেছে রোমক সৌর-পূজারীদের পৌত্তলিক ধর্ম থেকে, যীশু খ্রীস্টের প্রকৃত জন্মতারিখ থেকে নয়। ১৯ শতাব্দীর উত্তর-আমেরিকায় কিছু সম্প্রদায় গ্রীষ্মের প্রাক্কালে পালন করত সৌর-নৃত্য এবং এই উৎসব উপলে পৌত্তলিক প্রকৃতি পূজারীরা তাদের ধর্মীয়-বিশ্বাসের পুনর্ঘোষণা দিত। মানুষের ভক্তি ও ভালবাসাকে প্রকৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির সাথে আবদ্ধ করে তাদেরকে শিরক বা অংশীদারিত্বে লিপ্ত করানো শয়তানের সুপ্রাচীন “ক্লাসিকাল ট্রিক” বলা চলে। শয়তানের এই কূটচালের বর্ণনা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে তুলে ধরেছেন:

“আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখেছি, তারা আল্লাহকে ছেড়ে সূর্যকে সিজদা করছে এবং শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের জন্য শোভনীয় করেছে…”[সূরা আন নামল :২৪]

 

নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন অশ্লীলতা:

নববর্ষের পার্টি বা “উদযাপন আয়োজনের” অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নারীর সহজ-লভ্যতা – নিউ-ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে অথবা ঢাকার গুলশান ক্লাবে – পশ্চিমেও এবং তাদের অনুকরণে এখানেও ব্যাপারটা একটা অলিখিত প্রলোভন। নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সমাজ-বিধ্বংসী যে বিষয়গুলো পাওয়া যাবে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা। নববর্ষের পার্টি বা উদযাপন আয়োজনের সবর্ত্রই সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী নারীকে পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত দেখা যাবে। পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষকে যে সকল আকষর্ণীয় বস্তু দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী। রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেন:

“আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বড় কোন ফিতনা রেখে যাচ্ছি না।” [বুখারী ও মুসলিম]

সমাজ নারীকে কোন অবস্থায়, কি ভূমিকায়, কি ধরনের পোশাকে দেখতে চায় – এ বিষয়টি সেই সমাজের ধ্বংস কিংবা উন্নতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। নারীর বিচরণক্ষেত্র, ভূমিকা এবং পোশাক এবং পুরুষের সাপেক্ষে তার অবস্থান – এ সবকিছুই ইসলামে সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ দ্বারা নির্ধারিত, এখানে ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রথা, হালের ফ্যাশন কিংবা ব্যক্তিগত শালীনতাবোধের কোন গুরুত্বই নেই। যেমন ইসলামে নারীদের পোশাকের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়া আছে, আর তা হচ্ছে এই যে একজন নারীর চেহারা ও হস্তদ্বয় ছাড়া দেহের অন্য কোন অঙ্গই বহিরাগত পুরুষেরা দেখতে পারবে না।

বহিরাগত পুরুষ কারা? স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীদের পুত্র, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, মুসলিম নারী, নিজেদের মালিকানাধীন দাসী, যৌনকামনাহীন কোন পুরুষ এবং এমন শিশু যাদের লজ্জাস্থান সম্পর্কে সংবেদনশীলতা তৈরী হয়নি, তারা বাদে সবাই একজন নারীর জন্য বহিরাগত। এখানে ব্যক্তিগত শালীনতাবোধের প্রশ্ন নেই। যেমন কোন নারী যদি বহিরাগত পুরুষের সামনে চুল উন্মুক্ত রেখে দাবী করে যে তার এই বেশ যথেষ্ট শালীন, তবে তা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা শালীনতা-অশালীনতার সামাজিক মাপকাঠি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, আর তাই সমাজ ধীরে ধীরে নারীর বিভিন্ন অঙ্গ উন্মুক্তকরণকে অনুমোদন দিয়ে ক্রমান্বয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে যে, যেখানে বস্তুত দেহের প্রতিটি অঙ্গ নগ্ন থাকলেও সমাজে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় – যেমনটা পশ্চিমা বিশ্বের ফ্যাশন শিল্পে দেখা যায়। মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা ভারতবর্ষে যা শালীন, বাংলাদেশে হয়ত এখনও সেটা অশালীন – তাহলে শালীনতার মাপকাঠি কি? সেজন্য ইসলামে এধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে মানুষের কামনা-বাসনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়নি, বরং তা কুরআন ও হাদীসের বিধান দ্বারা নির্ধারণ করা হয়েছে। তেমনি নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও অবাধ কথাবার্তা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা এই অবাধ মেলামেশা ও অবাধ কথাবার্তাই ব্যভিচারের প্রথম ধাপ। যিনা-ব্যভিচার ইসলামী শরীয়াতের আলোকে কবীরাহ গুনাহ, এর পরিণতিতে হাদীসে আখিরাতের কঠিন শাস্তির বর্ণনা এসেছে। এর প্রসারে সমাজ জীবনের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে, ছড়িয়ে পড়ে অশান্তি ও সন্ত্রাস এবং কঠিন রোগব্যাধি। আল্লাহর রাসূলের হাদীস অনুযায়ী কোন সমাজে যখন ব্যভিচার প্রসার লাভ করে তখন সে সমাজ আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হয়ে ওঠে। আর নারী ও পুরুষের মাঝে ভালবাসা উদ্রেককারী অপরাপর যেসকল মাধ্যম, তা যিনা-ব্যভিচারের রাস্তাকেই প্রশস্ত করে।

এ সকল কিছু রোধ করার জন্য ইসলামে নারীদেরকে পর্দা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, নারী ও পুরুষের বিচরণ ক্ষেত্র পৃথক করা এবং দৃষ্টি অবনত রাখার বিধান রাখা হয়েছে। যে সমাজ নারীকে অশালীনতায় নামিয়ে আনে, সেই সমাজ অশান্তি ও সকল পাপকাজের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়, কেননা নারীর প্রতি আকর্ষণ পুরুষের চরিত্রে বিদ্যমান অন্যতম অদম্য এক স্বভাব, যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই সামাজিক সমৃদ্ধির মূলতত্ত্ব। আর এজন্যই ইসলামে সুনির্দিষ্ট বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যে কোন প্রকার সৌন্দর্য বা ভালবাসার প্রদর্শনী ও চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের ফলাফল দেখতে চাইলে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকানোই যথেষ্ট, গোটা বিশ্বে শান্তি, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ঝান্ডাবাহী খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ছয় মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত তথাকথিত সভ্য দেশে মানুষের ভিতরকার এই পশুকে কে বের করে আনল? অত্যন্ত নিম্নবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেও সহজেই বুঝতে পারে যে, স্রষ্টার বেঁধে দেয়া শালীনতার সীমা যখনই শিথিল করা শুরু হয়, তখনই মানুষের ভিতরকার পশুটি পরিপুষ্ট হতে শুরু করে। পশ্চিমা বিশ্বের অশালীনতার চিত্রও কিন্তু একদিনে রচিত হয়নি। সেখানকার সমাজে নারীরা একদিনেই নগ্ন হয়ে রাস্তায় নামেনি, বরং ধাপে ধাপে তাদের পোশাকে সংক্ষিপ্ততা ও যৌনতা এসেছে, আজকে যেমনিভাবে দেহের অংশবিশেষ প্রদর্শনকারী ও সাজসজ্জা গ্রহণকারী বাঙালি নারী নিজেকে শালীন বলে দাবী করে, ঠিক একইভাবেই বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে দেহ উন্মুক্তকরণ শুরু হয়েছিল তথাকথিত “নির্দোষ” পথে।

নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ ও চাল-চলন নিয়ে ইসলামের বিধান আলোচনা করা এই নিবন্ধের আওতা বহির্ভূত, তবে এ সম্পর্কে মোটামুটি একটা চিত্র ইতিমধ্যেই তুলে ধরা হয়েছে। এই বিধি-নিষেধের আলোকে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, নববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীর যে অবাধ উপস্থিতি, সৌন্দর্য প্রদর্শন এবং পুরুষের সাথে মেলামেশা – তা পরিপূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী, তা কতিপয় মানুষের কাছে যতই লোভনীয় বা আকর্ষণীয়ই হোক না কেন। এই অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের ধ্বংসের পূর্বাভাস দিচ্ছে। ৩ বছরের বালিকা ধর্ষণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিদ্যাপীঠে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন, পিতার সম্মুখে কন্যা এবং স্বামীর সম্মুখে স্ত্রীর শ্লীলতাহানি – বাংলাদেশের সমাজে এধরনের বিকৃত ঘটনা সংঘটনের প্রকৃত কারণ ও উৎস কি? প্রকৃতপক্ষে এর জন্য সেইসব মা-বোনেরা দায়ী যারা প্রথমবারের মত নিজেদের অবগুন্ঠনকে উন্মুক্ত করেও নিজেদেরকে শালীন ভাবতে শিখেছে এবং সমাজের সেইসমস্ত লোকেরা দায়ী, যারা একে প্রগতির প্রতীক হিসেবে বাহবা দিয়ে সমর্থন যুগিয়েছে।

ব্যভিচারের প্রতি আহবান জানানো শয়তানের ক্লাসিকাল ট্রিকগুলোর অপর একটি, যেটাকে কুরআনে “ফাহিশাহ” শব্দের আওতায় আলোচনা করা হয়েছে, শয়তানের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন:

“হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু আছে তা থেকে তোমরা আহার কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । সে তো তোমাদের নির্দেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজ [ব্যভিচার, মদ্যপান, হত্যা ইত্যাদি] করতে এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন সব বিষয় বলতে যা তোমরা জান না।” [সূরা আল বাকারা :১৬৮-১৬৯]

এছাড়া যা কিছুই মানুষকে ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ ও উদ্যোগী করতে পারে, তার সবগুলোকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতের দ্বারা:

“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।” [সূরা বনী ইসরাঈল: ৩২]

ব্যভিচারকে উৎসাহিত করে এমন বিষয়, পরিবেশ, কথা ও কাজ এই আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।

বিভিন্ন সাজে সজ্জিত পর্দাবিহীন নারীকে আকর্ষণীয়, প্রগতিশীল, আধুনিক ও অভিজাত বলে মনে হতে পারে, কেননা, শয়তান পাপকাজকে মানুষের দৃষ্টিতে শোভনীয় করে তোলে। যেসব মুসলিম ব্যক্তির কাছে নারীর এই অবাধ সৌন্দর্য প্রদর্শনকে সুখকর বলে মনে হয়, তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য:

ক. ছোট শিশুরা অনেক সময় আগুন স্পর্শ করতে চায়, কারণ আগুনের রং তাদের কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু আগুনের মূল প্রকৃতি জানার পর কেউই আগুন ধরতে চাইবে না। তেমনি ব্যভিচারকে আকর্ষণীয় মনে হলেও পৃথিবীতে এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি এবং আখিরাতে এর জন্য যে কঠিন শাস্তি পেতে হবে, সেটা স্মরণ করলে বিষয়টিকে আকর্ষণীয় মনে হবে না।

খ. প্রত্যেকে নিজেকে প্রশ্ন করে দেখি, একজন নারী যখন নিজের দেহকে উন্মুক্ত করে সজ্জিত হয়ে বহু পুরুষের সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের মনে যৌন-লালসার উদ্রেক করে, তখন সেই দৃশ্য দেখে এবং সেই নারীকে দেখে বহু-পুরুষের মনে যে কামভাবের উদ্রেক হয়, সেকথা চিন্তা করে এই নারীর বাবার কাছে তার কন্যার নগ্নতার দৃশ্যটি কি খুব উপভোগ্য হবে? এই নারীর সন্তানের কাছে তার মায়ের জনসম্মুখে উন্মুক্ততা কি উপভোগ্য? এই নারীর ভাইয়ের কাছে তার বোনের এই অবস্থা কি আনন্দদায়ক? এই নারীর স্বামীর নিকট তার স্ত্রীর এই অবস্থা কি সুখকর? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কিভাবে একজন ব্যক্তি পরনারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনকে পছন্দ করতে পারে? এই পরনারী তো কারও কন্যা কিংবা কারও মা, কিংবা কারও বোন অথবা কারও স্ত্রী? এই লোকগুলোর কি পিতৃসুলভ অনুভূতি নেই, তারা কি সন্তানসুলভ আবেগশূন্য, তাদের বোনের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ স্নেহশূন্য কিংবা স্ত্রীর প্রতি স্বামীসুলভ অনুভূতিহীন?

নিশ্চয়ই নয়। বরং আপনি-আমি একজন পিতা, সন্তান, ভাই কিংবা স্বামী হিসেবে যে অনুভূতির অধিকারী, রাস্তার উন্মুক্ত নারীটির পরিবারও সেই একই অনুভূতির অধিকারী। তাহলে আমরা আমাদের কন্যা, মাতা, ভগ্নী কিংবা স্ত্রীদের জন্য যা চাই না, তা কিভাবে অন্যের কন্যা, মাতা, ভগ্নী কিংবা স্ত্রীদের জন্য কামনা করতে পারি? তবে কোন ব্যক্তি যদি দাবী করে যে, সে নিজের কন্যা, মাতা, ভগ্নী বা স্ত্রীকেও পরপুরুষের যথেচ্ছ লালসার বস্তু হতে দেখে বিচলিত হয় না, তবে সে তো পশুতুল্য, নরাধম। বরং অধিকাংশেরই এধরনের সংবেদনশীলতা রয়েছে। তাই আমাদের উচিৎ অন্তর থেকে এই ব্যভিচারের চর্চাকে ঘৃণা করা। এই ব্যভিচার বিভিন্ন অঙ্গের দ্বারা হতে পারে, যেমনটি নবীজী(সা.) বর্ণনা করেছেন:

“…চোখের যিনা হচ্ছে তাকানো, জিহ্বার যিনা হচ্ছে কথা বলা, অন্তর তা কামনা করে এবং পরিশেষে যৌনাঙ্গ একে বাস্তবায়ন করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে।” [বুখারী ও মুসলিম]

দৃষ্টি, স্পর্শ, শোনা ও কথার দ্বারা সংঘটিত যিনাই মূল ব্যভিচার সংঘটিত হওয়াকে বাস্তব রূপ দান করে, তাই জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য সে সকল স্থান থেকে শতহস্ত দূরে থাকা, যে সকল স্থানে দৃষ্টি, স্পর্শ, শোনা ও কথার ব্যভিচারের সুযোগকে উন্মুক্ত করা হয়।

সঙ্গীত ও বাদ্য:

নববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকে সংগীত ও বাদ্য। ইসলামে নারীকন্ঠে সংগীত নিঃসন্দেহে নিষিদ্ধ – একথা পূর্বের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট। সাধারণভাবে যে কোন বাদ্যযন্ত্রকেও ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া, যেমন বিশেষ কিছু উপলক্ষে দফ নামক বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অনুমতি হাদীসে এসেছে। তাই যে সকল স্থানে এসব হারাম সংগীত উপস্থাপিত হয়, সে সকল স্থানে যাওয়া, এগুলোতে অংশ নেয়া, এগুলোতে কোন ধরনের সহায়তা করা কিংবা তা দেখা বা শোনা সকল মুসলিমের জন্য হারাম। কিন্তু কোন মুসলিম যদি এতে উপস্থিত থাকার ফলে সেখানে সংঘটিত এইসকল পাপাচারকে বন্ধ করতে সমর্থ হয়, তবে তার জন্য সেটা অনুমোদনযোগ্য। তাছাড়া অনর্থক কথা ও গল্প-কাহিনী যা মানুষকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, তা নিঃসন্দেহে মুসলিমের জন্য বর্জনীয়। অনর্থক কথা, বানোয়াট গল্প-কাহিনী এবং গান-বাজনা মানুষকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য শয়তানের পুরোনো কূটচালের একটি, আল্লাহ এ কথা কুরআনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন:

“এবং তাদের মধ্যে যাদেরকে পার পর্যায়ক্রমে বোকা বানাও তোমার গলার স্বরের সাহায্যে, … ” [সূরা বনী ইসরাঈল :৬৪]

যে কোন আওয়াজ, যা আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহবান জানায়, তার সবই এই আয়াতে বর্ণিত আওয়াজের অন্তর্ভুক্ত। [তফসীর ইবন কাসীর]

আল্লাহ আরও বলেন:

“এবং মানুষের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পথ থেকে [মানুষকে] বিচ্যুত করার জন্য কোন জ্ঞান ছাড়াই অনর্থক কথাকে ক্রয় করে, এবং একে ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে, এদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” [সূরা লোকমান :৬]

রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন:

“আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে।” [বুখারী]

এছাড়াও এ ধরনের অনর্থক ও পাপপূর্ণ অনুষ্ঠান সম্পর্কে বহু সতর্কবাণী এসেছে কুরআনের অন্যান্য আয়াতে এবং আল্লাহর রাসূলের হাদীসে।

যে সকল মুসলিমদের মধ্যে ঈমান এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের উচিৎ এসবকিছুকে সর্বাত্মকভাবে পরিত্যাগ করা।

আমাদের করণীয়

সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নববর্ষ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এজন্য যে, এতে নিম্নোলিখিত চারটি শ্রেণীর ইসলাম বিরোধী বিষয় রয়েছে:

১. শিরকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, চিন্তাধারা ও সংগীত
২. নগ্নতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচারপূর্ণ অনুষ্ঠান
৩. গান ও বাদ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান
৪. সময় অপচয়কারী অনর্থক ও বাজে কথা এবং কাজ

এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে, নিজে এগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা এবং মুসলিম সমাজ থেকে এই প্রথা উচ্ছেদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো নিজ নিজ সাধ্য ও অবস্থান অনুযায়ী। এ প্রসঙ্গে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া যেতে পারে:

- এ বিষয়ে দেশের শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্ব হবে আইন প্রয়োগের দ্বারা নববর্ষের যাবতীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

- যেসব ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষমতার অধিকারী, তাদের কর্তব্য হবে অধীনস্থদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখা। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এই নির্দেশ জারি করতে পারেন যে, তার প্রতিষ্ঠানে নববর্ষকে উপলক্ষ করে কোন ধরনের অনুষ্ঠান পালিত হবে না, নববর্ষ উপলক্ষে কেউ বিশেষ পোশাক পরতে পারবে না কিংবা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারবে না।

- মসজিদের ইমামগণ এ বিষয়ে মুসল্লীদেরকে সচেতন করবেন ও বিরত থাকার উপদেশ দেবেন।

- পরিবারের প্রধান এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন যে তার পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা অধীনস্থ অন্য কেউ যেন নববর্ষের কোন অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়। (এটুকু ইনশা’আল্লাহ্ চাইলে সবাই/অনেকেই করতে পারবেন)

- এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী ও পরিবারের মানুষকে উপদেশ দেবেন এবং নববর্ষ পালনের সাথে কোনভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক দান করুন, এবং কল্যাণ ও শান্তি বর্ষিত হোক নবী(সা.)-এঁর ওপর, তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের ওপর।


“এবং তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার পরিধি আসমান ও জমীনব্যাপী, যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য।” [সূরা আলে-ইমরান:১৩৩]


পহেলা বৈশাখ: ইতিহাস ও বিধি-বিধান

$
0
0

লেখকঃ  আ.স.ম শো‘আইব আহমাদ | সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

এপ্রিল মাসে আমরা বাংলাদেশীরা একটি উৎসব করে থাকি, তা হলো ১৪ই এপ্রিল। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালন করা। আমাদের দেশে প্রচলিত বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন মূলত ইসলামী হিজরী সনেরই একটি রূপ। ভারতে ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরর চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। একারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবারের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সম্রাট আকবার তার দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খৃস্টাব্দে সম্রাট আকবার এ হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ইতোপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরী সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।

তাহলে বাংলা সন মূলত হিজরী সন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরত থেকেই এ পঞ্জিকার শুরু। ১৪১৫ বঙ্গাব্দ অর্থ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরতের পর ১৪১৫ বৎসর। ৯৬২ চান্দ্র বৎসর ও পরবর্তী ৪৫৩ বৎসর সৌর বৎসর। সৌর বৎসর চান্দ্র বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন বেশি এবং প্রতি ৩০ বৎসরে চান্দ্র বৎসর এক বৎসর বেড়ে যায়। এজন্য ১৪৩৩ হিজরী সাল মোতাবেক বাংলা ১৩১৮-১৯ সাল হয়।

মোগল সময় থেকেই পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্রমাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন এবং কিছু আনন্দ উৎসব করা হতো। এছাড়া বাংলার সকল ব্যবসায়ী ও দোকানদার পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। পহেলা বৈশাখ এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি মূলত: রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন নিয়ম-কানুনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে কাজ-কর্ম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ছিল। এ ধরনের কিছু সংঘটিত হওয়া মূলত ইসলামে নিষিদ্ধ বলার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

কিন্তু বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে এমন কিছু কর্মকান্ড করা হচ্ছে যা কখনোই পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালীরা করেন নি; বরং এর অধিকাংশই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে প্রচণ্ডভাবে সাংঘর্ষিক। পহেলা বৈশাখের নামে বা নববর্ষ উদযাপনের নামে যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীদেরকে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও এদেশের মানুষেরা যা জানত না এখন নববর্ষের নামে তা আমাদের সংস্কৃতির অংশ বানানো হচ্ছে।

বাংলার প্রাচীন মানুষেরা ছিলেন দ্রাবিড় বা সম্মানিত রাসূল নূহ আলাইহিস সালাম-এর বড় ছেলে সামের বংশধর। খৃস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে ইয়াফিসের সন্তানদের একটি গ্রুপ আর্য নামে ভারতে আগমন করে। ক্রমান্বয়ে তারা ভারত দখল করে ও আর্য ধর্ম ও কৃষ্টিই পরবর্তীতে ‘‘হিন্দু’’ ধর্ম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ভারতের দ্রাবিড় ও অর্নায ধর্ম ও সভ্যতাকে সর্বদা হাইজ্যাক করেছে আর্যগণ। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘‘বাঙালী’’ সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে হাইজ্যাক করা। আর্যগণ বাংলাভাষা ও বাঙালীদের ঘৃণা করতেন। বেদে ও পুরাণে বাংলাভাষাকে পক্ষীর ভাষা ও বাঙালীদেরকে দস্যু, দাসের ভাষা ইত্যাদি বলা হয়েছে। মুসলিম সুলতানগণের আগমনের পরে তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। বাঙালী সংস্কৃতি বলতে বাংলার প্রাচীন লোকজ সংস্কৃতি ও মুসলিম সংস্কৃতির সংমিশ্রণ বুঝানো হতো। কিন্তু ক্রমান্বয়ে আর্যগণ ‘‘বাঙালীত্ব’’ বলতে হিন্দুত্ব বলে মনে করেন ও দাবি করেন। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদিগণ Hindutva অর্থাৎ ভারতীয়ত্ব বা ‘‘হিন্দুত্ব’’ হিন্দু ধর্মত্ব বলে দাবি করেন এবং ভারতের সকল ধর্মের মানুষদের হিন্দু ধর্মের কৃষ্টি ও সভ্যতা গ্রহণ বাধ্যতামূলক বলে দাবি করেন। তেমনিভাবে বাংলায় আর্য পণ্ডিতগণ বাঙালীত্ব বলতে হিন্দুত্ব ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ বলতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালী সংস্কৃতি বলতে হিন্দু সংস্কৃতি বলে মনে করেন। এজন্যই তারা মুসলিমদের বাঙালী বলে স্বীকার করেন না। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত গল্পে আমরা দেখেছি যে বাঙালী বলতে শুধু বাঙালী হিন্দুদের বুঝানো হয়েছে এবং মুসলিমদেরকে তাদের বিপরীতে দেখানো হয়েছে। এ মানসিকতা এখনো একইভাবে বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদেরকে ‘‘বাঙালী’’ পরিচয় দিলে বা জাতিতে ‘‘বাঙালী’’ লিখলে ঘোর আপত্তি করা হয়। এ মানসিকতার ভিত্তিতেই ‘‘পহেলা বৈশাখে’’ বাঙালী সংস্কৃতির নামে পৌত্তলিক বা অশ্লীল কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে প্রচার করা হচ্ছে।

এক সময় বাংলা বর্ষপঞ্জি এদেশের মানুষের জীবনের অংশ ছিল। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কৃষি ও কর্ম এ পঞ্জিকা অনুসারেই চলত। এজন্য পহেলা বৈশাখ হালখাতা বা অনুরূপ কিছু অনুষ্ঠান ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের জীবনের কোথাও বঙ্গাব্দের কোনো প্রভাব নেই। কাগজে কলমে যাই লেখা হোক, প্রকৃতপক্ষে আমরা নির্ভর করছি খৃস্টীয় পঞ্জিকার উপর। যে বাংলা বর্ষপঞ্জি আমরা বছরের ৩৬৪ দিন ভুলে থাকি, সে বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনে আমরা সবাই ‘‘বাঙালী’’ সাজার চেষ্টা করে এ নিয়ে ব্যাপক হইচই করি। আর এ সুযোগে দেশীয় ও বিদেশী বেনিয়াগণ ও আধিপত্যবাদীগণ তাদের ব্যবসা বা আধিপত্য প্রসারের জন্য এ দিনটিকে কেন্দ্র করে বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও অনৈতিকতার প্রচার করে।

পাশ্চাত্য সভ্যতার অনেক ভাল দিক আছে। কর্মস্পৃহা, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি অনেক গুণ তাদের মধ্যে বিদ্যমান। পাশাপাশি তাদের কিছু দোষ আছে যা তাদের সভ্যতার ভাল দিকগুলি ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ দোষগুলির অন্যতম হলো মাদকতা ও অশ্লীলতা। আমরা বাংলাদেশের মানুষের পাশ্চাত্যের কোনো ভালগুণ আমাদের সমাজে প্রসার করতে পারি নি বা চাই নি। তবে তাদের অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও মাদকতার ধ্বংসাত্মক দিকগুলি আমরা খুব আগ্রহের সাথে গ্রহণ করতে ও প্রসার করতে চাচ্ছি। এজন্য খৃস্টীয় ক্যালেন্ডারের শেষ দিনে ও প্রথম দিনে থার্টিফার্স্ট নাইট ও নিউ-ইয়ারস ডে বা নববর্ষ উপলক্ষ্যে আমাদের বেহায়পনার শেষ থাকে না।

পক্ষান্তরে, আমাদের দেশজ সংস্কৃতির অনেক ভাল দিক আছে। সামাজিক শিষ্টাচার, সৌহার্দ্য, জনকল্যাণ, মানবপ্রেম ইত্যাদি সকল মূল্যবোধ আমরা সমাজ থেকে তুলে দিচ্ছি। পক্ষান্তরে দেশীয় সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো হচ্ছে।

বেপর্দা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদকতা ও অপরাধ একসূত্রে বাধা। যুবক-যুবতীদেরকে অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার সুযোগ দিবেন, অথচ তারা অশ্লীলতা, ব্যভিচার, এইডস, মাদকতা ও অপরাধের মধ্যে যাবে না, এরূপ চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। অন্যান্য অপরাধের সাথে অশ্লীতার পার্থক্য হলো কোনো একটি উপলক্ষ্যে একবার এর মধ্যে নিপতিত হলে সাধারণভাবে কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীরা আর এ থেকে বেরোতে পারে না। বরং ক্রমান্বয়ে আরো বেশি পাপ ও অপরাধের মধ্যে নিপতিত হতে থাকে। কাজেই নিজে এবং নিজের সন্তান ও পরিজনকে সকল অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করুন।

আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর; যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফিরিশতাগণ, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হোন না, আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা-ই তামিল করে’’। [সূরা আত-তাহরীম: ৬]

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, রাষ্ট্রনেতা তার প্রজাদের সম্পর্কে দায়িত্বশীল আর তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পুরুষ লোক তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন মহিলা তার স্বামীর ঘরের সার্বিক ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, তাকে সেটার পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পরিচারক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক, আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (বুখারী : ৮৯৩; মুসলিম: ১৮২৯)

প্রিয় পাঠক ! পহেলা বৈশাখ বা অন্য কোনো উপলক্ষ্যে ছেলেমেয়েদেরকে বেপর্দা ও বেহায়পনার সুযোগ দিবেন না। তাদেরকে বুঝান ও নিয়ন্ত্রণ করুন। আপনি মসজিদে নামায আদায় করছেন আর আপনার ছেলেমেয়ে পহেলা বৈশাখের নামে বেহায়াভাবে মিছিল বা উৎসব করে বেড়াচ্ছে। আপনার ছেলেমেয়ের পাপের জন্য আপনার আমলনামায় গোনাহ জমা হচ্ছে। শুধু তাই নয়। অন্য পাপ আর অশ্লীলতার পার্থক্য হলো, যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানদের বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার সুযোগ দেয় তাকে ‘‘দাইউস’’ বলা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বারংবার বলেছেন যে, তিন ব্যক্তি আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাত হারাম করেছেন, মাদকাসক্ত, পিতা-মাতার অবাধ্য এবং দাইউস, যে তার পরিবারের মধ্যে ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয়” (মুসনাদে আহমাদ: ২/৬৯)

নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করার পাশাপাশি মুমিনের দায়িত্ব হলো সমাজের মানুষদেরকে সাধ্যমত ন্যায়ের পথে ও অন্যায়ের বর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কাজেই পহেলা বৈশাখ ও অন্য যে কোনো উপলক্ষ্যে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার ক্ষতি, অন্যায় ও পাপের বিষয়ে সবাইকে সাধ্যমত সচেতন করুন। যদি আপনি তা করেন তবে কেউ আপনার কথা শুনুক অথবা না শুনুক আপনি আল্লাহর কাছে অফুরন্ত সাওয়াব লাভ করবেন। আর যদি আপনি তা না করেন তবে এ পাপের গযব আপনাকেও স্পর্শ করবে। কুরআন ও হাদীসে বিষয়টি বারংবার বলা হয়েছে।

ব্যবসায়িক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো স্বার্থে অনেক মুসলিম পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার পথ খুলে দেওয়ার জন্য মিছিল, মেলা ইত্যাদির পক্ষে অবস্থান নেন। আপনার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই হতে পারে না। অশ্লীলতা প্রসারের ভয়ঙ্কর পাপ ছাড়াও ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা শুনুন:

‘‘যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।’’ (সূরা নূর: ১৯)

সাবধান হোন! সতর্ক হোন! আপনি কি আল্লাহর সাথে পাল্লা দিবেন? আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে আপনি কি জয়ী হবেন? কখন কিভাবে আপনার ও আপনার পরিবারের জীবনে ‘‘যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’’ নেমে আসবে তা আপনি বুঝতেও পারবেন না। আপনার রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্য পথ দেখুন। অন্য বিকল্প চিন্তা করুন। তবে কখনোই অশ্লীলতা প্রসার ঘটে এরূপ কোনো বিষয়কে আপনার স্বার্থ উদ্ধারের বাহন বানাবেন না।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন!!
জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আল্লাহকে সম্মান দেওয়া ও তাকে গালমন্দকারীর বিধান

$
0
0

allah

মূল ঃ শায়খ আব্দুল আজিজ তারিফি | অনুবাদঃ সানাউল্লাহ নজির আহমদ | সম্পাদকঃ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আল্লাহ তা'আলার জন্য সকল প্রশংসা, যেরূপ তার সম্মানের সঙ্গে প্রযোজ্য। আমি তার নির্দেশ মোতাবেক শোকর আদায় করছি, আরো স্বীকার করছি যে, বান্দা তার যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে অক্ষম, কারণ তারা তাকে জ্ঞান দ্বারা পূর্ণরূপে বেষ্টন করতে পারেনি, যাকে জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করা যায় না, তার পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায় করা সম্ভব নয়।

আল্লাহ তা'আলার নিয়ামত অগণিত, যার যথাযথ শোকর আদায় করা কখনো সম্ভব নয়। তিনি ইহকাল ও পরকালের মালিক এবং তার নিকট সবার প্রত্যাবর্তন। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক তার কোনো শরীক নেই, একমাত্র তিনিই সত্যিকার মাবুদ নেই। সালাত ও সালাম পাঠ করছি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।

অতঃপর:

যুক্তি ও বিবেক উভয়ের দাবী সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা ও সম্মানের জ্ঞান হাসিল করা ওয়াজিব, যার তাওহীদের ঘোষণা দেয় গোটা জগত। সকল সৃষ্টিজীবে সৃষ্টিকর্তার বড়ত্ব, মহান সৃষ্টির কারুকার্য ও নিখুঁত পরিকল্পনার স্বাক্ষর বিদ্যমান। যদি তারা সকলে নিজের দিকে মনোনিবেশ করে, নিজ সত্তার প্রতি ভাবনার দৃষ্টি দেয় ও গভীর চিন্তা করে, তাহলে অবশ্যই তারা সৃষ্টিকর্তার মহত্ত্ব নিজেদের মাঝে দেখতে পাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَفِيٓ أَنفُسِكُمۡۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٢١ ﴾ [الذاريات: ٢١]

“আর তোমাদের নিজেদের মধ্যেও [নিদর্শন রয়েছে]। তোমরা কি চক্ষুষ্মান হবে না?[1]

নূহ আলাইহিস সালাম তার কওমকে বলেন:

﴿ مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارٗا ١٣ وَقَدۡ خَلَقَكُمۡ أَطۡوَارًا ١٤ ﴾ [نوح: ١٣،  ١٤]

“তোমাদের কি হল, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের পরোয়া করছ না? অথচ তিনি তোমাদেরকে নানাস্তরে সৃষ্টি করেছেন”।[2]

এ আয়াতের অর্থ ইব্‌ন আব্বাস ও মুজাহিদ বলেন: “তোমরা আল্লাহর মর্যাদার পরোয়া করো না”।[3] ইব্‌ন আব্বাস আরো বলেন: “তোমাদের কি হল, তোমরা আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছ না?”[4]

নবী নূহ আলাইহিস সালাম তার জাতিকে স্বীয় নফস ও সৃষ্টির স্তরসমূহে চিন্তার আহ্বান করেছেন, যেন তারা নিজেদের উপর সৃষ্টিকর্তার হক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, আল্লাহকে সম্মান দেওয়া ও তার অধিকার জানার জন্য নিজের নফস ও সৃষ্টির স্তরসমূহ দেখাই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি আসমান ও জমিনে বিদ্যমান সকল সৃষ্টিজীবের উপর চিন্তা করবে তার অবস্থা কেমন হবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ আল্লাহর মর্যাদা বুঝে না, কারণ তারা তার নিদর্শনসমূহ ভাবনার দৃষ্টিতে দেখে না; দেখে না চিন্তা, গবেষণা ও উপদেশ গ্রহণের গভীর আগ্রহে, তারা দেখে শুধু উপভোগ ও অবহেলার দৃষ্টিতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَكَأَيِّن مِّنۡ ءَايَةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ يَمُرُّونَ عَلَيۡهَا وَهُمۡ عَنۡهَا مُعۡرِضُونَ ١٠٥﴾ [يوسف: ١٠٤]

“আর আসমানসমূহ ও জমিনে কত নিদর্শন রয়েছে, যা তারা অতিক্রম করে চলে যায়, অথচ সেগুলো থেকে তারা বিমুখ”।[5]

বিমুখ অন্তর ও গাফেল হৃদয়কে এসব নিদর্শন আকৃষ্ট করে না, মুজিযাসমূহ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। একমাত্র তারাই আল্লাহকে মর্যাদায় দেয়, যারা তাকে দেখে, অথবা তার নিদর্শন দেখে ও তার গুণগান জানে। গাফেল ও বিমুখ অন্তরে আল্লাহর মর্যাদা মূল্যহীন, ফলশ্রুতিতে তার সাথে কুফরি ও তার নাফরমানি করা হয়, কখনো তাকে গালি দেওয়া হয়, তার সাথে উপহাস করা হয়। মহানের মহত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা পরিমাণ তার নাফরমানি করা হয়, অন্তর থেকে যে পরিমাণ তার মর্যাদা ও বড়ত্ব হ্রাস পায়, সে পরিমাণ তার কুফরি করা হয় ও তার হক অস্বীকার করা হয়। পক্ষান্তরে দুর্বলের দুর্বলতা সম্পর্কে অজ্ঞতা পরিমাণ আনুগত্য করা হয়, অন্তরে যে পরিমাণ তার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, সে পরিমাণ তার ইবাদত করা হয় ও তাকে সম্মান দেওয়া হয়।

মুশরিকরা এ জন্য আল্লাহর সাথে কুফরি করে, যিনি পুনরায় জীবিত করবেন, মূর্তির ইবাদত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের ত্রুটির বর্ণনা দিয়ে বলেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٞ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥٓۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَن يَخۡلُقُواْ ذُبَابٗا وَلَوِ ٱجۡتَمَعُواْ لَهُۥۖ وَإِن يَسۡلُبۡهُمُ ٱلذُّبَابُ شَيۡ‍ٔٗا لَّا يَسۡتَنقِذُوهُ مِنۡهُۚ ضَعُفَ ٱلطَّالِبُ وَٱلۡمَطۡلُوبُ ٧٣ مَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ ٧٤﴾ [الحج : ٧٣،  ٧٤]

“হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তাও উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হয় উভয়েই দুর্বল। তারা আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দেয় না। নিশ্চয় আল্লাহ মহাক্ষমতাবান, মহাপরাক্রমশালী।[6]

*     আল্লাহ তা'আলাকে সম্মান দেওয়া: তার সিফত ও গুণগানের জ্ঞান হাসিল করা, তার নিদর্শনসমূহ চিন্তা করা, তার নিয়ামত ও অনুগ্রহসমূহ নিয়ে ভাবা। অতীত জাতিগুলোর অবস্থা, সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী, মুমিন ও কাফিরদের পরিণতি জানা ও সেগুলো থেকে উপদেশ গ্রহণ করা।

*     আল্লাহ তা'আলাকে সম্মান দেওয়া: তার শরীয়ত, আদেশ-নিষেধগুলো জানা ও সম্পাদন করা, তার বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও সাধ্যানুসারে তার উপর আমল করা। এগুলো ঈমানরে তেজস্বী বৃদ্ধি করবে, কারণ ঈমানেরও জ্যোতি ও উত্তাপ আছে। আপনি যার উপর ঈমান রাখেন, সে নির্দেশ করে, কিন্তু তার নির্দেশ পালন করা হয় না, সে নিষেধ করে, কিন্তু তার নিষেধ থেকে বিরত থাকা হয় না, তাহলে তার প্রতি আপনার ঈমানের উত্তাপ হ্রাস পাবে ও তার জ্যোতি নিষ্প্রভ হবে। এ আল্লাহ জন্য হাদি[7] ও হজের নিদর্শন প্রসঙ্গে বলেন:

﴿ ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢ ﴾ [الحج : ٣٢]

“এটাই হল আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই”।[8]

আদেশ ও নিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন মানে হুকুমদাতাকে সম্মান করা। তাই নাস্তিকতা, আল্লাহকে অস্বীকার করা ও তার সাথে কুফরি করার পূর্বে, তার আদেশ ও নিষেধের প্রতি উপেক্ষা ও তার সাথে তাচ্ছিল্যের আচরণ প্রকাশ পায়।

আল্লাহ ও তার মর্যাদা সম্পর্কে কতক অজ্ঞ বিমুখ লোকের নিকট, যারা ইতোপূর্বে তার আদেশ ও নিষেধ অবজ্ঞা করেছে, আল্লাহকে গালমন্দ করা, তাকে কতক শব্দ দ্বারা বিশেষায়িত ও সম্বোধন করা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে শাম,[9] ইরাক ও আফ্রিকার কতক দেশে, যা মুমিনদের মুখে উচ্চারণ করা, কিংবা তাদের কানে শ্রবণ করা কঠিন ঠেকে। এ জাতীয় বাক্য উচ্চারণকারী কতক লোক আবার নিজেদের মুসলিম দাবি করে, যেহেতু তারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে বিশ্বাস করে। হয়তো কতক মুসল্লি থেকেও এরূপ কথা প্রকাশ পায়, কারণ শয়তান তাদের মুখের উপর এসব চালু করেছে, এবং সে তাদেরকে প্ররোচনা দেয় যে, এ কথার প্রকৃত অর্থ ও সৃষ্টিকর্তাকে হেয় করা উদ্দেশ্য নয়। তাদেরকে সে বুঝায় এ জাতীয় কথা অর্থহীন, এ জন্য জবাবদিহি করা হয় না! তাই তারা অবহেলায় বলে।

অতএব সবার সামনে প্রকাশ করা জরুরি যে, সুস্থ বিবেক ও সকল আসমানি ধর্ম মতে এসব কথা ভ্রান্ত ও জঘন্য। এভাবে শয়তানের প্রবঞ্চনা বন্ধ হবে, মানুষ আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দিবে ও সকল অশোভন বাক্য থেকে তার পবিত্রতা ঘোষণা করবে, যে নিয়তে হোক ও যেভাবে হোক এসব কথা উচ্চারণ থেকে বিরত থাকবে।

সারসংক্ষেপ:

যেসব কথা বা কর্ম দ্বারা আল্লাহকে খাটো ও হেয় করা হয় তাই গালমন্দ, তাই কুফরি। এতে কোনো মুসলিমের দ্বিমত নেই, ইচ্ছায় হোক, অথবা খেল-তামাশায় হোক, উপহাস করে হোক, অথবা অবহেলা ও মূর্খতায় হোক। বাহ্যিক দেখে ফয়সালা করা হবে, নিয়তে কোনো তফাৎ নেই।

গালমন্দ ও গালমন্দের অর্থ:

মানুষ তাদের পরিভাষায় যেসব শব্দকে গালি বলে, অথবা উপহাস বলে, অথবা তাচ্ছিল্য বলে, শরীয়তের দৃষ্টিতেও তাই গালি, উপহাস ও তাচ্ছিল্য বলা হয়। এ ক্ষেত্রে মানুষের পরিভাষা বিচারক, যেমন লানত, অপমান, অশ্লীল বাক্য এবং হাত দ্বারা খারাপ ও অশালীন ইঙ্গিত। নির্দিষ্ট কোনো দেশে যা গালি ও উপহাস হিসেবে পরিচিত, শরীয়তের দৃষ্টিতে সেখানে তাই গালি ও উপহাস হিসেবে গণ্য, যদিও অন্য দেশে তা গালি নয়।

আল্লাহকে গালমন্দ করার বিধান:

আল্লাহকে গালি দেওয়া কুফরি, গালিদাতাকে হত্যা করা ওয়াজিব। এতে কোনো মুসলিমের দ্বিমত নেই। দ্বিমত শুধু তার তওবার ক্ষেত্রে, তওবা তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দিবে কি দিবে না, যদি সে তওবা করে? এ সম্পর্কে দু’টি মত প্রসিদ্ধ।

আল্লাহকে গালি দেওয়া ও তার সাথে উপহাস করা মূলত তাকে কষ্ট দেওয়া। কষ্ট দেওয়ার শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمۡ عَذَابٗا مُّهِينٗا ٥٧ وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ بِغَيۡرِ مَا ٱكۡتَسَبُواْ فَقَدِ ٱحۡتَمَلُواْ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا ٥٨ ﴾ [الاحزاب : ٥٧،  ٥٨]

“নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লানত করেন, এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অপমানজনক আযাব। আর যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে তাদের কৃত কোনো অন্যায় ছাড়াই কষ্ট দেয়, নিশ্চয় তারা বহন করবে অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপ”।[10]

আল্লাহকে কষ্ট দেয়ার অর্থ তার ক্ষতি করা নয়, কারণ কষ্ট দু’প্রকার: এক প্রকার ক্ষতি করে, অপর প্রকার ক্ষতি করে না। আল্লাহ তা‘আলাকে কোনো বস্তু ক্ষতি করতে পারে না। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

«يَا عِبَادِي: إِنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغُوا ضَرِّي، فَتَضُرُّونِي»

“হে আমার বান্দাগণ, তোমরা নিশ্চয় আমার ক্ষতি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না যে, আমাকে ক্ষতি করবে”।[11]

*             যে আল্লাহকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে লানত করেছেন। লানত অর্থ বান্দাকে রহমত থেকে বিতাড়িত করা। এ আয়াত প্রমাণ করে কষ্টদাতা দু’টি রহমত থেকে বঞ্চিত: ইহকালীন রহমত ও পরকালীন রহমত। কাফির ব্যতীত কাউকে এ দু’টি রহমত থেকে বঞ্চিত করা হয় না। এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় যে, তারপরে আল্লাহ মুমিন নারী ও পুরুষদের কষ্ট দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তাদের কষ্টদাতাকে তিনি উভয় জগতে লানত করেননি, কারণ গালমন্দ, লানত ও অপবাদ দ্বারা কেউ কাউকে কষ্ট দিলে কাফির বলা হয় না, তবে এসব বাক্য বলা স্পষ্ট পাপ ও অপবাদ, যেহেতু তার পক্ষে কোনো দলিল নেই।

দ্বিতীয়ত তাকে কষ্টদাতার জন্য তিনি ‘আযাবে মুহিন’ তথা মর্মন্তুদ শাস্তির কথা উল্লেখ বলেছেন, কুরআনুল কারীমে তিনি কাফেরদের ব্যতীত কারো জন্য এ শাস্তি উল্লেখ করেছেন।

*             আল্লাহ তা‘আলাকে গালমন্দ করা সকল কুফরি অপেক্ষা বড় কুফরি, মূর্তিপূজকদের কুফরি অপেক্ষাও বড়, কারণ তারা আল্লাহর প্রতি তাদের সম্মান থেকে পাথরকে সম্মান করে। তারা আল্লাহর মর্তবা হ্রাস করে পাথরের সমকক্ষ আল্লাহকে করেনি, বরং পাথরের সম্মান বৃদ্ধি করে তারা পাথরকে আল্লাহর সমকক্ষ করেছে। তাই মুশরিকরা জাহান্নামে প্রবেশ করে বলবে:

﴿تَٱللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٩٧ إِذۡ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٨﴾ [الشعراء : ٩٧،  ٩٨]

“আল্লাহর কসম! আমরা তো সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিলাম। যখন আমরা তোমাদেরকে সকল সৃষ্টির রবের সমকক্ষ বানাতাম”।[12]

মুশরিকরা পাথরকে আল্লাহর সমকক্ষ করার জন্য উচ্চে তুলেছে, কিন্তু আল্লাহকে পাথরের সমকক্ষ করার জন্য নিচে নামায়নি। তারা তাদের ধারণা মতে আল্লাহর সম্মানের অংশ হিসেবে পাথরকে সম্মান করে, পক্ষান্তরে আল্লাহকে গালমন্দকারী তাকে নিচে নামায়, যেন তিনি তার গালির কারণে পাথরের চেয়ে মূল্যহীন হন। মুশরিকরা তাদের প্রভুকে খেলার ছলেও গালি দেয় না, কারণ তারা প্রভুকে সম্মান করে। তাই যারা তাদের প্রভুকে গালি দেয়, তাদেরকে তারা গালি দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَلَا تَسُبُّواْ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ فَيَسُبُّواْ ٱللَّهَ عَدۡوَۢا بِغَيۡرِ عِلۡمٖۗ ١٠٨ ﴾ [الانعام: ١٠٨]

“আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত”।[13]

মুশরিকরা যদিও কাফির, তবু আল্লাহ তার নবীকে তাদের মূর্তিদের গালমন্দ করতে নিষেধ করেছেন, যেন তারা এরচেয়ে বড় কুফরিতে লিপ্ত না হয়, অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাবুদকে গালি দেওয়া।

*             আল্লাহকে গালমন্দ করার কতক শব্দ নাস্তিকতার চেয়েও বড় কুফরি, কারণ নাস্তিক তো সৃষ্টিকর্তা ও রবের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, অর্থাৎ তার অবস্থা বলে: ‘আমি যদি আল্লাহকে মানতাম, তাহলে অবশ্যই তাকে সম্মান করতাম’।

আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবী করে আল্লাহকে গালমন্দ করে, সে তার রবকে স্বীকার করেও তাকে গালি দেয়। এটা প্রকাশ্য অবাধ্যতা ও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া।

কোনো শহরের অলিতে-গলিতে, রাস্তায়, বাজারে ও মজলিসে আল্লাহর গালমন্দ প্রচার করা অপেক্ষা তাতে মূর্তি স্থাপন করা, তার চারপাশে তওয়াফ করা, তাকে সেজদা দেওয়া ও তার থেকে বরকত হাসিল করা আল্লাহর নিকট অতি সহজ, কারণ আল্লাহকে গালমন্দ করার স্পর্ধা শিরকের চেয়েও মারাত্মক, যদিও উভয় কাজ কুফরি, তবে মুশরিক আল্লাহকে সম্মান করে, গালমন্দকারী আল্লাহকে অসম্মান করে। আল্লাহ তাদের অসম্মান থেকে পবিত্র।

*             অনুরূপ কোনো শহরে জিনার বৈধতা দেওয়া ও তার প্রসার করা অপেক্ষা অধিক জঘন্য তাতে আল্লাহকে গালমন্দ করা ও তার প্রচার করা, বরং কওমে লুতের অশ্লীলতা ও তার অনুমোদন থেকেও জঘন্য। অশ্লীলতাকে হালাল মনে করা কুফরি, কারণ তাতে আল্লাহর শরীয়তকে অস্বীকার ও তার বিধানকে হেয় করা হয়। আবার গালমন্দও কুফরি, তবে গালমন্দের লক্ষ্য খোদ আল্লাহ তা‘আলা, যিনি শরীয়ত প্রদান করেন, তাই গালমন্দ করে শরীয়তদাতাকে হেয় করা হয়। শরীয়তদাতার সাথে কুফরি, মূলত তার সকল দীন ও বিধানের সাথে কুফরি ও তার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করা। এটা সবচেয়ে বড় পাপ, যদিও উভয় কর্ম কুফরি, কুফরির অনেক স্তর আছে, যেমন ঈমানের অনেক স্তর আছে।

*             আল্লাহ তা‘আলা নাসারাদের কুফরি ও আল্লাহর সন্তান সাব্যস্ত করে তাদের গালমন্দ করা উল্লেখ শেষে, তাদের অপরাধ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, মূর্তি ও নক্ষত্র পূজকদের শিরকের চেয়েও সন্তান সাব্যস্ত করে তাকে গালমন্দ করার পাপ অনেক বড়। তিনি বলেন:

﴿وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَلَدٗا ٨٨ لَّقَدۡ جِئۡتُمۡ شَيۡ‍ًٔا إِدّٗا ٨٩ تَكَادُ ٱلسَّمَٰوَٰتُ يَتَفَطَّرۡنَ مِنۡهُ وَتَنشَقُّ ٱلۡأَرۡضُ وَتَخِرُّ ٱلۡجِبَالُ هَدًّا ٩٠ أَن دَعَوۡاْ لِلرَّحۡمَٰنِ وَلَدٗا ٩١ وَمَا يَنۢبَغِي لِلرَّحۡمَٰنِ أَن يَتَّخِذَ وَلَدًا ٩٢ إِن كُلُّ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ إِلَّآ ءَاتِي ٱلرَّحۡمَٰنِ عَبۡدٗا ٩٣ لَّقَدۡ أَحۡصَىٰهُمۡ وَعَدَّهُمۡ عَدّٗا ٩٤ وَكُلُّهُمۡ ءَاتِيهِ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فَرۡدًا ٩٥ ﴾ [مريم: ٨٨،  ٩٥]

“আর তারা বলে, ‘পরম করুণাময় সন্তান গ্রহণ করেছেন’। অবশ্যই তোমরা এক জঘন্য বিষয়ের অবতারণা করেছ। এতে আসমানসমূহ ফেটে পড়ার, জমিন বিদীর্ণ হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কারণ তারা পরম করুণাময়ের সন্তান আছে বলে দাবী করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা পরম করুণাময়ের জন্য শোভনীয় নয়। আসমান ও জমিনে এমন কেউ নেই, যে বান্দা হিসেবে পরম করুণাময়ের কাছে হাযির হবে না। তিনি তাদের সংখ্যা জানেন এবং তাদেরকে যথাযথভাবে গণনা করে রেখেছেন। আর কিয়ামতের দিন তাদের সকলেই তার কাছে আসবে একাকী।[14]

কারণ আল্লাহর সন্তান দাবি করে তাকে হেয় ও গালমন্দ করা হয়। আল্লাহকে গালমন্দ করা অপেক্ষা তার সাথে শিরক করা গৌণ অপরাধ। মুশরিকরা মখলুককে উপরে তুলে আল্লাহর পর্যায়ে নিয়ে যায়, খৃস্টানরা সন্তান সাব্যস্ত করে আল্লাহকে মখলুকের স্থানে  নিয়ে আসে, যেন সেও মখলুক। মূর্তিপূজায় মখলুককে উপরে তুলে সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ করা হয়, তাই মখলুকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা অপেক্ষা আল্লাহর সম্মান হ্রাস করা বড় কুফরি।

আল্লাহকে গালমন্দ করা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ ঈমান পরিপন্থী এবং অন্তরের স্বীকৃতিরও বিপরীত, অর্থাৎ আল্লাহকে বিশ্বাস করা, তার অস্তিত্বের উপর ঈমান আনা ও একমাত্র তিনি ইবাদতের হকদার আকিদা পরিপন্থী। অনুরূপ গালমন্দ করা আভ্যন্তরীণ কর্মেরও বিপরীত, অর্থাৎ আল্লাহকে মহব্বত করা, তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর বিপরীত। আপনি যাকে গালমন্দ করেন, তার প্রতি আপনার সম্মানের ধারণা কখনো ঠিক নয়। উদাহরণত আল্লাহ ও পিতা-মাতার সম্মান, যে পিতা-মাতার মহব্বতের দাবি করে তাদের গালমন্দ ও উপহাস করে, সে কপট ও মিথ্যাবাদী। অনুরূপ আল্লাহকে গালমন্দ করা বাহ্যিক ঈমান, তথা কালিমার সাক্ষী ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল পরিপন্থী।

আল্লাহকে গালমন্দকারীর কুফরি প্রসঙ্গে সবাই একমত:

প্রত্যেক মাজহাবের আলেম, যারা বলেন কালিমার সাক্ষী ও আমল উভয় মিলে ঈমান, তাদের নিকট আল্লাহকে গালি দেওয়া কুফরি। গালিদাতার কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।

ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: “যে আল্লাহকে কিংবা কোনো নবীকে গালমন্দ করল, তাকে হত্যা কর”।[15]

ইব্‌ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মুজাহিদ রহ. বর্ণনা করেন: “যে কোনো মুসলিম আল্লাহকে কিংবা কোনো নবীকে গালমন্দ করল, সে আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যারোপ করল, এটা তার ধর্ম ত্যাগ। তার নিকট তওবা তলব করা হবে, যদি সে ফিরে আসে ভাল, অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে। আর যে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি[16] অবাধ্য হল ও আল্লাহকে গালমন্দ করল, কিংবা কোনো নবীকে গালমন্দ করল, অথবা গালমন্দ প্রকাশ করল, সে চুক্তি ভঙ্গ করল, অতএব তাকে হত্যা কর”।[17]

আল্লাহকে গালমন্দকারী সম্পর্কে ইমাম আহমদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেন: “আল্লাহকে গালমন্দকারী মুরতাদ, তাকে হত্যা করা হবে”।[18] তার ছেলে আব্দুল্লাহ এরূপই বর্ণনা করেছেন।

একাধিক আলেম গালমন্দকারীর কুফরি ও  তাকে হত্যা প্রসঙ্গে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন:

ইব্‌ন রাহাওয়ায়হে রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “সকল মুসলিম একমত যে, আল্লাহকে যে গালি দিল, অথবা তার রাসূলকে গালি দিল, অথবা আল্লাহর নাযিলকৃত কোন বস্তু প্রত্যাখ্যান করল, অথবা তার কোনো নবীকে হত্যা করল, সে কাফের; যদিও সে আল্লাহর নাযিলকৃত অহি বিশ্বাস করে”।[19]

কাদি ইয়াদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “এ প্রসঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই যে, কোনো মুসলিম আল্লাহকে গালমন্দ করলে কাফির পরিণত হবে, তার রক্ত হালাল”।[20]

আরো অনেক আলেম আল্লাহকে গালমন্দকারীর কুফরির উপর ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন, যেমন ইব্‌ন হাযম প্রমুখ। অনেক ইমাম গালমন্দকারীকে কাফির বলেছেন, যেমন ইব্‌ন আবি জায়েদাহ ও ইব্‌ন কুদামাহ প্রমুখ।[21]

সকল আলেম আল্লাহকে গালমন্দকারীর কুফরির উপর একমত। তারা গালমন্দকারীর কোনো অজুহাত গ্রহণ করেননি, কারণ সামান্য জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিও কোন্‌টি গালি ও কোন্‌টি গালি নয় পার্থক্য করতে সক্ষম, কোন্‌টি প্রশংসা ও কোন্‌টি কুৎসা ভালো করে জানে, তবু ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে গালমন্দ করে।

ইব্‌ন আবি জায়েদ মালিকিকে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যে কোনো ব্যক্তিকে লানত করার সাথে আল্লাহকেও লানত করে অজুহাত পেশ করেছে যে, আমার ইচ্ছা ছিল শয়তানকে লানত করা, কিন্তু আমার মুখ ফসকে গেছে।

ইব্‌ন আবি জায়েদ উত্তর দিলেন: “স্পষ্ট কুফরিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হবে, তার কোনো অজুহাত গ্রহণ করা যাবে না, মশকরা করে বলুক, অথবা ইচ্ছা করে বলুক”।[22]

অনুরূপ জাহিরিয়াহ ও চার মাজহাবের আলেম ও বিচারকগণ তাদের মাজহাব মোতাবেক বাহ্যিক দেখে ফতোয়া দেন ও ফয়সালা করেন, তারা আভ্যন্তরীণ অবস্থা আমলে নেন না, যদিও গালমন্দকারী বলে তার গালমন্দ করার ইচ্ছা ছিল না।

আলেমগণ যদি বাহ্যিক বিষয়গুলো অন্তরের দাবির কারণে ত্যাগ করেন, যা বাহ্যিকের বিপরীত, তাহলে শরয়ী আহকামের নাম, বিধান, শাস্তি ও হদগুলো বাতিল পরিণত হবে, মানুষের কোনো সম্মান ও অধিকার থাকবে না। কোনো মুসলিমকে কাফের থেকে, কোনো মুনাফিককে মুমিন থেকে পৃথক করা যাবে না। কপট ও অন্তরের ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকের মুখে দীন ও দুনিয়া খেলনায় পরিণত হবে।

গালমন্দ অনিচ্ছায়ও কুফরি:

আল্লাহকে গালমন্দ করা কুফরি, এতে কোনো দ্বিমত নেই। অনিচ্ছা অবহেলায় প্রকাশ পেয়েছে, আল্লাহর সম্মানে খারাপ ইচ্ছা ছিল না, সাধারণ লোকের এরূপ অজুহাতের কোনো মূল্য নেই।

এরূপ অজুহাত মূর্খতার প্রমাণ, জাহাম ইব্‌ন সাফওয়ান ও কট্টর মুরজিয়া ব্যতীত কেউ তা গ্রহণ করার পক্ষে নয়, যারা বলে: বিশ্বাস ও অন্তরের জ্ঞানই ঈমান। এটাও ঈমান সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার প্রমাণ, তারা জানে না: ‘কথা ও কর্মের সমন্বয়ে ঈমান’, অর্থাৎ মুখ ও অন্তর দ্বারা কালিমা শাহাদাতের স্বীকৃতি এবং অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আমল করাকে ঈমান বলা হয়।

কট্টর মুরজিয়াদের দৃষ্টিতে বাহ্যিক আমল ঈমানের দলিল নয়, তাই তারা অন্তর না দেখে ঈমান অস্বীকার করে না, বাহ্যিক কথার বিপরীত হলেও তারা অন্তরের দাবি বিশ্বাস করে।

বস্তুত ঈমানের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দু’টি অংশ। উভয়ের নাম ঈমান। একটির অনুপস্থিতিতে অপরটিকে ঈমান বলা হয় না।

কাফের যেরূপ কুফরির ইচ্ছা ও নিয়তের কারণে কাফির হয়, যদিও সে মুখে উচ্চারণ না করে, কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা কাজে পরিণত না করে; সেরূপ কথার কারণে ব্যক্তি কাফির হবে, যদিও সে কুফরির নিয়ত না করে, কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা কাজে পরিণত না করে। তাই যে কুফরি কাজ করে, সেও কাফির, যদিও সে কুফরির ইচ্ছা না করে, কিংবা মুখে না বলে।

শরীরের কোনো অঙ্গ হারাম কাজে লিপ্ত হলে তার বিচার হবে, তবে অন্তরের বিষয়টি আল্লাহর উপর সোপর্দ। কুফরি প্রকাশ পাওয়ার কারণে যাকে কাফির ফতোয়া দেওয়া হয়, সে আল্লাহর নিকটও কাফের হবে এরূপ জরুরি নয়, আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আল্লাহর উপর সোপর্দ, তবে দুনিয়ায় বাহ্যিক দেখে বান্দার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

যে আল্লাহর সাথে, তার কিতাবের সাথে ও তার রাসূলের সাথে উপহাস করে, আল্লাহ তাকে কাফির বলেছেন, অনিচ্ছার অজুহাত তিনি গ্রহণ করেননি, তিনি ইরশাদ করেন:

﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُمۡ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلۡعَبُۚ قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ إِن نَّعۡفُ عَن طَآئِفَةٖ مِّنكُمۡ نُعَذِّبۡ طَآئِفَةَۢ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ مُجۡرِمِينَ ٦٦﴾ [التوبة: 65،  95]

“আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বল, ‘আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ ও তার রাসূলের সাথে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে? তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফরি করেছ। যদি আমি তোমাদের থেকে একটি দলকে ক্ষমা করে দেই, তবে অপর দলকে আযাব দেব। কারণ, তারা হচ্ছে অপরাধী”।[23]

বিবেকও বলে মানুষকে তার কথার কারণে পাকড়াও করা হোক। আল্লাহ তা‘আলা বিনা দলিলে জিনার অপবাদদাতাকে আশি বেত্রাঘাত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যদিও সে বলে অপবাদ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না, অনুরূপ তার ঠাট্টা ও মশকরার নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়।

কোনো শাসক যদি তার ইজ্জত নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টাকারীকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়, তাহলে তার ভয় মানুষের অন্তর থেকে বিদায় নিবে। তাই আপনি দেখবেন এ জাতীয় অপরাধের কারণে তিনি মানুষকে শাস্তি দিচ্ছেন: তারা ইচ্ছায় বলুক বা অনিচ্ছায় বলুক।

মানুষকে তার অপরাধ ও জুলমের কারণে পাকড়াও করার বিষয়টি কুরআন ও সুন্নার একাধিক জায়গায় এসেছে। বিবেক এবং কুরআন ও সুন্নায় স্বীকৃত যে, আল্লাহর মর্যাদা ও সম্মানের ক্ষেত্রে অবহেলা কারীর কোনো অজুহাত গ্রহণ করা হবে না। সহি গ্রন্থে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللَّهِ لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا، يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ»

“নিশ্চয় বান্দা আল্লাহর অপছন্দনীয় এমন বাক্য উচ্চারণ করে, যার পরোয়া সে করে না, তার কারণে সে জাহান্নামের নিক্ষিপ্ত হয়”।[24]

এখানে দেখছি, বান্দা তার কথার কোনো পরোয়া করেনি, এ জন্য আল্লাহ তাকে ছাড় দেননি, বরং তার জন্য তিনি শাস্তি অবধারিত করেছেন। বান্দা তার কথার মূল্য ও তিক্ততা চিন্তা করেনি, অর্থ বুঝতে অবহেলা করেছে। সে যদি তার কথা চিন্তা করত ও সামান্য ভেবে দেখত, তাহলে তার কথার খারাপি সে বুঝত।

বেলাল ইব্‌ন হারেস নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:

«وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سُخْطِ اللَّهِ، مَا يَظُنُّ أَنْ تَبْلُغَ مَا بَلَغَتْ، فَيَكْتُبُ اللَّهُ تعالى عَلَيْهِ بِهَا سُخْطَهُ إِلَى يَوْمِ يَلْقَاهُ»

“নিশ্চয় তোমাদের কেউ আল্লাহর গোস্বার এমন বাক্য উচ্চারণ করে, সে চিন্তাও করে না বাক্যটি যেখানে পৌঁছেছে সেখানে পৌঁছবে, ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তার উপর তার সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত স্বীয় গোস্বা অবধারিত করে দেন”।[25]

অতএব মানুষের বলা যে, আল্লাহ তা‘আলাকে গালমন্দ করা, লানত করা, হেয় করা অথবা অপমান করার ইচ্ছা ব্যতীত মুখের উপর চলে এসেছে, এ জাতীয় অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়, এটাও তার এক ধরণের বাহানা, যা ইবলিস তার অন্তরে সৃষ্টি করে। ইবলিস এভাবে তাকে কুফরির উপর অটল রাখে, আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতায় তাকে সান্তনা দেয়। বস্তুত শয়তান মানুষকে যখন কুফরির প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, সে তার সামনে অসার অযৌক্তিক কতক অজুহাত ও শরয়ী অপব্যাখ্যা তৈরি করে দেয়, যা প্রবৃত্তি মুক্ত সুস্থ বিবেকের সামনে টিকে না।

ইবলিসের প্ররোচনা ও সন্দেহ সৃষ্টি:

মানুষ যখন কোনো অপরাধ করে, ইবলিস তার সামনে তার কৃত ইবাদতগুলো পেশ করে, যা তার পাপের আফসোস ও গুনাহের কারণে সৃষ্ট দুঃখ তার অন্তর থেকে দূর করে দেয়। উদাহরণত আল্লাহকে গালমন্দকারীকে সে বলে: ‘তুমি শাহাদাতের কালিমাহ উচ্চারণ কর, পিতা-মাতার আনুগত্য কর ও সালাত আদায় কর, তোমার এতে সমস্যা হবে না’।

শয়তানের এরূপ প্ররোচনার কারণে মক্কার মুশরিকরা গোমরাহ হয়েছে। তারা আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তির ইবাদত করেছে, আর শয়তান তাদের সামনে হাজিদের পানি পান করানো, মসজিদে হারাম আবাদ করা ও কাবায় পোশাক পড়ানোর ন্যায় ভালো কাজগুলো পেশ করেছে, অথচ শিরকের মোকাবিলায় এগুলো আল্লাহর নিকট তাদের কোনো উপকারে আসেনি। কারণ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা তার সম্মান পরিপন্থী, তারা বায়তুল্লাহকে সম্মান করে তার রবের সাথে কুফরি করেছে। অথচ রবের কারণে বায়তুল্লাহ সম্মানিত হয়েছে, বায়তুল্লাহর কারণে রব সম্মানিত হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿أَجَعَلۡتُمۡ سِقَايَةَ ٱلۡحَآجِّ وَعِمَارَةَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ كَمَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَجَٰهَدَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ لَا يَسۡتَوُۥنَ عِندَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٩﴾ [التوبة: 19]

“তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো ও মসজিদুল হারাম আবাদ করাকে ঐ ব্যক্তির মত বিবেচনা কর, যে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তরা আল্লাহর কাছে বরাবর নয়। আর আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়েত দেন না”।[26]

কতক মানুষের ঈমানের দাবী‌ই সর্বস্ব, তাদের মধ্যে ঈমানের কোনো আলামত নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨﴾ [البقرة: ٨]

“আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি, অথচ তারা মুমিন নয়”।[27]

অতএব আল্লাহকে গালমন্দ ও উপহাস করে, কালিমা শাহাদাত উচ্চারণ ও তাকে সম্মান দেখানোর কোনো অর্থ হয় না।

আল্লাহকে গালমন্দকারীর শাস্তি:

সকল আলেম একমত যে, আল্লাহকে যে গালমন্দ করবে, তাকে কুফরির কারণে হত্যা করা হবে, হত্যার পর মুসলিমদের হুকুম তার জন্য প্রযোজ্য হবে না, যেমন তার উপর সালাত পড়া, তাকে গোসল ও কাফন-দাফন দেওয়া, তার জন্য দোয়া করা ইত্যাদি। সে মুসলিম নয়, তাই তার উপর সালাত পড়া হবে না, তাকে গোসল ও মুসলিমদের কবর স্থানে দাফন করা হবে না এবং তার জন্য দোয়া করা বৈধ নয়।

আল্লাহকে গালমন্দকারী যদি জঘন্য কথা ও কর্ম থেকে তওবা করে, তার তওবা কুবল করা হবে কিনা এ ব্যাপারে আলেমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন। মৃত্যুদণ্ডের পূর্বে তার থেকে তওবা তলব করা হবে, না দুনিয়ায় তার তওবার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে, আখিরাতে তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর সোপর্দ করে, তাকে হত্যা করা হবে? এ ব্যাপারে দু’টি মত প্রসিদ্ধ:

প্রথম মত: তার তওবার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হবে না, তওবা তলব করা ব্যতীত তাকে হত্যা করা ওয়াজিব, তার তওবা আখিরাতে আল্লাহর উপর সোপর্দ। ইহা হাম্বলি মাজহাব ও অন্যান্য ফকিহদের প্রসিদ্ধ অভিমত। ওমর, ইব্‌ন আব্বাস ও অন্যান্যদের বাহ্যিক অভিমত তাই, এটা ইমাম আহমদের প্রসিদ্ধ মত।

কারণ: তওবা বাহ্যিক অপরাধ রহিত করে না, মানুষের সামনে আল্লাহকে গালমন্দ ও তাকে উপহাস করার কু-প্রভাব অপনোদন করে না। তওবা কবুল করা হলে এ জাতীয় অপরাধ মানুষ শিথিল মনে করবে। তাদেরকে যখন সরকার ও বিচারের সম্মুখীন করা হবে, তারা তওবা প্রকাশ করবে, অতঃপর তওবা ত্যাগ করবে। তাই এ সুযোগ তাদেরকে কুফরির উপর উদ্বুদ্ধ করে গালমন্দ করার অপরাধবোধ গৌণ করে দেয়। অপরাধীকে আদব শিক্ষা দেওয়া ও অপরাধ থেকে পবিত্র করা এবং যে তার কথার ন্যায় কথা বলে, কিংবা তার কর্মের ন্যায় কর্ম করে, তাকে বিরত রাখা ইত্যাদি উদ্দেশ্যগুল তওবা কবুল করা হলে ব্যাহত হয়।

দ্বিতীয় মত: যদি সে সত্য তওবা করে এবং কখনো তাতে লিপ্ত না হয়, তাহলে গ্রহণ করা হবে, জমহুর ফকিহগণ এ কথা বলেন।

কারণ: গালমন্দ করা কুফরি, কুফরি থেকে প্রত্যেক কাফিরের তওবা গ্রহণযোগ্য, যেমন মুশরিক, মূর্তিপূজক ও নাস্তিকরা তওবা করে ইসলামে দাখিল হয়। তাদের ইসলাম পূর্বেকার সকল কুফরি মিটিয়ে দেয়। আল্লাহ তওবাকারীর তওবা কবুল করেন ও তাকে ক্ষমা করেন। আল্লাহকে গালমন্দকারী তার অধিকারে ত্রুটি করে, আল্লাহ মুশরিক ও তাকে গালমন্দকারীর তওবা কবুল করেন, অতএব তার তওবাও কবুল করবেন স্বাভাবিক।

তবে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দ করার বিষয় আলাদা, এটা তার অধিকার, তাই এ জন্য তাকে পাকড়াও করা হবে, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করেননি, তার মৃত্যু হয়ে গেছে।

মূলনীতি:

রাসূলকে গালমন্দ করা কুফরি, তার হক উসুল করে গালিদাতাকে হত্যা করা ওয়াজিব। দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দকারী মানুষের অন্তরে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে ও তাকে হেয় করে, পক্ষান্তরে আল্লাহকে গালমন্দকারী নিজের ক্ষতি করে।

মুদ্দাকথা: যে আল্লাহকে গালমন্দ করে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব, তার তওবা গ্রহণ করা হবে না, তার তওবা আল্লাহর নিকট সোপর্দ, সে তার নিয়তের সাথে আল্লাহর সাক্ষাত করবে, অতঃপর আল্লাহ তার সাথে ইনসাফ কিংবা ক্ষমার ব্যবহার করবেন।

আল্লাহকে গালমন্দকারী যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও পাকড়াও করার পূর্বে তওবা করে প্রকাশ করে দেয়, তাহলে গ্রহণযোগ্য, কারণ তার তওবার সত্যতা প্রকাশ পেয়েছে। তার হুকুম স্বেচ্ছায় ইসলামে প্রবেশকারী কাফিরদের ন্যায়, তারা মুসলিম হয়ে ইসলাম-পূর্বে গালমন্দ করার কথা স্বীকার করত।

গালমন্দ দু’প্রকার:

১. প্রত্যক্ষ গালমন্দ: যেমন তাকে লানত করা, তার কুৎসা রটনা করা, তার সাথে উপহাস করা ও তাকে হেয় করা। এর হুকুম পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহকে গালমন্দ করা দ্বারা এ প্রকার উদ্দেশ্য।

২. পরোক্ষ গালমন্দ: যেমন আল্লাহ সরাসরি যেসব নিদর্শন ও মখলুক পরিচালনা করেন, মানুষের ইচ্ছা ও অর্জনের ন্যায় যাদের কোন ইচ্ছা ও অর্জন নেই, যেমন যুগ, দিন, সময়, মুহূর্ত, মাস, বছর এবং তারকা ও তাদের সন্তরণকে গালমন্দ করা। এ প্রকার গালমন্দের হুকুম পূর্বের ন্যায় নয়, যেমন গালমন্দকারীর কুফরি ও তাকে হত্যা করা ওয়াজিব নয়, তবে যদি এসবের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রণকারী, তথা আল্লাহকে স্পষ্ট বলে, তাহলে ভিন্ন কথা।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«قَالَ اللَّهُ تعالى: يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ يَسُبُّ الدَّهْرَ، وَأَنَا الدَّهْرُ بِيَدِي الْأَمْرُ أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ»

 “আল্লাহ বলেন: ইব্‌ন আদম আমাকে কষ্ট দেয়, সে যুগকে গালি দেয়, অথচ আমিই যুগ, আমার হাতে কর্তৃত্ব, আমি রাত-দিনকে পরিবর্তন করি”।[28]

অপর বর্ণনা আছে:

«يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ، يَقُولُ: يَا خَيْبَةَ الدَّهْرِ، فَلَا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمْ: يَا خَيْبَةَ الدَّهْرِ، فَإِنِّي أَنَا الدَّهْرُ، أُقَلِّبُ لَيْلَهُ وَنَهَارَهُ، فَإِذَا شِئْتُ قَبَضْتُهُمَا»

“ইব্‌ন আদম আমাকে কষ্ট দেয়, সে বলে: হে যুগের অনিষ্ট। অতএব তোমাদের কেউ যেন না বলে: হে যুগের অনিষ্ট, কারণ আমিই যুগ, আমি তার রাত ও দিন পরিবর্তন করি। আমি যখন ইচ্ছা করব ঘুটিয়ে নিব”।[29]

নক্ষন্ত্রসমূহ যেমন চাঁদ-সূর্য এবং তাদের নিদর্শনসমূহ যেমন রাত-দিন ও যুগসমূহ স্বাধীন নয়, এগুলো আল্লাহর ইচ্ছাধীন, তাদের কোনো ইচ্ছা ও উপার্জন নেই। তাদেরকে পার্থিব বিষয় ব্যতীত কোনো নির্দেশ দেওয়া হয় না, আল্লাহর আনুগত্য থেকে বের হওয়ার সুযোগ তাদের নেই।

অতএব এগুলোকে গালমন্দ করা মূলত তাদের পরিচালক ও নির্দেশদাতাকে গালমন্দ করা এবং আল্লাহর হিকমত ও তার ইচ্ছায় আপত্তি করা। এ জন্য যুগকে গালমন্দ করা আল্লাহ নিজেকে গালমন্দ করা গণ্য করেন।

মানুষকে গালমন্দ করা আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে গালমন্দ করা গণ্য করেন না, কারণ মানুষের ইচ্ছা ও স্বাধীনতা রয়েছে, যা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 ﴿ وَمَا تَشَآءُونَ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢٩ ﴾ [التكوير: ٢٩]

“আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন”।[30]

পক্ষান্তরে নক্ষত্রসমূহ যেমন চাঁদ ও সূর্য, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারে বলেছেন:

﴿لَا ٱلشَّمۡسُ يَنۢبَغِي لَهَآ أَن تُدۡرِكَ ٱلۡقَمَرَ وَلَا ٱلَّيۡلُ سَابِقُ ٱلنَّهَارِۚ وَكُلّٞ فِي فَلَكٖ يَسۡبَحُونَ ٤٠﴾ [يس: ٤٠]

“সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই কক্ষপথে ভেসে বেড়ায়”।[31]

আল্লাহ ও তার গুণগানকে সম্মান করা ওয়াজিব:

*     আল্লাহর সম্মান যেমন: তার পরিকল্পনা, আদেশ ও নিষেধকে সম্মান করা ও বাস্তবায়ন করা, তার নির্দেশ অতিক্রম না করা, যার জ্ঞান মানুষের নেই, সে বিষয়ে তাদের ঘাটাঘাটি না করা।

*     আল্লাহর সম্মান যেমন: তাকে স্মরণ করা, তার নিকট প্রার্থনা করা এবং দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকাণ্ড তার সাথে সংশ্লিষ্ট করা। তিনি এ জগতের স্রষ্টা ও পরিচালক, তার কোনো অংশীদার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٧﴾ [الزمر: ٦٦]

“আর তারা আল্লাহকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তার মুষ্টিতে এবং আকাশসমূহ তার ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। তিনি পবিত্র, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের ঊর্ধ্বে।[32]

এখানেই আমরা সংক্ষিপ্ত এ পুস্তিকার সমাপ্তি করছি। একমাত্র তিনিই সাহায্যকারী ও সঠিক পথে পরিচালনাকারী, তার কোন শরীক নেই, তার নিকট ইখলাস ও ব্যাপক প্রসারতা আশা করছি।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করুন, তার পরিবার ও তার সাথীদের উপর এবং যারা ইহসানের সাথে কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করবে, সবার উপর।

সমাপ্ত


[1] সূরা যারিয়াত: (২১)

[2] সূরা নূহ: (১৪-১৫)

[3] আদ-দুররুল মানসুর: (৮/২৯০-২৯১)

[4] জামেউল বায়ান’ লিত তাবারি: (২৩/২৯৬), মা‘আলিমুত তানযিল লিল বগভি: (৫/১৫৬)

[5] সূরা ইউসুফ: (১০৪)

[6] সূরা হজ: (৭৩-৭৪)

[7]  হজকারীর কুরবানির পশুকে আরবিতে হাদি বলা হয়।

[8] সূরা হজ: (৩২)

[9] বর্তমান নাম সিরিয়া, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন ও লেবাননকে শাম বলা হত।

[10] সূরা আহযাব: (৫৭-৫৮)

[11] মুসলিম: (২৫৭৭)

[12] সূরা আশ-শু‘আরা: (৯৭-৯৮)

[13] সূরা আন‘আম: (১০৮)

[14] সূরা মারইয়াম: (৮৮-৯৫)

[15] আস-সারেমুল মাসলুল: (পৃ.১০২)

[16] মুসলিম দেশে জিযইয়াহ প্রদানের শর্তে বসবাসকারী অমুসলিম ব্যক্তি মু‘আহিদ, তাকে জিম্মিও বলা হয়।

[17]  আস-সারেমুল মাসলুল: (পৃ.১০২)

[18]  আস-সারেমুল মাসলুল: (পৃ.৪৩১)

[19] আত-তামহিদ লি-ইব্‌ন আব্দুল বারর: (৪/২২৬), আল-ইসতেজকার লি-ইব্‌ন আব্দুল বারর: (২/১৫০)

[20] আশ-শিফা: (২/২৭০)

[21] আল-মুহাল্লা লি-ইব্‌ন হাযম: (১১/৪১১), আল-মুগনি লি-ইব্‌ন কুদামাহ: (৯/৩৩), আস-সারেমুল মাসলুল লি ইব্‌ন তাইমিয়াহ: (পৃ.৫১২), আল-ফুরু লি-ইব্‌ন মুফলিহ: (৬/১৬২), আল-ইনসাফ লিল-মুরাদাওয়ি: (১০/৩২৬), আত-তাজ ওয়াল ইকলিল লিল-মাওওয়াক: (৬/২৮৮)

[22] আশ-শিফা লি-ইয়াদ: (২/২৭১)

[23] সূরা তওবা: (৬৫-৬৬)

[24] সহি বুখারি: (৬৪৭৮), সহি মুসলিম: (২৯৮৮), সংক্ষিপ্ত।

[25] মুসনাদে আহমদ: (৩/৪৬৯), হাদিস নং: (১৫৮৫২), সহি ইব্‌ন হিব্বান: (২৮০)

[26] সূরা তওবা: (১৯)

[27] সূরা বাকারা: (৮)

[28] বুখারি: (৪৮২৬), (৭৪৯১), মুসলিম: (২২৪৬)

[29] সহি মুসলিম: (২২৪৬)

[30] সূরা তাকবীর: (২৯)

[31] সূরা ইয়াসীন: (৪০)

[32] সূরা যুমার: (৬৭)

অমুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি ইসলামের উদারতা

$
0
0

লেখকঃ আলী হাসান তৈয়ব |  সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

picture 1

একটি মুসলিম দেশে ইসলাম মুসলিমকে শুধু অমুসলিমদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতেই বলে না, রাষ্ট্রে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধিও নিশ্চিত করে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহয় একাধিক স্থানে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার তুলে ধরা হয়েছে। অমুসলিমরা নিজ নিজ উপাসনালয়ে উপাসনা করবেন। নিজ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মালয়কে সুরক্ষিত রাখবেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা সমান। তাদের প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য ইসলাম বরদাশত করে না। যেসব অমুসলিমের সঙ্গে কোনো সংঘাত নেই, যারা শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিমদের সঙ্গে বসবাস করেন তাদের প্রতি বৈষম্য দেখানো নয়; ইনসাফ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ لَّا يَنۡهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ وَلَمۡ يُخۡرِجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ أَن تَبَرُّوهُمۡ وَتُقۡسِطُوٓاْ إِلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ ٨ ﴾ [الممتحنة: ٨] 

‘আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সঙ্গে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদের বের করে দেয় নি। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। {সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত : ৮}

আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের দাবিদার প্রতিটি মুসলিমকে নির্দেশ দিয়েছেন পরমতসহিঞ্চুতা ও পরধর্মের বা মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। আল্লাহ ইরশাদ করেন,

﴿ وَلَا تَسُبُّواْ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ فَيَسُبُّواْ ٱللَّهَ عَدۡوَۢا بِغَيۡرِ عِلۡمٖۗ كَذَٰلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمۡ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّهِم مَّرۡجِعُهُمۡ فَيُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٠٨ ﴾ [الانعام: ١٠٨] 

‘তারা আল্লাহ তা‘আলার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহ তা‘আলাকেও গালি দেবে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই তাদের কার্যকলাপ সুশোভনীয় করে রেখেছি, অতঃপর সবাইকে একদিন তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে, তারপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কে কী কাজ করে এসেছে’। {সূরা আল আন‘আম, আয়াত : ১০৮}

কোনো বিধর্মী উপসনালয়ে সাধারণ অবস্থা তো দূরের কথা যুদ্ধাবস্থায়ও  হামলা করা যাবে না। কোনো পুরোহিত বা পাদ্রীর প্রতি অস্ত্র তাক করা যাবে না। কোনো উপসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া যাবে না। হাবীব ইবন অলীদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যদল প্রেরণকালে বলতেন,

«انْطَلِقُوا بِسْمِ اللَّهِ وَبِاللَّهِ، وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ، تُقَاتِلُونَ مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ، أَبْعَثُكُمْ عَلَى أَنْ لَا تَغُلُّوا، وَلَا تَجْبُنُوا، وَلَا تُمَثِّلوا، وَلَا تَقْتُلُوا وَلِيدًا، وَلَا تَحْرِقُوا كَنِيسَةً، وَلَا تَعْقِرُوا نَخْلًا»

‘তোমরা আল্লাহ ও আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে যাত্রা কর। তোমরা আল্লাহর প্রতি কুফরকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি : (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, (শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না।’ [আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ : ৯৪৩০]

এদিকে মুওতার যুদ্ধে রওনার প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন :

« وَلاَ تَقْتُلُوا امْرَأَةً وَلاَ صَغِيرًا ضَرَعًا وَلاَ كَبِيرًا فَانِيًا وَلاَ تَقْطَعُنَّ شَجَرَةً وَلاَ تَعْقِرُنَّ نَخْلاً وَلاَ تَهْدِمُوا بَيْتًا ».

‘তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’ [মুসলিম : ১৭৩১]

আরেক হাদীসে আছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

« كَانَ إذَا بَعَثَ جُيُوشَهُ ، قَالَ : لاَ تَقْتُلُوا أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ ».

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কোনো বাহিনী প্রেরণ করলে বলতেন, ‘তোমরা গির্জার অধিবাসীদের হত্যা করবে না।’ [ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ : ৩৩৮০৪; কিতাবুল জিহাদ, যুদ্ধক্ষেত্রে যাদের হত্যা করা নিষেধ অধ্যায়]

আবূ বকর রাদিআল্লাহু আনহুও একই পথে হাঁটেন। আপন খিলাফতকালে প্রথম যুদ্ধের বাহিনী প্রেরণ করতে গিয়ে তিনি এর সেনাপতি উসামা ইবন যায়েদ রাদিআল্লাহু আনহুর উদ্দেশে বলেন,

يا أيها الناس، فقوا أوصيكم بعشر فاحفظوها عني: لا تخونوا ولا تغلوا ولا تغدروا، ولا تمثلوا ولا تقتلوا طفلاً صغيراً، ولا شيخاً كبيراً ولا امرأة، ولا تعزقوا نخلاً ولا تحرقوه، ولا تقطعوا شجرة مثمرة، ولا تذبحو شاة ولا بقرة، ولا بعيراً إلا لمآكله. وسوف تمرون بأقوام قد فرغوا أنفسهم في الصوامع فدعوهم وما فرغوا أنفسهم له.

‘হে লোক সকল, দাঁড়াও আমি তোমাদের দশটি বিষয়ে উপদেশ দেব। আমার পক্ষ হিসেবে কথাগুলো তোমরা মনে রাখবে। কোনো খেয়ানত করবে না, বাড়াবাড়ি করবে না, বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, (শত্রুদের) অনুরূপ করবে না, ছোট বাচ্চাকে হত্যা করবে না, বয়োবৃদ্ধকেও না আর নারীকেও না। খেজুর গাছ কাটবে না কিংবা তা জ্বালিয়েও দেবে না। কোনো ফলবতী গাছ কাটবে না। আহারের প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাগল, গরু বা উট জবাই করবে না। আর তোমরা এমন কিছু লোকের সামনে দিয়ে অতিক্রম করবে যারা গির্জাগুলোয় নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তোমরাও তাদেরকে তাদের এবং তারা যা ছেড়ে নিজেদের জন্য তাতে ছেড়ে দেবে। [মুখতাসারু তারীখি দিমাশক : ১/৫২; তারীখুত তাবারী]

কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করেন, তবে রোজ কিয়ামতে খোদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিপক্ষে লড়বেন বলে হাদীসে এসেছে। একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَلَا مَنْ ظَلَمَ مُعَاهِدًا، أَوِ انْتَقَصَهُ، أَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ، أَوْ أَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ، فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»

‘সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন  করব।’ [আবূ দাঊদ : ৩০৫২]

অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا لَمْ يَرِحْ رَائِحَةَ الجَنَّةِ، وَإِنَّ رِيحَهَا تُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ أَرْبَعِينَ عَامًا»

‘যে মুসলিম কর্তৃক নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব থেকে’। [বুখারী : ৩১৬৬]

আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবী বাকরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ قَتَلَ مُعَاهِدًا فِي غَيْرِ كُنْهِهِ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ»

‘যে ব্যক্তি চুক্তিতে থাকা কোনো অমুসলিমকে অসময়ে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’। [আবূ দাঊদ : ২৭৬০; নাসাঈ : ৪৭৪৭, শাইখ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]

ঐতিহাসিক বিদায় হজের দীর্ঘ ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজ ও রাষ্ট্রের সব দিক ও বিভাগ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মাতাপিতার হক, সন্তান-সন্ততির হক, আত্মীয়-স্বজনদের হক, অনাথ ও দরিদ্রদের হক, প্রতিবেশীর হক, মুসাফিরের হক, চলার পথের সঙ্গী বা পথচারীর হক, দাস-দাসী বা চাকর-চাকরানীর  হক এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমের হক সম্পর্কেও নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে মুসলিমদের কাছে অমুসলিমদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে আমানত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলিমদের তিনি অমুসলিমদের নিরাপত্তা দানের নির্দেশ দিয়েছেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনে অমুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের ইজ্জত-আব্রু ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ অমুসলিম জনগোষ্ঠী তারাও মানুষ, তারাও আল্লাহর বান্দা। ইসলাম সম্পর্কে তারা ভুল বা বিভ্রান্তির শিকার হলে তাদের প্রতি আক্রমণ না করে তাদেরকে মূল সত্য এবং ইসলামের মহানুভবতা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

ইসলামের দৃষ্টিকোণে দুনিয়ায় মানুষের প্রাণ হরণ কিংবা জীবন নাশের চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না। পবিত্র কুরআনে তাই একজন মানুষের হত্যাকে পুরো মানবজাতির হত্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ مَن قَتَلَ نَفۡسَۢا بِغَيۡرِ نَفۡسٍ أَوۡ فَسَادٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ ٱلنَّاسَ جَمِيعٗا وَمَنۡ أَحۡيَاهَا فَكَأَنَّمَآ أَحۡيَا ٱلنَّاسَ جَمِيعٗاۚ ﴾ [المائ‍دة: ٣٢]   

‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল’। {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৩২}

মানুষের প্রাণহানী ঘটানোকে যেখানে বলা হয়েছে পুরো মানব জাতিকে হত্যার সমতুল্য, সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে গণ্য করা হয়েছে হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হিসেবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ وَٱلۡفِتۡنَةُ أَشَدُّ مِنَ ٱلۡقَتۡلِۚ ﴾ [البقرة: ١٩١] 

‘আর ফিতনা হত্যার চেয়ে কঠিনতর’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯১}

অতএব বাংলাদেশের রামুতে একটি অন্যায়কে কেন্দ্র করে যা করা হয়েছে, তাও ন্যায়সঙ্গত হয়নি। একজনের অপরাধে দশজনকে শাস্তি প্রদান কোনো মুসলিমের কাছে সমর্থনযোগ্য নয়। বিভিন্ন সময় দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে পূজোমণ্ডপে অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা হয়। প্রতিমা ভাংচুর করে দুষ্কৃতকারীরা। এসব কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ নষ্ট করে। পৃথিবীর কাছে একটি মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ছোট করে। ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমরা ভুল বার্তা পান।

জানা যায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ ইং রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় দুষ্কৃতকারীদের একাধিক দল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ১২টি বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। পুড়িয়ে দেয় বৌদ্ধ পল্লীর ৪০টির মতো বসতবাড়ি। ভাংচুর চালায় আরও কিছু বাড়িঘরে। টেকনাফ, উখিয়া, পটিয়াতেও এমন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, শনিবার রাত ১০টার কাছাকাছি সময় থেকে বৌদ্ধ মন্দির, স্থানীয় ভাষায় যাকে কিয়াং বলা হয়, তার ওপর আক্রমণ হয়েছে। কিছু হিন্দু মন্দিরও এ আক্রমণের আওতায় পড়েছে এবং একই সঙ্গে আগুন লাগানো ও লুটতরাজের মতো ঘটনাও ঘটেছে। টেকনাফের হোয়াইক্যং নামের একটি জায়গায় পুলিশের গুলি চালাতে হয়েছে এবং উখিয়ায় দু’জন পুলিশসহ ১২ জন আহত হন। এসব স্থানে কর্তৃপক্ষকে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে।

ঘটনার পর থেকেই দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী এর নিন্দা জানিয়েছে। দেশের শীর্ষ উলামায়ে কিরাম এবং ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও এ কাজের নিন্দা জানিয়েছেন। আমরাও মনে করি এ ঘটনা চরম নিন্দনীয়। ইসলামের আদর্শই হচ্ছে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে সম্প্রীতি। এ সম্প্রীতি ধ্বংসের কোনো উস্কানি আর অন্যায় প্রতিক্রিয়া সবই শাস্তিযোগ্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও উদারনৈতিক শিক্ষার সৌজন্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতার জন্য বরাবর সারা বিশ্বের সুনাম কুড়িয়েছে। এ দেশের মুসলিম সবসময় তাদের ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এ দেশে মসজিদ-মন্দিরে পাশাপাশি স্ব-স্ব ধর্মের ইবাদত হয়। পবিত্র মাহে রমজানে হিন্দুরা সাড়ম্বরে অষ্টমী পালন করে। খ্রিস্টানরা জাঁকজমকভাবে বড়দিন উদযাপন করেন। বৌদ্ধ ও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নিজ নিজ ধর্মীয় উত্সব নির্বিবাদে পালন করেন।

পক্ষান্তরে আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতে ক’দিন পরপরই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু কর্তৃক মুসলিমরা আক্রান্ত হন, আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারে এই সেদিনও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সাধারণ বৌদ্ধ থেকে নিয়ে শান্তিপ্রিয় হিসেবে খ্যাত ভিক্ষুরা পর্যন্ত নির্বিচার হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালাল মুসলিমের বিরুদ্ধে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নারী-শিশু-বৃদ্ধকে অকাতরে হত্যা করা হয়েছে। এ দেশের কোটি মুসলিমের হৃদয় কেঁদেছে তখন, তবে কেউ এ দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু বা বৌদ্ধদের ওপর সে ক্ষোভ দেখান নি।

আমেরিকায় মহানবীকে সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবমাননা করে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘটনায় যখন সারা বিশ্ব উত্তাল, বিশ্বের দুইশ’ কোটি মুসলিমের হৃদয়ে যখন জ্বলছে ক্ষোভের দাবানল, তখন একের পর এক ফ্রান্সের সাপ্তাহিকে, তারপর স্পেনের একটি ম্যাগাজিনে মহানবীর ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশের ঘটনা বিশ্ব মুসলিমকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। বাকস্বাধীনতার নামে অন্যের পবিত্র ধর্মানুভূতিতে আঘাত কোনো ধর্মই অনুমোদন করে না। তারপরও ঘটছে এমন ঘটনা। স্বল্প বিরতিতে ক’দিন পরপরই ঘটছে এর পুনরাবৃত্তি। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল রামুতে শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উত্তম বড়ুয়া নামের এক অখ্যাত কুলাঙ্গার এমন এক ঘটনা ঘটিয়েছে যা এ অঞ্চলের সর্বশ্রেণীর মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।

উত্তম বড়ুয়ার বর্বর ঘটনার পর নিন্দা ও প্রতিবাদের বিষয়টি স্বাভাবিক, সমর্থনযোগ্য এবং করণীয়ও বটে। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিয়ে নির্বিচারে সহিংসতা অন্যায়। একজনের অপরাধে দশজনকে শাস্তি দেওয়া অনুমোদিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا يَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنَ‍َٔانُ قَوۡمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعۡدِلُواْۚ ٱعۡدِلُواْ هُوَ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ٨ ﴾ [المائ‍دة: ٨] 

‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর। এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত’। {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৮}

এমন ঘটনার পর সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো ঘটনার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানো এবং ওই ব্যক্তিকে আইনের কাছে সোপর্দ করা। এ ধরনের অপরাধের ভয়াবহতা, পবিত্র কুরআনের মাহাত্ম্য, মহানবীর মহানুভবতা এবং ইসলামের উদারতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও ওয়াকিফ করা।

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, উত্তম কুমার বড়ুয়া অনুত্তম কাজ করলেও রাষ্ট্র্র ও আন্তর্জাতিক সাহায্যপুষ্ট এনজিও, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া এ কাজের যথাযথ নিন্দা জানায় নি। তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করার কথা বলে নি। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, উত্তমের বর্বর কাণ্ডের পর যে সহিংস প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে গেছে। আর সব রাজনৈতিক ইস্যুর মতো এ নিয়েও পরস্পরকে দোষারোপের চর্চা চলেছে। ইসলামকে রাজনীতির বলি বানানো হয়েছে!

পশ্চিমা বিশ্ব যেমন যে কোনো দুর্ঘটনার পেছনে জঙ্গিবাদ খুঁজে বেড়ায়, ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চান, সন্ত্রাসের মূল কারণ উদ্ঘাটন ও উত্পাটন না করে ছায়া শত্রুর পেছনে লেগে থেকে শত্রু বৃদ্ধি করেন। আমরাও কেন যেন এমন ঘটনার পেছনে না গিয়ে ছায়া শত্রুদের গালাগাল করছি। বাংলাদেশে সর্বশেষ এক বছরে মানিকগঞ্জে, তারপর মৌলভীবাজারে এবং সর্বশেষ রামুতে মুসলিমের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা ঘটল। ঘটনাগুলোর যথাযথ প্রতিকার, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হলে হয়তো পরবর্তী ঘটনার অবতারণা হতো না।

সরকারকে ইসলাম অবমাননার উস্কানি সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের অপরাধীকে তাত্ক্ষণিক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষুব্ধতা কিংবা আবেগের ভুল প্রয়োগের পথও বন্ধ হবে। বিশেষত এ ধরনের ঘটনা থেকে দেশি-বিদেশি যে ষড়যন্ত্রকারী মহল ফায়দা লুটতে চায়, তাদেরও গতি রোধ করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি সদাচার ও সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধনকে অটুট রাখতে সবাইকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। আল্লাহ সকল মুসলিম ইসলামের উদারতা ও মহানুভতা সবার সামনে তুলে ধরার তাওফীক দান করুন। আমীন।

উৎসঃ ইসলাম হাউজ

হারাম খাবার যে জন্য নিষিদ্ধ

$
0
0
Dinner
লেখক: আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান | সম্পাদক: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার, তার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি, তার নিকট ক্ষমা চাই, আমাদের অন্তরের অনিষ্ট এবং মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ তাআলা যাকে হেদায়েত দেবেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করবেন সে কাউকে তার সাহায্যকারী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে পাবে না।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ এক, তার কোন শরিক নেই। এবং কথারও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর দয়া ও অধিক পরিমাণ সালাম তার উপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সাহাবাদের উপর বর্ষিত হউক।

হে মুসলমানেরা!

আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা একমাত্র তারই ইবাদত করে, এবং তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আল্লাহ তাআলা যা রিযক দিয়েছেন তার মধ্য থেকে হালাল ভক্ষণ করে, অপবিত্র এবং হারাম থেকে বেচেঁ থাকে, আল্লাহ তাআলা বলেন:

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ سورة الأعراف: 157.

"যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী, যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে।" [সূরা আল আরাফ ১৫৭ আয়াত ]

হে আল্লাহর বান্দারা!

প্রত্যেক মুসলমানের উপর হালাল উপার্জন করা ওয়াজিব যদিও তা কষ্টকর হয়। বাস্তবে হালাল উপার্জন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু দিন থেকে আমরা দুরে থাকার কারণে এবং বস্তুগত মাধ্যমের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হয়ে পড়ার কারণে এবং নীতিবোধ উঠে যাওয়ার কারণে কঠিন মনে হয়। মানুষের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসার কারণে অনেক মানুষ হারামের দিকে পতিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের হালাল চিনতে অসুবিধা হচ্ছে, তারা মনে করছে এখন হালাল হারিয়ে গেছে। হালাল খুজে পাওয়া সম্ভব নয়। হারামের দিকে রাস্তা ধরা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।  আর যিনি আমাদেরকে সত্য দিন এর উপর রেখে গেছেন তিনি বলেছেন:

" إن الحلال بيِّن، وإن الحرام بيِّن، وبينهما أمور مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس، فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه، ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه، ألا وإن لكل ملكٍ حمى، ألا وإن حمى الله محارمه، ألا وإن في الجسد مضغة.. الحديث "1.

নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারাম স্পষ্ট এদুটির মাঝখানে সন্দেহযুক্ত বিষয় আছে অনেক লোক তা জানে না। যে সন্দেহযুক্ত জিনিস থেকে বেঁচে থাকবে সে তার দিন এবং সম্মানকে ত্রুটি মুক্ত রাখল। আর যে সন্দেহযুক্ত জিনিসের মধ্যে পতিত হল সে হারামের মধ্যে পতিত হল। ঐ রাখালের ন্যায় যে সংরক্ষিত এলাকার নিকট চারণ করে আশংকা আছে তার মধ্যে ঢুকে পড়ার। সাবধান! প্রত্যেক বাদশার একটি সংরক্ষিত এলাকা আছে, জেনে রাখ‍! আল্লাহ  তাআলার সংরক্ষিত এলাকা হল তার হারাম করা বিষয়, জেনে রাখ! শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিন্ড আছে। [ বুখারি, মুসলিম, আন নবাবি ৪০ হাদিস, হাদিস নং ৬ ]

যে ব্যক্তি দিন রক্ষার ব্যাপারে যত্নবান তার নিকট যদি কোন বিষয় হারাম হালাল হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ হয় তবে না জানা থাকলে জ্ঞানীলোকদের থেকে জেনে নেবে যেমন আল্লাহ তাআলা নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ سورة النحل: 43.

"সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান।" [ সূরা আন-নাহল ৪৩ আয়াত ]

ঐ সকল লেন-দেন যা শরীয়ত ভিত্তিক নয় এবং তা স্পষ্ট তবে তা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করার পর্যায়ে পড়ে যাকে আল্লাহ তাআলা তা হারাম এবং নিষিদ্ধ করেছেন। মানুষ আজকাল হারাম উপার্জনের ব্যাপারে অনেক বেশি উদাসীন হয়ে গেছে: শ্রমিক তার কাজ সঠিকভাবে করে না। আবার অনেক সময় মালিক পক্ষ কাজের পারিশ্রমিক দেয় না। দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার কর্ম সঠিকভাবে পালন করে না। ব্যবসায়ী তার দ্রব্যের মধ্যে ভেজাল দেয়। সুদী কারবারী সাহসী হয়ে উঠে। তারা মানুষের ক্ষতি করে এমন জিনিসের ব্যবসা করে এমনকি অনেক ব্যবসায়ের বস্তু মানুষের জীবন ধংস করে দেয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল সেই ব্যক্তি যে হেদায়েতের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে শয়তানের সাথে আপোস করল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থাতো এই ছিল ঘরের কোনে একটি খেজুর তার বিছানায় পড়ে পেলেন সেটি উঠালেন খাওয়ার জন্য অত:পর আশঙ্কা করলেন এটি সাদকাহওতো হতে পারে, পরে ফেলে দিলেন। ইমাম বুখারি রহ: আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 " إني لأنقلب إلى أهلي فأجد التمرة ساقطة على فراشي فأرفعها لآكلها، ثم أخشى أن تكون صدقة فألقيها "،

"আমি আমার পরিবারের নিকট গেলাম আমার বিছানায় খেজুর পড়ে থাকা অবস্থায় পেলাম আমি সেটি খাওয়ার জন্য উঠালাম অত:পর ভয় হল তাতো সাদাকাহ হতে পারে তাই ফেলে দিলাম।" [ মুসলিম ১৭৮০ ]

  তার সাহাবীরাও হারাম থেকে এমন ভয়ে থাকতেন। দেখুন না আবু বকর সিদ্দিক রা. এর অবস্থা তার একটি কৃত দাস ছিল যে তার ট্যাক্স আদায় করত, আবু বকর রা. ট্যাক্সের পয়সায় তার সংসার চলত, সে একদিন তার জন্য একটা জিনিস আনল আবু বকর রা. তার থেকে খেলেন। কৃতদাসটি তাকে বলল এটা কি তা আপনি জানেন? তিনি প্রশ্ন করলেন এটা কি? সে বলল: আমি ইসলাম পূর্বযুগে এক ব্যক্তির রাশিফল গণনা করেছিলাম। আর এ রাশিফল গণনা করতে আমি তার সাথে ধোকাবাজী করতাম। তার সাথে আজ আমার সাক্ষাত হওয়ার পর সে আমাকে ঐ জিনিস দিয়েছিল। তার থেকেই আপনি খেয়েছেন, আবু বকর রা. মুখের ভিতর হাত দিলেন এবং পেটের ভিতর যা ছিল সব বমি করে দিলেন।

(আবু বকর রা. এর ঘটনা ইমাম বুখারি রহ. মানাকেব অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।)
কায়াব বিন আজরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে রাসূল সা. আমাকে বললেন:

: أعيذك بالله يا كعب بن عجرة من أمراء يكونون من بعدي فمن غشي أبوابهم فصدقهم في كذبهم وأعانهم على ظلمهم فليس مني ولست منه ولا يرد علي الحوض ومن غشي أبوابهم أو لم يغش فلم يصدقهم في كذبهم ولم يعنهم على ظلمهم فهو مني وأنا منه وسيرد علي الحوض يا كعب بن عجرة الصلاة برهان والصوم جنة حصينة والصدقة تطفئ الخطيئة كما يطفئ الماء النار يا كعب بن عجرة إنه لا يربو لحم نبت من سحت إلا كانت النار أولى به" رواه الترمذي وقال: هذا حديث حسن غريب وصححه الألباني 614

"হে কাআব বিন আজরা! আমি আল্লাহ তাআলার নিকট তোমার জন্য ঐ সমস্ত শাসক থেকে আশ্রয় পার্থনা করছি যারা আমার পরে আসবে। যে ব্যক্তি তাদের দরবারে যাবে তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করবে। তাদের অত্যাচারে সাহায্য করবে সে আমার সাথে নয়। আমিও তার সাথে নই। সে হাউজে আসতে পারবে না। আর যে তাদের দরবারে গেল অথবা না গেল, তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করল না। তাদের অত্যাচারে সাহায্য করল না। সে আমার সাথে আমিও তার সাথে এবং সে হাউজের কাছে আমার সাথে সাক্ষাত করবে। হে কাআব ইবনে আজরা নামাজ হল দলিল-প্রমাণ। সিয়াম হল শক্ত ঢাল। দান সদকা গোনাহকে তেমনই মিটিয়ে দেয় যেমন পানি আগুনকে মিটিয়ে দেয়। হে কাআব ইবনে আজরা! ঐ মাংশ বৃদ্ধি পায় না যা হারাম দ্বারা তৈরী হয়। বরং জাহান্নাম এর থেকে উত্তম।" [ তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করে বলেছেন হাদিসটি হাসান এবং গরিব আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন ৬১৪ ]

আবু বকর রা. বললেন: হে বৎস! তোমার ধংস হোক। তুমি আমাকে ধংসের দার প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলে। আমি ভয় পেয়েছিলাম এই হারাম মালের দ্বারা আমার গোস্তের বৃদ্ধি ঘটবে যদি এমন হয়ে যেত তাহলে আমার কি হত? আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

: " إنه لا يربو لحم نبت من سحت إلا كانت النار أولى به"3.

ঘুষের মাধ্যমে যে গোস্ত তৈরী হয় তা বৃদ্ধি পায় না বরং তা আগুনের জন্য বেশি উপযুক্ত। [ তিরমিযি, ভ্রমন অধ্যায় كتاب الصلاة]    

আয়েশা রা. বলেন: তোমরা সবাই উত্তম ইবাদত থেকে অমনোযগী হয়ে আছো আর তা হল : খোদাভীরু হয়ে চলা। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন: তোমরা যদি নামায পড়তে পড়তে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে যাও। আর রোযা রাখতে রাখতে তারের মত কঙ্কাল হয়ে যাও তোমাদের পক্ষ থেকে তা অতক্ষণ পর্যন্ত কবুল হবে না যতক্ষণ না তোমরা খোদাভীরু হয়ে তা পালন  না করবা।

উমর ফারুক রা. বলেন: আমরা হালাল উশরের এক নবম অংশ এই ভয়ে নিতাম না যদি আমরা হারামের মধ্যে পড়ে যাই। পূর্বসুরীদের অবস্থা তো এমন পর্যায়ে পৌছেঁছিল কোন ওয়ায়েজ মানুষের উদ্দেশ্যে ওয়াজ করতে চাইলে তার মধ্যে তিনটি বিষয় খুজেঁ দেখতে বলতেন: যদি সে বিদআতের আকিদা পোষণ করে তবে সে শয়তানের ভাষায় কথা বলবে তার ওয়াজে বসবে না। আর যদি হারাম ভক্ষণ করে তবে সে প্রবৃত্তি অনুযায়ি কথা বলবে। আর যদি তার বুদ্ধি কম থাকে তবে সংশোধন করার চেয়ে অধিক পরিমাণে পথভ্রষ্ট করবে তার কাছে বসবে না।

ইয়াহইয়া ইবনে মুআজ রা. বলেন: আনুগত্য আল্লাহর ভান্ডারের মধ্য থেকে একটি ভান্ডার তার চাবি হল দুআ। কিন্তু হালাল খাদ্য তা নষ্ট হয়ে যাওয়া রোধ করে।

সবচেয়ে বিপদ জনক বিষয় হল মানুষ দুনিয়ার দিকে ঝাপিয়ে পড়েছে আর দুনিয়া উপার্জন করছে যে কোন পন্থায় হালাল হারাম বাঁচ বিচার করছে না। তাদের চিন্তা একটাই সম্পদ কিভাবে হাতে আসবে এটা দেখছে না তা হারাম না হালাল? কিভাবে ধনী হতে পারবে সেটাই চিন্তা করে সারা জীবন। এ কারনে অনেকে হিদায়েতের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

 أَفَمَن يَمْشِي مُكِبًّا عَلَى وَجْهِهِ أَهْدَى أَمَّن يَمْشِي سَوِيًّا عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ سورة الملك: 22.

যে ব্যক্তি উপুড় হয়ে মুখের উপর ভর দিয়ে চলে সে কি অধিক হিদায়াতপ্রাপ্ত নাকি সেই ব্যক্তি, যে সোজা হয়ে সরল পথে চলে? [ সূরা আল মুলক ২২ আয়াত ]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

" إن الله قسم بينكم أخلاقكم كما قسم بينكم أرزاقكم، وإن الله يعطي الدنيا من يحب ومن لا يحب، ولا يعطي الدين إلا من يحب، فمن أعطاه الله الدين فقد أحبه. والذي نفسي بيده لا يُسلم عبد حتى يسلم قلبه ولسانه، ولا يؤمن حتى يأمَن جاره بوائقه " قالوا: وما بوائقه يا نبي الله؟ قال: " غشمه وظلمه، ولا يكسب عبد مالاً من حرام فينفق منه فيبارك له فيه، ولا يتصدّق به فيقبل منه، ولا يتركه خلف ظهره إلا كان زاده إلى النار، إن الله لا يمحو السيئ بالسيئ، ولكن يمحو السيئ بالحسن، إن الخبيث لا يمحو الخبيث " أخرجه الإمام أحمد في المسند وإسناده ضعيف.

অল্লাহ তাআলা তোমাদের মধ্যে তোমাদের চরিত্রকে বন্টন করেছেন যেমন তোমাদের রিযক তোমাদের মধ্যে বন্টন করেছেন। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার সম্পদ দান করেন যাকে ভালবাসেন এবং যাকে ভাল না বাসেন তাকেও। আর দ্বীন দান করেন যাকে তিনি ভালবাসেন শুধু তাকে। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার অন্তর এবং জিহবা মুসলমান হবে। আর ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তার প্রতিবেশি তার বাওয়ায়েক থেকে নিরাপদে থাকবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন বাওয়ায়েক কি জিনিস হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন: তার যুলুম অত্যাচার। আর এটা কখনো হবে না, যে কেহ হারাম উপার্জন করবে তার থেকে খরচ করবে আর আল্লাহ তাতে বরকত দেবেন এবং তার থেকে দান করবেন আর আল্লাহ সে দান কবুল করবেন। আর সে তার থেকে যা কিছু রেখে যাবে তা তার আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়ার বস্তু হবে। আল্লাহ তাআলা খারাপ দ্বারা খারাপের প্রতিকার করেন না। কিন্তু ভাল দ্বারা খারাপ মিটিয়ে দেন। খারা কখনও খারাপ-কে মিটাতে পারে না। [ আহমাদ হাদিসের সনদটিতে দুর্বলতা রয়েছে  ] 

বুখারি মুসলিমে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

" إن أكثر ما أخاف عليكم ما يخرج الله لكم من بركات الأرض " قيل: وما بركات الأرض؟ قال: " زهرة الدنيا "، ثم قال: " إن هذا المال خضرة حلوة، من أخذه بحقه ووضعه في حقه فنعم المعونة هو، وإن أخذه بغير حقه كان كالذي يأكل ولا يشبع، ويكون عليه شهيدًا يوم القيامة ".

তোমাদের জন্য আমি সবচেয়ে যে বিষয়টির বেশী ভয় করি তা হল আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য যে বারাকতুল আরদ বের করবেন। প্রশ্ন করা হল, বারাকাতে আরদ কি জিনিস? তিনি বললেন: দুনিয়ার চাকচিক্য। অতপর বললেন: এই মাল সম্পদ সবুজ এবং মিষ্ট। এই মালের অধিকারসহ যে গ্রহণ করবে এবং জায়গামত তা ব্যয় করবে, সে এর মাধ্যমে সে উত্তম সাহায্য পাবে। আর যদি অন্যায় ভাবে সম্পদ গ্রহণ করে, তাহলে তার দৃষ্টান্ত সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে খাদ্য গ্রহণ করে কিস্তু তৃপ্ত হয় না। আর ঐ সম্পদ কিয়ামতের দিন তার বিপক্ষে সাক্ষী হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আমরা দেখতে পাই, যে ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে লোভ লালসা তার মনের মধ্যে অনেক বেশি বাসা বাধেঁ। সে মনে কখনও শান্তি পায় না। সব সময় কৃপণতা করে। তাদের হাত ভর্তি কিন্তু মন খালি। মানুষ তাদের সম্পর্কে বলে: ধনীরা গরিবদের সম্পদের প্রতি বেশি লোভাতুর হয়। কেননা হাদিসের ভাষা অনুযায়ী তারা হল এমন যে, খাবার গ্রহণ করে তবে তাদের পেট ভরে না। আর যে সুদের কারবারের মধ্যে পড়ে যায়, সে তার থেকে তওবা করে না। ফলে সুদ গ্রহণ করা থেকে তার মধ্যে অনুশোচনা আসে না। আর যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, অন্যায় কাজ তার জন্য সুন্দর করে দেখানো হয়। সে নিজে সেটিকে ভাল মনে করে। ফলে কোন বাহানা বা ষড়যন্ত্র করতে ত্রুটি করে না। আমরা দেখতে পাই তাদেরকে যারা মানুষের সাথে ধোকাবাজি করে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, অথবা শুনতে পাই তাদের সম্পর্কে যারা কোন কাজ করে দিয়ে তার পরিবর্তে ঘুষ নেয়  অথবা জমির দালালি করে পয়সা নেয় তাদের এই হারাম উপায়ে অর্জন করতে অন্তর কাপে না। তারা মানুষের ন্যায্য অধিকার দিতে কার্পণ্য করে শ্রমিকের মজুরি ঠিকমত দেয় না। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর রব বলে ঈমান এনেছে। মুহাম্মাদ-কে নবী বলে মেনে নিয়েছে। ইসলাম-কে দ্বীন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে তার পক্ষে এমন করা কিভাবে সম্ভব? সে কি করে হারাম খেতে পারে? সে তো জানে যে এর পরিণতি কি হবে আখেরাতে? দুনিয়াতেও এর শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হারাম উপায়ে মাল সম্পদ উপার্জনে কিভাবে রাজি হতে পারে সে? সে তার দ্বীনকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে কিভাবে বিক্রি করে দিতে পারে? এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُاْ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالآَخِرَةِ فَلاَ يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلاَ هُمْ يُنصَرُونَ سورة البقرة: 86.

"তারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে খরিদ করেছে। সুতরাং তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।" [ সূরা বাকারা ৮৬ ]

সবশেষে এই দুআ করি যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন:

اللهم اكفنا بحلالك عن حرامك، وبطاعتك عن معصيتك، و وأغننا بفضلك عمن سواك.

হে আল্লাহ! হারাম থেকে বাঁচিয়ে হালাল আমাদের জন্য যথেষ্ট করে দিন। গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে আনুগত্য যথেষ্ট করে দিন। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের মুখাপেক্ষীহীন করে দিন।

সমাপ্ত

 

আবূ যর (রা:)-এর ইসলাম গ্রহণ

$
0
0

ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার

Pics 1

আবু জামরাহ (রা :) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আব্দুললাহ ইবনু আব্বাস (রা:) আমাদেরকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে আবূ যর (রা:)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করব না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বললেন, আবূ যর (রা:) বলেছেন, আমি গিফার গোত্রের একজন মানুষ ।আমরা জানতে পারলাম যে, মক্কায় এক ব্যক্তি আত্মপ্রকাশ করে নিজেকে নবী বলে দাবী করছেন। আমি আমার ভাইকে বললাম, তুমি মক্কায় গিয়ে ঐ ব্যক্তির সাথে আলোচনা করে বিস্তারিত খোঁজ-খবর  নিয়ে এস। সে রওয়ানা হয়ে গেল এবং মক্কার ঐ লোকটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে আসল।

অতঃপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি খবর নিয়ে এলে? সে বলল, আল্লাহ্‌র কসম! আমি এমন একজন ব্যক্তিকে দেখেছি যিনি সৎকাজের আদেশ দেন এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করেন। আমি বললাম, তোমার খবরে আমি সন্তুষ্ট  হতে পারলাম না। অতঃপর আমি একটি ছড়ি ও এক পাত্র খাবার নিয়ে মক্কার দিকে রওয়ানা  হলাম। মক্কায় পৌঁছে আমার অবস্থা দাঁড়াল এমন যে, আমি তাকে চিনি না এবং কারো নিকট জিজ্ঞেস করাও আমি সমীচীন মনে করি না। তাই আমি যমযমের পানি পান করে মসজিদে থাকতে লাগলাম।

একদিন সন্ধ্যা বেলা আলী (রা:) আমার নিকট দিয়ে গমনকালে আমার প্রতি ইশারা করে বললেন, মনে হয় লোকটি বিদেশী।আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চল। আবূ যর বলেন, অতঃপর আমি তার সাথে তার বাড়ি চললাম। পথে তিনি আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করেননি আর আমিও ইচ্ছা  করে কোন কিছু বলিনি। তাঁর বাড়িতে রাত্রি যাপন করে ভোরবেলায় আবার মসজিদে গেলাম ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে  জিজ্ঞেস করার জন্য। কিন্তু ওখানে এমন কোন লোক ছিল না যে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলবে। তিনি বলেন, ঐদিনও আলী (রা:) আমার নিকট দিয়ে চলার সময় বললেন, এখনো কি লোকটি তার গন্তব্যস্থল ঠিক করতে পারেনি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, আমার সঙ্গে চল।

পথিমধ্যে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বল, তোমার ব্যাপার কি? কেন  এ শহরে এসেছ?

আমি বললাম, যদি আপনি আমার বিষয়টি গোপন রাখার আশ্বাস দেন তাহলে  তা আপনাকে বলতে পারি।

তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আমি গোপন করব।

আমি  বললাম, আমরা জানতে পেরেছি, এখানে এমন এক লোকের আবির্ভাব হয়েছে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন। আমি তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য আমার ভাইকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে ফেরত গিয়ে আমাকে সন্তোষজনক কোন কিছু বলতে পারেনি। তাই নিজে দেখা করার ইচ্ছা নিয়ে এখানে আগমন করেছি।

আলী (রা:) বললেন, তুমি সঠিক পথপদ্রর্শক পেয়েছ। আমি এখনই তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছি। তুমি আমাকে অনুসরণ কর এবং আমি যে গৃহে প্রবেশ করব তুমিও সে গৃহে প্রবেশ করবে। রাস্তায় যদি তোমার বিপদজনক কোন লোক দেখতে পাই তবে আমি জুতা ঠিক করার অজুহাতে দেয়ালের পার্শ্বে সরে দাঁড়াব, যেন আমি জুতা ঠিক করছি। আর তুমি চলতেই থাকবে।

আলী (রা:) পথ চলতে শুরু করলেন। আমিও তাঁর অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। তিনি নবী (সাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করলে আমিও তাঁর সঙ্গে ঢুকে পড়লাম। আমি বললাম, আমার নিকট ইসলাম পেশ করুন। তিনি পেশ করলেন। আর আমি তৎক্ষণাৎ মুসলিম হয়ে গেলাম।

নবী (সাঃ) বললেন, হে আবূ যর। এখনকার মত তোমার ইসলাম গ্রহণ গোপন রেখে তোমার দেশে চলে যাও। যখন আমাদের বিজয়ের খবর জানতে পারবে তখন এসো। আমি বললাম, যে আল্লাহ্‌ আপনাকে সত্য দ্বীনসহ  পাঠিয়েছেন  তাঁর  শপথ!  আমি কাফির-মুশরিকদের সামনে উচ্চৈঃস্বরে তাওহীদের বাণী ঘোষণা করব। (ইবনু আব্বাস (রা:) বলেন) এই কথা বলে তিনি মসজিদে হারামে গমন করলেন, কুরাইশের লোকজনও সেখানে উপস্থিত ছিল। তিনি বললেন, হে কুরাইশগণ! আমি নিশ্চিতভাবে সাক্ষ্য দিচিছ যে,

''আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন (হক্ব) মা’বূদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ্‌র বান্দা ও তাঁর রাসূল।''

এতদশ্রবণে কুরাইশগণ বলে উঠল, ধর এই ধর্মত্যাগী লোকটিকে। তারা আমার দিকে এগিয়ে আসল এবং আমাকে এমন নির্মমভাবে প্রহার করতে লাগল, যেন আমি মরে যাই। তখন আব্বাস (রা:) আমার নিকট পৌঁছে আমাকে ঘিরে রাখলেন। অতঃপর তিনি কুরাইশদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। তোমরা গিফার বংশের জনৈক ব্যক্তিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছ, অথচ  তোমাদের  ব্যবসা-বাণিজ্যের  কাফেলাকে  গিফার গোত্রের নিকট দিয়ে যাতায়াত করতে হয়? এ কথা শুনে তারা আমার নিকট থেকে দূরে  সরে  পড়ল। পরদিন  ভোরবেলা  কা’বাগৃহে  উপস্থিত  হয়ে গত দিনের মতই  আমি  আমার  ইসলাম  গ্রহণের  পূর্ণ  ঘোষণা  দিলাম। কুরাইশগণ বলে উঠল, ধর এই ধর্মত্যাগী লোকটিকে। গতকালের মত আজও তারা নির্মমভাবে আমাকে মারধর করল। এই দিনও আব্বাস (রা:) এসে আমাকে রক্ষা করলেন এবং কুরাইশদেরকে উদ্দেশ্য করে ঐ দিনের মত বক্তব্য রাখলেন। ইবনু আব্বাস (রা:) বলেন, এটাই ছিল আবূ যর (রা:)-এর ইসলাম গ্রহণের প্রথম ঘটনা (বুখারী হা/৩৫২২ ‘মানাকিব’অধ্যায়, ‘আবূ যর গিফারীর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা’অনুচেছদ, হা/৩৮৬১ ‘আনছারদের মর্যাদা’অধ্যায়)।

 

শিক্ষা:

১. হক্ব অন্বেষণের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

২.  হকের পথের পথিকরা নানান মুসীবতের সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে তাদেরকে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে।

৩. সমাজের প্রচলিত রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে কথা বললে নানা বিদ্রূপাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় কিংবা নানা ব্যঙ্গাত্মক নামে ডাকা হয়। কিন্তু তাতে বিচলিত না হয়ে সত্য প্রচারে অটল থাকতে হবে।

 

Viewing all 995 articles
Browse latest View live